অবসান হচ্ছে জেলা পরিষদের প্রশাসক যুগের

 In জাতীয়, প্রধান খবর, শীর্ষ খবর

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অবসান হচ্ছে জেলা পরিষদের প্রশাসক যুগের। আর প্রশাসক নয়, এবার দেশের সকল জেলা পরিষদ পেতে যাচ্ছে নির্বাচিত চেয়ারম্যান। আগামী নবেম্বর কিংবা ডিসেম্বরের মধ্যেই একযোগে সারাদেশের জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে শনিবার রাতে অনুষ্ঠিত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয় বলে বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণে নয়, পরিষদের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য প্রতিনিধি নির্বাচন করা হবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভোটে। সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্বাচকম-লীতে রেখে পূর্ণাঙ্গ জেলা পরিষদ গঠন করার। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদেরও ভোটার করার চিন্তাভাবনা রয়েছে সরকারের। স্থানীয় সরকার বিভাগ এ লক্ষ্যে জেলা পরিষদ আইন-২০০০ পর্যালোচনার কাজ শুরু করেছে।

সূত্র জানায়, জেলা পরিষদ নির্বাচনও দলীয়ভাবেই হবে। দল থেকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী দেয়া হবে। দল মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে থেকে স্ব স্ব জেলার স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা ভোটের মাধ্যমে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করবেন। জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে কি-না, সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু না জানালেও স্থানীয় সরকারে তাদের জনপ্রতিনিধির সংখ্যা নগণ্য। তাই প্রার্থী দিলেও তাদের চেয়ারম্যান প্রার্থীর বিজয়ের সম্ভাবনা কম। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে শেষপর্যন্ত জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের সম্ভাবনা কম বলেই দলটির নীতিনির্ধারক নেতারা আভাস দিয়েছেন।

দ্রুতই জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তের কথা স্বীকার করে আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ রবিবার জনকণ্ঠকে বলেন, দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় জেলা পরিষদ নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কবে নাগাদ এ নির্বাচন হতে পারেÑ জানতে চাইলে তিনি জানান, আগামী নবেম্বর কিংবা ডিসেম্বরে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আইন অনুযায়ী স্ব স্ব জেলার স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরাই ভোট দিয়ে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবেন। দলীয়ভাবে প্রার্থী দেয়া হবে কিনা? জানতে চাইলে হানিফ জানান, অবশ্যই দল থেকে প্রতিটি জেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী দেয়া হবে। তবে কয়েকজন সিনিয়র নেতার মতে, এ নিয়ে পরবর্তীতে পার্টির কার্যকরী ফোরামে আরও আলোচনা করে পুরো নির্বাচনী পদ্ধতি নির্ধারণ করা হবে।

এ ব্যাপারে সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, জেলা পরিষদ নির্বাচন বিদ্যমান আইনেই হবে। এজন্য যদি কোন এসআরও জারির প্রয়োজন হয়, তা করা হবে। আর নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোন আইন অসঙ্গতিপূর্ণ হলে সেটিতে সংশোধনী আনা হবে। দ্রুতই আইনী কাজ সম্পন্ন করে নবেম্বর কিংবা ডিসেম্বরে নির্বাচনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে জেলা পরিষদ প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা দেয়াই এ নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্য বলে জানান তারা।

পার্বত্য তিনটি জেলা বাদে বাকি ৬১ জেলা পরিষদে ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রশাসক নিয়োগ করে সরকার। তখন স্থানীয় সরকার বিভাগসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা বলেছিলেন, ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে জেলা পরিষদ গঠন করা হবে। কিন্তু গত সাড়ে চার বছর ধরে প্রশাসক দিয়েই চলছে জেলা পরিষদগুলো। নির্বাচন না হওয়ায় অনির্বাচিত ব্যক্তিরাই প্রশাসক হিসেবে কাজ করায় অনেক ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা কমে যায়। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশ দেন বলে জানা গেছে।

জেলা পরিষদ নির্বাচন হবে বিদ্যমান জেলা পরিষদ আইন-২০০০ অনুযায়ীই। বিদ্যমান এ আইনের ১৭(১) ধারায় বলা হয়েছেÑ ‘প্রত্যেক জেলার অন্তর্ভুক্ত সিটি কর্পোরেশনের (যদি থাকে) মেয়র, কমিশনার, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, কমিশনার, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়ে নির্বাচকম-লী গঠিত হবে।’ ১৭(২) ধারায় বলা হয়েছেÑ ‘প্রত্যেক ওয়ার্ডের জন্য নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রণীত একটি ভোটার তালিকা থাকবে।’ ১৭(৩) ধারায় বলা হয়েছেÑ ‘নির্বাচকম-লীর সদস্য নন এমন কোন ব্যক্তি ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না।’ আইনের এই ধারা অনুযায়ী ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের ভোটদানের মাধ্যমে জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জেলা পরিষদ নির্বাচনের পর একটি পূর্ণাঙ্গ পরিষদ গঠন করা হবে। জেলা পরিষদ নির্বাচনে একজন চেয়ারম্যানের পাশাপাশি ১৫ জন সদস্য এবং সংরক্ষিত ৫ জন নারী সদস্যও নির্বাচন করা হবে।

জেলা পরিষদ নির্বাচনে জনপ্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যদের ভোটার হওয়ার কোন সুযোগ নেই। সরকার ভোটার বাদে বাইরে থেকে কাউকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দিতে চাইলে বিদ্যমান আইনে কিছু জটিলতা রয়েছে। সেগুলো সংশোধনের প্রয়োজন হবে। কারণ বিদ্যমান আইনে ভোটার বাদে কেউ এ পদে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই। সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক সূত্রে জানা গেছে, জেলা পরিষদ নির্বাচনে বাইরে থেকে প্রার্থী করার সুযোগ দিতে বিদ্যমান আইনে সামান্য সংশোধনী আনা হতে পারে। আর ওই সংশোধনীতে ভোটার হিসেবে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির চিন্তাভাবনাও রয়েছে।

সূত্র জানায়, জেলা পরিষদ নির্বাচন দলীয়ভাবেই অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন দলীয়ভাবে হলে সরকারদলীয় ব্যক্তিই জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ পাবেন। কারণ বর্তমানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ সমর্থিত।

ইউনিয়ন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠানের জন্য স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনের সংশোধনী আনা হয়। এ সময় জেলা পরিষদেও একই ব্যবস্থা চালুর জন্য আইন সংশোধন করা হয়। যদিও মন্ত্রিসভা তা অনুমোদন করেনি। গত ২৮ মার্চ মন্ত্রিসভার নিয়মিত সাপ্তাহিক বৈঠকে আইনটি সংশোধন না হওয়ার কারণ সম্পর্কে মন্ত্রিসভাকে অবহিত করা হয়। ওই বৈঠকেও জেলা পরিষদ নির্বাচনের বিষয়ে ইতিবাচক মত দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই স্থানীয় সরকার বিভাগ এ নিয়ে কাজ শুরু করে।

জেলা পরিষদ স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন একটি স্তর। স্থানীয় সরকারের অন্যান্য স্তরের (সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ) ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের অনুরোধে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের আয়োজন করে। জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী ১২টি বাধ্যতামূলক কাজ করবে জেলা পরিষদ। এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ জেলার সব উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যালোচনা; উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার গৃহীত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা; জনসাধারণের ব্যবহার্থে উদ্যান, খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থানের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ। এছাড়া শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজকল্যাণ, জনস্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক কল্যাণসহ কিছু ঐচ্ছিক কাজও করবে। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জেলার উন্নয়নমূলক কমিটির সভাপতি। তবে নির্বাচন না হওয়ায় বর্তমান সরকারের নিযুক্ত প্রশাসকরাই এ কমিটির সভাপতি।

জেলা পরিষদ ব্রিটিশ আমল থেকেই চালু ছিল। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে এই জেলা পরিষদ কাঠামোকে অনেক বেশি কার্যকর করে জেলা গবর্নর পদ্ধতি চালু করেন। কিন্তু তা কার্যকর হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। এরপর জিয়াউর রহমান আবার জেলা পরিষদ গঠন করেন। ওই সময়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে সরকারের মনোনীত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া হতো। জেলা পরিষদের মাধ্যমে তখন মূলত উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হতো। জেনারেল এরশাদের আমলেও জেলা পরিষদ কার্যকর ছিল। ১৯৮৮ সালে ঠিক হয় সরকার মনোনীত ব্যক্তিরা নন, সংসদ সদস্যরা হবেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। কিন্তু ১৯৯১ সালে গঠিত বিএনপি সরকারের সময় জেলা পরিষদ অকার্যকর হয়ে পড়ে। ওই সময় উপজেলা পরিষদও বিলুপ্ত করা হয়। মূলত জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কোন নির্বাচন না দেয়ায় জেলা পরিষদ অকার্যকর হয়ে পড়ে। সরকারে উপসচিব পদমর্যাদার একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়ে এ পরিষদ পরিচালনা শুরু হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর জেলা পরিষদ কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে জেলা পরিষদ আইন-২০০০-এর ৮২(১) ধারা অনুযায়ী দেশের তিনটি পার্বত্য জেলা বাদে ৬১ জেলা পরিষদের প্রশাসক নিয়োগ করা হবে। এ আইনানুসারে, জেলা পরিষদ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একজন প্রশাসক জেলা পরিষদের কার্যাবলী সম্পাদন করবেন। তবে জেলা পরিষদের নির্বাচন কবে হবে এবং প্রশাসক কতদিন দায়িত্ব পালন করবেন, তার কোন সময়সীমার উল্লেখ নেই ওই আইনে।

দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসক দিয়ে জেলা পরিষদ পরিচালিত হওয়ার পর আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ পরিষদ গঠন করতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকার। আগামী নবেম্বর কিংবা ডিসেম্বরের মধ্যে এ নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগকে নির্দেশও দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই অবসান হচ্ছে জেলা পরিষদে প্রশাসক যুগের।

 

Recent Posts

Leave a Comment