ট্রাম্প বনাম যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা

 In দেশের বাইরে, রাজনীতি

 

ট্রাম্প বনাম যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির একাধিক অভিযোগ জমা হচ্ছে গণমাধ্যমে। নিউইয়র্ক টাইমস আরো দু’জন নারীর সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর, ট্রাম্প মামলা ঠুকে দিয়েছেন পত্রিকাটির বিরুদ্ধে। ট্রাম্প তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করলেও এরই মধ্যে তার বিধ্বস্ত ইমেজকে তুলোধুনো করতে মাঠে নেমেছেন অনেকেই।

ফাস্ট লেডি মিশেল ওবামাও বলছেন, এমন ব্যক্তি আর যাই হোক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না, যেটা হবে জাতীয় লজ্জা। স্বতন্ত্র বিশ্লেষকরা সাম্প্রতিক জরিপে হিলারির ক্রমাগত এগিয়ে থাকার বিষয়গুলো পর্যালোচনায় নিয়ে বলছেন, এবারের নির্বাচনে জয় তো দূরে থাক, ট্রাম্পের কারণে রিপাবলিকান দল আগামী কয়েক যুগ ধরে ক্ষত সারতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ৫৯ বছর বয়সে দ্বিতীয় স্ত্রী মিলেনিয়া ট্রাম্পকে বিয়ে করার মাত্র ৮ মাসের মাথায় অন্য এক নারীকে ধরাশায়ী করতে যে সব করেছিলেন সেটার গল্প বলছিলেন। ২০০৫ সালে অ্যাকসেস হলিউড নামের একটি প্রোগ্রাম শুটিংয়ের সময় একটি বাসের মধ্যে বসে ট্রাম্প ওই নারীকে নিয়ে যে সব কথাবার্তা বলছিলেন, তাতে প্রকাশ পায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের যৌনলিপ্সা আর নারী সম্পর্কে ধারণা। তার বিশ্বাস যে চাইলেই পাওয়া যায় সব নারীকে, শুধু সাহস করে এগিয়ে যেতে হয়। এ অডিও টেপ প্রকাশ হওয়ার পর স্মরণকালের সবচে ভয়াবহ বিপদের মুখে আছেন রিপাবলিকান এ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী, যখন নির্বাচনের বাকি আর চার সপ্তাহেরও কম সময়।

রোববার হিলারি আর ট্রাম্পের মধ্যকার দ্বিতীয় নির্বাচনী বিতর্কে এ ধরনের ঘটনা জীবনে আরো ঘটিয়েছেন কি না- উপস্থাপক এন্ডারসন কুপারের এক প্রশ্নের জবাবে স্বভাবতই অস্বীকার করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে বাধ সেধেছে নিউইয়র্ক টাইমস আর অন্য কয়েকটি গণমাধ্যম। তারা তথ্য-প্রমাণসহ হাজির করেছে যে এমন আরো অন্তত ৫ জন নারী অভিযোগ এনেছেন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে, যাদের দু’জন কথা বলেছেন নিউইয়র্ক টাইমসের সাথে। নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি ভিডিও চিত্রে, জেসিকা লিডস নামের এক বয়স্ক নারী ব্যবসায়ী ঘটনা সামনে এসেছেন। তিনি বলছেন, ৩৫ বছর আগে বিমানে চড়ার সময় তাকে ট্রাম্পের ইশারায় সাধারণ শ্রেণি থেকে বিজনেস ক্লাসে নিয়ে আসা হয়। এরপর নিজের পরিচয় দেওয়ার পর ট্রাম্প কীভাবে তাকে হয়রানি করেছেন বিমানের সিটে বসেই।

‘সব ঠিক ছিল, আমি জানতাম না সে রিয়েল এস্টেট টাইকুন। গল্প বলার সময়, সে তার হাত চালাতে থাকে, এবং কিছু বুঝে ওঠার আগে আমার শরীরের উপরের অংশে তার হাত চলে যায়’ এটা মেনে নেওয়া আমার জন্য কষ্টকর ছিল, কিছু স্মৃতি আছে নারীদের জীবনে দুঃসহ এটা তেমনই একটি। না হলে হয়তো ভুলে যেতাম’ বলছিলেন জেসিকা লিডস। তার মতো এমন কথা এসেছে আরো অনেক নারীর মুখ থেকেই। তবে সাহস নিয়ে তারা প্রকাশ্যে অভিযোগ করতে নারাজ, সামজিক হেনস্থার ভয়ে। এসব আলোচনায়, দেশের সচেতন নারী সমাজ, দলমত নির্বিশেষে রীতিমত ট্রাম্পকে ঘৃণা শুধু নয়; বিচার চাইছেন প্রকাশ্যে। ফাস্ট লেডি মিশেল ওবামা যেমন, তার ২০ মিনিটের বক্তব্যে রীতিমত ধ্বংস করে ফেলেছেন ট্রাম্পের ইমেজ।

‘এমন ঘটনা মনে হয় নারী হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই ঘটেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ঘৃণা করি ওই সব পুরুষের যারা বিশ্বাস করে চাইলেই নারীর শরীর পাওয়া যায়। এটা কোনো সভ্য মানুষের চিন্তা হতে পারে না, আর যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে চায়, তার ভাব না তো কোনোভাবেই হতে পারে না। অথচ লজ্জার কথা হলো এই ব্যক্তি আমাদের সেই ইতিহাস ভুলে যেতে বলছেন, বন্ধ রুমের কথা বলে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিতে বলছেন’ কথাগুলো বললেন প্রেসিডেন্ট ওবামার স্ত্রী মিশেল ওবামা।

এ সবে ক্ষিপ্ত ট্রাম্প বিষদগার করে চলেছেন তার সমালোচনাকারীদের। অবশ্য খুব বেশি কাছে পাচ্ছেন না কাউকে। বুধবার রাতেই বিবৃতি দিয়ে সেটা অস্বীকার করেননি শুধু, মানহানির মামলা ঠুকে দিয়েছেন নিউইয়র্ক টাইমসের বিরুদ্ধে।

ট্রাম্প বলছেন, এ সব রিপোর্টের কোনো সত্যতা নেই। তার সুনাম ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে আইনি পদক্ষেপের কথা বলছেন। নিউইয়র্ক টাইমস সময় না নিয়ে ট্রাম্পের পাঠানো উকিল নোটিশের জবাব দিয়ে বলেছে, মানসম্মান খোয়ানোর জন্য নিউইয়র্ক টাইমস নয়; ট্রাম্প নিজেই দায়ী। তাদের কাছে সব তথ্য-প্রমাণ আছে বলে পাল্টা নোটিশ পাঠিয়েছে ট্রাম্প নির্বাচনী শিবিরে।

এমনিতেই দেশব্যাপী নারী ভোটারের মধ্যে জরিপে ইতিহাসের রেকর্ড পরিমাণ কম নারী ভোট নিয়ে নভেম্বরের ৮ তারিখে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সর্বশেষ ফক্স জরিপে, দেশ্যবাপী ট্রাম্পের গড় ভোট কমেছে, আর হিলারি এখন ৮ ভাগ ভোটে এগিয়ে।  হিলারি ক্লিনটন ৪৯ শতাংশ ভোটারের সমর্থনে এগিয়ে আছেন যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪১ শতাংশ। গত মাসে তার সমর্থন ছিল ৪৪ শতাংশ, আর হিলারির ছিল ৪৭ শতাংশ।

স্বাধীন বিশ্লেষকরা ভাবছেন, ট্রাম্পের পরাজয় শুধুই বড় বিষয় নয়; এ নির্বাচনে বরং দীর্ঘ মেয়াদে তিনি তার ৪০ শতাংশ ভোটারের মনে বিদ্বেষ আর ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। যার সাথে রিপাবলিকান পার্টির সম্পৃক্ততা নেই। আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের গবেষক নর্ম অরনাইস্টেইন বলছেন, এটা রিপাবলিকান দলকে যুগের পর যুগ ভোগাতে ও ইমেজ সঙ্কটে ফেলতে পারে।

‘নিশ্চিতভাবেই আমাদের জীবদ্বশায় যত বড় দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী দেখেছি তার মধ্যে ট্রাম্প নিকৃষ্ট। তার হাতের নাগালে হোয়াইট আমেরিকান পুরুষ বা সাদা ভোটারদের বেশ কিছু ভোট মিলিয়ে যে সব ভোট আছে তা ইলোক্ট্ররাল ম্যাপের ৪০ শতাংশের বেশি নয়। কিন্তু এরা মূল দল রিপাবলিকান পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, ট্রাম্পের একনিষ্ট ফলোয়ারে পরিণত হয়েছে। যাদের দেখে ট্রাম্প বলেন, আমি সরাসরি কাউকে গুলি করছি-এমনটা দেখলেও তারা আমাকে ভোট দেবে। এখন দলের শীর্ষ নেতারা কেউ নেই ট্রাম্পের সাথে। হাউস স্পিকার পল রায়ানের সাথে ট্রাম্পের বিরোধ বলে দেয় দলটি এখন তার লাটাই ছাড়া। তাই এবারের নির্বাচন নয় শুধু, কয়েক জেনারেশন ধরে হয়তো রিপাবলিকান দলকে এ মূলধারার সচেতন মানুষ থেকে দূরে থাকতে হবে’ বলছিলেন অরনাইস্টেইন।

এসব নিয়ে শুধু বিশ্লেষকরা নয়; দলীয় শীর্ষ নেতৃত্ব ভীষণভাবে চিন্তিত। কেননা, দলের শীর্ষ কোনো নেতা এখন নেই ট্রাম্পের সাথে। অনেকেই বলছেন, ট্রাম্প এখন তার উগ্র সমর্থকদের নিয়ে অনেকটা স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচনের ফলাফল পর্যন্ত সেই অবস্থার পরিবর্তন হয় কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়।

Recent Posts

Leave a Comment