একটা আত্মহত্যা ও আমাদের আবেগ!

 In খোলা কলাম, প্রধান খবর

কাদের পলাশ

</br></br>

বাঙালি কেমন জাতি? এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আজো পাওয়া যায়নি। কারণ বাঙালিজাতি অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য ধারণ করে চলেছে। করবে। এটি ঐতিহাসিক। অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বাঙালী আবেগি জাতি। দেশের বিভিন্ন ঘটনায় আমাদের আচরণ বা অবস্থান দেখে এমনটাই পরিলক্ষিত হয়। আবেগি বলেই আমরা ভাষার জন্যে জীবন দেই। দেশের জন্যে অকাতরে প্রাণ দেই। অমূল্য সম্পদ খুব সহজে বিলিয়ে দেই বলেই প্রত্যাশা এবং অভিমান থাকে অনেক বেশি। প্রত্যাশা পূরণ না হলেই আবেগে অভিমান ঊর্ধ্বমুখে ভুরভুরিয়ে উঠি। প্রত্যাশা পূরণ না হলে আশাহত হই। খুনি হয়ে উঠি। বিশ্বাস ভাঙে, বিশ্বাস ভাঙলে মন ভাঙে। আর বিশ্বাস ও মন ভাঙে বলেই এক রশিতে প্রেমিক যুগল আত্মহত্যা করে। এমন নজির শুধুমাত্র বাংলাদেশেই আছে। তাই বলে কী আমরা  আত্মহত্যাকে সমর্থন করবো? নিশ্চয় না।

</br></br>

সম্প্রতি চাঁদপুর সদর উপজেলার বাগাদী ইউনিয়নে একটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ধারণা করা হচ্ছে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আত্মহনন কারী সাথী আক্তার বাগাদী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। রোল নং ১৬৭, শাখা গ। জাতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্কুলের বেতন ৮০টাকা আর স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বলেছে ২০টাকা দিতে পারেনি বলে স্যার অপমান করেছে। অশ্লীল বাক্যসহ রোদে একঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তাই অপমান সইতে না পেরে সাথি আক্তার ঘরের আড়ার সাথে গলায় উড়না প্যাঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। আর দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমগুলো এমন সংবাদ প্রকাশের কারণে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী চাঁদপুরের জেলা প্রশাসককে ফোন করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয় এসে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পুলিশ প্রশাসনও তৎপর হয়ে উঠে। শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার, বিষয়টি নিয়ে একপ্রকার তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়। অথচ একই স্কুলের একই ক্লাসের ছাত্রী সোনিয়া আক্তারের ১১শ ২০টাকা বাকী রেখেই পরীক্ষা নিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। পরীক্ষার ফি স্কুলের মাসিক বেতন বাকি রেখে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে এমন প্রমাণ ভুরিভুরি আছে। যাই হোক, আমি কারো বিরুদ্ধে বলছি না। শুধুমাত্র কিছু তথ্য পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি।</br></br>

প্রথমত: সাথি আক্তার চলতি বছর ৫জানুয়ারী ৭শ ৪০টাকা বিদ্যালয়ের দৈনিক আদায় রেজিস্টারে জমা দেয়। সর্বশেষ ১৭ জুলাই বেতন বাবদ ২০০টাকা জমা দেয়। তখন অর্ধ বার্ষিকী পরীক্ষা চলছিলো। আর আগস্ট মাসে কোনো টাকা ছাড়াই সাথি মডেল টেস্টের দুটি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সাথির বাবা মায়ের ভাষ্য মতে ২শ ৫০টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়েছিল। বাকী টাকা জোগাড় করতে পারেনি। ওই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর মাসিক বেতন ১শ ৪০টাকা আর মডেল টেস্ট পরীক্ষার ফি ২শ ৮০টাকা। সেক্ষেত্রে টাকার অংকটা ৮০ নয়, ২০ নয় অবশ্যই কয়েকগুণ বেশি হওয়ার কথা।

দ্বিতীয়ত: সাথি ২৮ তারিখের মডেল টেস্ট পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ইংরেজি ২য় পত্রের ৫০নম্বরের পরীক্ষায় প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেয়। ওই উত্তরপত্রটি বর্তমানে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে রয়েছে। সেক্ষেত্রে পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে সাথিকে বের করে দেয়া হয়েছিল এমন অভিযোগ প্রশ্নবিদ্ধ!

</br></br>

তৃতীয়ত: টাকার জন্যে কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করা হয়েছে। এতো বড় অবিবেচক গুরুজনরা হতে পারেন, এটা অবিশ্বাস্য। যেহেতু শিক্ষার্থীরা টাকা রোজগার করে না। তাছাড়া স্কুলের খরচ পরিবার বহন করে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই নরমে গরমে এমন ভাবে বলা হয় যেন সে তার অভিভাবককে টাকার কথাটা বলে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকও বিষয়টি গুরুত্ব দেয়। কিন্তু কোনো শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করবে এমন কথা বা আচরণ কোনো শিক্ষক করতে পারেন না। আর যদি এমন আচরণ করেনও সেক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া এতো দেরিতে আসার কথা নয়। নিশ্চয় আরো দ্রুত আসার কথা। কারণ ঘটনার দিন সাথি স্কুলেই আসেনি। আগের দিন তথা ২৮ আগস্ট পরীক্ষার পরপর-ই তার প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারতো। কিন্তু সে কোনো অস্বাভাবিক আচরণ করেনি। এমনকি সে ২৯ আগস্ট সকালে প্রাইভেট টিউটরের কাছে গিয়ে পড়ে এসেছিলো। ধরি, স্কুলে আসার সময় সাথির মনে পড়েছে একদিন আগে শিক্ষকের অপমানের বিষয়টি। পরিবারের সদস্যরা যখন সম্পূর্ণ পরীক্ষার ফি সংগ্রহ করতে পারেনি। তাই হয়তো হতাশা আরো বেড় যায় তার। তখন বাবা অথবা মা তার সাথে এসে শিক্ষকদের সাথে কথা বললে হয়তো বিষয়টি সমাধান হতে পারতো। তাহলে হয়তো এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি হতো না জাতি। কিন্তু তা না করে সাথি স্কুলে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কেন মা টাকা ধার নিতে যাবেন। এক্ষেত্রে সাথির আবেগ উসকে দেয়ার জন্যে বাবা ও মা কী দায়ী নয়?

</br></br>

চতুর্থ: বিদ্যালয়ে ৮টি সিসি ক্যামেরা ছিল। পুলিশ সে ক্যামেরাগুলো জব্দ করেছে। ওই সিসি ক্যামেরায় সাথি কিংবা অন্য কোনো শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন চাঁদপুরের পুলিশ সুপার শামছুন্নাহার। তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত টিমও এ ঘটনায় বিশেষ কোনো আলামত সংগ্রহ করতে পারেনি বলে একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। তাহলে একটা ছোট্ট ঘটনাকে জাতীয় ইস্যু করার ফলাফল আমরা কী পেতে যাচ্ছি?

</br></br>

পঞ্চম: সাধারণত স্কুলের সকল টাকা পয়সা আদায় করেন ক্লার্ক বা অফিস সহকারী। পরীক্ষার অনুমতি কিংবা বাধা দিতে পারেন প্রধান শিক্ষক কিংবা চলতি দায়িত্বে থাকা শিক্ষক। অথচ সাথির আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারী হিসেবে চারজনকে আসামী করা হয়। বিষয়টি অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। এক্ষেত্রে মামলার বাদী সাথির বাবা দেলোয়ার হোসেনের দো-মুখী বক্তব্য লক্ষ্য করা গেছে। তার মতে, মামলার অন্যতম আসামী সংকর স্যারের নাম বাদ পড়েছে। জাকির হোসেন ও জাহাঙ্গীর হোসেন এর নামের ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন।

</br></br>

সর্বোপরি স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ও ব্যক্তি বিদ্বেষ এ ঘটনাকে পুঁজি করে মাথা চড়া দিয়ে উঠেছে কি না বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিৎ। কারণ বিদ্যালয়টি পরিচালিত হচ্ছে এডহক কমিটি দ্বারা। এ কমিটি নিয়ে এলাকায় পক্ষ-বিপক্ষ আছে। সাথির বিষয়টিকে পুঁজি করে কেউ কেউ তাদের ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করতে তৎপর রয়েছে বলে অনেকে ধারণা করছেন। সাথির আত্মহত্যা বাগাদী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রায় সাড়ে ১৩শ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক শিক্ষিকার উপর মারাত্মক ভাবে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। যা কাটিয়ে উঠতে নিশ্চয় অনেক সময় লাগবে। আমরা এতো আবেগপ্রবণ জাতি যে, একজন শিক্ষার্থীর জন্যে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দিচ্ছি কী না তা ভেবে দেখি না! ঘটনার পর আমি ঘটনাস্থল প্রায় প্রতিদিন পরিদর্শন করেছি। স্কুলের সকল শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর ঢালাও অভিযোগ। সব শিক্ষক খারাপ! স্কুল খারাপ! হঠাৎ আমি বলে উঠলাম তাহলে স্কুলটা এখান থেকে সরিয়ে দিন। মেঘনা নদীতে ফেলে দিন! আপনাদের সন্তানদের অন্য স্কুলে পড়ালে ভালো হবে। তাই না? জবাবে তারা বললেন, অন্য স্কুলগুলো আরো বেশি খারাপ! তাহলে ভালো স্কুল কোনটি? তারা কিছু না বলে একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। তারপর আমার দিকে কটু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তাদের দৃষ্টিতে বুঝালাম, আমি তাদের আবেগে আঘাত করেছি।

</br></br>

যাইহোক, ধরে নিলাম সাথির আত্মহত্যা প্ররোচণাকারী হিসেবে স্কুল শিক্ষক ও অফিস সহকারী দোষী। সেক্ষেত্রে মামলার বাদী কিছু আর্থিক সুবিধার মাধ্যমে মামলাটি তুলে নেবেন হয়তো। অথবা সমঝোতা হলো না। শিক্ষক ও অফিস সহকারীসহ অন্য শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলো। এবং এটাই হওয়া উচিৎ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তা প্রমাণ না হয়, তবে শিক্ষকের মানহানির ক্ষতিপূরণ দেবে কে? কারণ যে অভিভাবক ২শ ৮০টাকা জোগাড় করতে পারেননি, সে পরিবার কিভাবে ওই শিক্ষকদের আত্মসম্মানের ক্ষতিপূরণ দেবে?  সর্বোপরি নূন্যতম দোষের জন্যে একজন শিক্ষক বা কেউ যেন খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে প্রশাসন অবশ্যই দৃষ্টি  দেবেন এমনটাই প্রত্যাশা সবার।

</br></br>

Recent Posts

Leave a Comment