সক্রেটিস : মাননীয় জুরিবৃন্দ। আমার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ এনেছেন তাদের মধ্যে তিনজনের একজন হলেন কবি, একজন শিল্পী ও একজন রাজনীতিক। আমি যে কিছুই জানি না, জ্ঞানহীন, সে সম্পর্কে আমি ভাল করেই জানি। তাই গেলাম কবিদের কাছে, ভাবলাম তাদের কাছে জ্ঞান পাব। কিন্তু মাননীয় জুরি, আমি অবাক হয়ে দেখলাম, তারা নিজেদের রচনার অর্থ নিজেরাই করতে পারেন না। আরো আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, যে কবির যশ বেশি, সে-ই সবচেয়ে কম জানেন। সমস্যাটা তাদেরকে খুলে বললাম। কবিসহ তার তাবত ভক্তকুল আমার শত্রু হয়ে গেলেন। পারলে তারা মারতে আসেন।
জুরিবৃন্দ : আপনি বলে যান।
সক্রেটিস : গেলাম শিল্পীদের কাছে। কবিদের মতো তারাও নানা দোষে দুষ্ট। তারা নিজেরা হয়তো অনেক ভাল কিছু সৃষ্টি করে চলেছেন, কিন্তু তারা বহু প্রসঙ্গে একেবারেই মূর্খ। এই দোষগুলো তাদের কৃতিত্বকে ঢেকে দিয়েছে, মাননীয় জুরি। বললাম, আপনারা জ্ঞানী নন। আমরা কেউই জ্ঞানী নই। বস্তুত মানুষের কোনো জ্ঞান নেই। এ কথাগুলো বলার সাথে সাথেই তারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন, আমার শত্রু বনে গেলেন।
জুরিবৃন্দ : আপনি বলে যান… আমরা শুনছি।
সক্রেটিস : আমি প্রখ্যাত এক রাজনীতিকের কাছে গেলাম। কিছুক্ষণ কথা বলার পর তার সম্পর্কে আমার যে ধারণা ছিল তা আমূল পাল্টে গেল। ওই রাজনীতিক নিজেকে প্রকাশ্যে ঘোষণা নিয়ে জ্ঞানী দাবি করে থাকেন এবং অনেক লোকও তাকে জ্ঞানী হিসেবে জানেন এবং রীতিমত পূজা করেন। আমি তাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম, কথা বলে দেখলাম আমি আপনি কেউই জ্ঞানী নই। শুনেই তিনি ক্ষেপে গেলেন। তার নেতাকর্মীরা পারলে আমাকে সেখানেই জুতা ছুড়ে মারে আর কি।
মহামান্য জুরিবৃন্দ। আমি জ্ঞানী লোকের সন্ধানে গিয়ে অসংখ্য শত্রু তৈরি করেছি। আমার মাথায় যতো চুল, এখন শত্রুর সংখ্যাও তার চেয়েও বেশি। আমি কি অন্যায় করেছি? তরুণরা আমার শত্রু নয়; বরং কবি, রাজনীতিক আর শিল্পীরাই আমার শত্রু এখন। আমি তরুণদের বিপথে নেয়নি। তাদের সত্য শেখাতে গেছি। এথেন্স ছেড়ে যাবার অনেক প্রলোভন দেওয়া হয়েছে আমাকে। আমি পালিয়ে যাইনি। আমি এথেন্সকে ভালবাসি। এই এথেন্সের জন্য, তরুণ সমাজের জন্য কিছু করে যেতে পারলে জীবন ধন্য হবে।
জুরিবৃন্দ : আপনি দোষী।
দুই.
অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ট। বিচারে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে সক্রেটিসের। ঠুনকো অভিযোগে কারো মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা বিশ্বে বোধ করি এটিই প্রথম। মৃত্যুর দিন প্রশান্তবদনে সক্রেটিস তার শিশুপুত্র মিনেজেনাসকে বললেন, ”বাছা, বাড়ি গিয়ে ঘুমাওগে।” উপস্থিত শুভাকাঙ্ক্ষীদের কেউ কেউ তখন হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। সক্রেটিস উল্টো তাদের সান্ত্বনা দিতে শুরু করলেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মুহূর্ত এল। পশ্চিমাকাশে ডুবতে যাওয়া সূর্যটা তখন রক্তাক্ত হতে শুরু করল।
সক্রেটিস : শোনো বন্ধুরা। আমার লাশ যেন কেউ অহেতুক টানা হেঁচড়া না করে। আমি নিজেই গোসল করে, মৃত্যুপরিচ্ছদ পরিধান করে তৈরি হয়ে আছি। আমি নিজে প্রশান্ত থাকলে, তোমাদের উদ্বেগ কেন? তোমরা শান্ত থাক।
এ সময় হেমলকের পাত্র নিয়ে জল্লাদের প্রবেশ…
জল্লাদ : জনাব, এই নিন হেমলক। হেমলকের এক ফোঁটাও যেন নষ্ট না হয়। নির্দেশ আছে মাননীয় বিচারকদের।
সক্রেটিস : দেন, আপনি নিশ্চিত থাকুন। আপনার চাকরি নড়বড়ে করতে চাই না আমি। দেন, পাত্রটার পুরো হেমলক পান করছি এখনই।
জল্লাদ : জনাব, আপনাকে এবার পায়চারি করতে হবে যে। আপনি খুবই শান্ত। এ অবস্থায় হেমলকের বিষে ধরতে সময় লাগবে। বরং পায়চারি করলে বিষটা দ্রুত ছড়াবে শরীরে। হাঁটুন দেখি…
(সক্রেটিসের উপস্থিত বন্ধুরা এ মর্মান্তিক নিষ্ঠুর আবেদনে যারপর নাই ক্ষেপে গেলেন। অমানবিকতার চরম পরিণতি দেখে একজন তো সেখানেই মূর্চ্ছা গেলেন। টলটলায়মান শরীর নিয়ে তখনও সক্রেটিস বন্ধুদের ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানালেন। দৃশ্য দেখে এগিয়ে এলেন কারাগারের দারোয়ান।)
দারোয়ান : মহামান্য সক্রেটিস। আমি জীবনে অনেক মৃত্যুদণ্ডের কয়েদিকে দেখেছি। তারা সারাক্ষণ মৃত্যুচিন্তায় তটস্থ থাকত। শুধু আপনাকেই ব্যতিক্রম দেখলাম। আমি হলফ করে বলছি, আমার দেখা সবচে ভদ্র, সাহসী ও শ্রেষ্ঠ কয়েদি হলেন আপনি। আবেগে আমি আর চোখের জল ধরে রাখতে পারছি না, মহাশয়। মাফ করুন।
সক্রেটিস : শান্ত হোন। আমি মৃত্যুর দিকে চললাম। আপনারা থাকুন জীবনের দিকে। ঈশ্বরই ভাল জানেন, কোন দিকটা উত্তম।
একটু পরে হেমলকের বিষ সক্রেটিসের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। পশ্চিমাকাশে সূর্যটা আরো রক্তিম হল। সক্রেটিস আর হাঁটতে পারছিলেন না। বুঝতে পারলেন, সময় আর বেশি নেই। তাই শুয়ে পড়লেন। মুখের ওপর টেনে নিলেন একটি চাদর। গোটা কয়েদিরুম নিস্তব্ধ। এ সময় হঠাৎ সক্রেটিস তার মুখের ওপরকার চাদর সরিয়ে এক বন্ধুকে বললেন, ”শোনো, একজনের কাছে আমাদের একটি মুরগি ধার করা আছে। সেটা পরিশোধ করে দিও।”
এ কথা বলার সাথেই সাথেই পশ্চিমাকাশে হেলে থাকা রক্তিম সূর্যটা এক ফুৎকারে নিভে গিয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত হল।
দূরে কোথাও বিউগলের করুণ সুর বাজতে শোনা গেল। সেই সুর ধীরে ধীরে হেমলকের বিষের মতোন সংক্রমিত করে চলল পুরো এথেন্সবাসীর মনকে।
সাম্প্রতিক খবর
মৃতুদণ্ড কার্যকরের ২৪১৫ বছর পর গ্রিসের একটি আদালত সম্প্রতি জানাল সক্রেটিস নির্দোষ ছিলেন। এথেন্সের ওনাসিস ফাউন্ডেশনের একটি আদালত গত শুক্রবার ফের নতুন করে বিচারব্যবস্থার আয়োজন করেছিল। সেই বিচারেই সক্রেটিসকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে রায় দিয়েছেন ওই আদালত।
সক্রেটিসের সমর্থনে তাঁর আইনজীবী বলেছেন, কোনো ব্যক্তির অভিমত অপরাধ হতে পারে না। সক্রেটিস সত্যের সন্ধান করতেন। আর তা করতে গিয়েই তিনি তাঁর নিজস্ব মত তুলে ধরতেন। তবে আমার মক্কেলের একটাই দোষ, তিনি উস্কানিমূলক কথা বলে মানুষকে খ্যাপাতেন। আর সবসময় বাঁকা বাঁকা কথা বলতেন। কিন্তু সাধারণ একটি মামলাকে জটিল করার জন্য মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি দেওয়াটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
সক্রেটিসের হয়ে এই মামলায় ফ্রান্সের এক বিখ্যাত আইনজীবী সওয়াল করেন। উল্টোদিকে গ্রিস-সহ বেশ কয়েকটি দেশের আইনজীবীরা সক্রেটিসের বিরোধিতাও করেন। এই মামলার বিচারের জন্য আমেরিকা ও ইউরোপীয় বিচারকদের সমন্বয়ে একটি প্যানেল তৈরি করা হয়। দীর্ঘ বাদানুবাদের পরে সক্রেটিসের আইনজীবীর যুক্তিতেই সিলমোহর দেন বিচারকরা। গত বছর নিউইয়র্কের একটি আদালতেও সক্রেটিস নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত, প্রশংসিত, যুক্তি ও মুক্তচিন্তার জনকদের একজন এই সক্রেটিস। সক্রেটিসই প্রমাণ করেছিলেন কেবল দৈহিক সৌন্দর্যই সব নয়; মেধা-বুদ্ধি-বিচক্ষণতাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার দর্শনচিন্তা শুধু তৎকালেই নয়; আজও গোটাবিশ্বে আলোচিত। সক্রেটিস সত্য ও যুক্তির আশ্রয়ে থেকে অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করেননি; বরং মৃত্যুবরণ করে অমর হয়ে আছেন সবার মাঝে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।