বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না মহিলা দলেরও

 In বিশেষ প্রতিবেদন, রাজনীতি

বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না মহিলা দলেরও

‘বিএনপি’ ও ‘বিতর্ক’ দুটি যেন সমার্থক শব্দ। গত মার্চে দলটির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হওয়ার পর নতুন প্রতিটি কমিটি নিয়েই চলছে তুমুল বিতর্ক। দলীয় হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে হতাশা ব্যক্ত করেছেন দলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতাকর্মীরা।

 

কাউন্সিলের পাঁচ মাস পর পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি নিয়ে এর আগেই ক্ষোভ ঝেড়েছেন দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী। যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ন, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনসহ অভিযোগ ছিল নতুন কমিটিতে দলের অনেক সিনিয়র নেতার পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়স্বজনদেরও স্থান দেওয়া। এছাড়া কমিটিতে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ ও চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী শিমুল বিশ্বাসের দৌরাত্ম নিয়েও রয়েছে অনেকের অভিযোগ।

সদ্য প্রয়াত স্থায়ী কমিটির সদস্য বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতা। হান্নান শাহ’র মৃত্যুর দিন (২৭ সেপ্টেম্বর) যেখানে দলের সবার শোকাতুর থাকার কথা, সেখানে এমন দিনে মহিলা দলের কমিটি ঘোষণা করাকে ভালোভাবে দেখছেন না অধিকাংশ নেতাকর্মীই।

আগের কমিটিগুলোর মতো মহিলা দলের কমিটিতেও বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না। গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঘোষিত এ কমিটির কেন্দ্রীয় সভাপতি করা হয় কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আফরোজা আব্বাসকে। যিনি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের স্ত্রী। সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে গত কমিটির ঢাকা মহানগরের সভাপতি সুলতানা আহমেদকে। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণে পদপ্রাপ্তদের বেশিরভাগই মির্জা আব্বাসের অনুসারী এবং আস্থাভাজন।

আফরোজা আব্বাসের একমাত্র রাজনৈতিক পরিচয় তিনি মির্জা আব্বাসের স্ত্রী। মহিলা দলের সদ্য বিদায়ী কমিটির সহসভাপতির পদটিও তিনি মির্জা আব্বাসের ক্ষমতাবলেই দখল করেছিলেন বলে দলের তৃণমূল কর্মীদের অভিযোগ। গত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণের মূলত মেয়র পদপ্রার্থী ছিলেন মির্জা আব্বাস। কিন্তু তার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় রাজপথে স্বামীর হয়ে প্রচারণা চালান আফরোজা আব্বাস, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা তার এতটুকুই। বিদায়ী কমিটির সহসভাপতি পদটি দখল করে রাখলেও রাজপথের আন্দোলন-মিছিলে-মিটিংয়ে দেখা মেলেনি তার।

সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হওয়া সুলতানা আহমেদের একমাত্র যোগ্যতা হাত ধরে চেয়ারপারসনকে হাঁটাচলায় সাহায্য করা। এছাড়া আর কিছুই দেখছেন না মহিলা দলের সঙ্গে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া নেতাকর্মীরা। সাংগঠনিক কাজে ‘অযোগ্য’ সুলতানা বছরের বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে সময় কাটান, মামলা-হামলায় জর্জরিত ত্যাগী নেত্রীদের পাশ কাটিয়ে হঠাৎ কেন সুলতানা আহমেদ চেয়ারপারসনের এতো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল বিষয়টি কারো বোধগম্য নয়।

আফরোজা-সুলতানা নেতৃত্বাধীন কমিটির মাধ্যমে দীর্ঘদিন মহিলা দলকে সুখে দুঃখে আগলে রাখা শিরিন সুলতানা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। নতুন কমিটির কোথাও পদ না দিয়ে দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ত্যাগ স্বীকার করা এই নেত্রীকে বঞ্চিত করা হয়েছে। গত আগস্ট মাসে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদকের পদ দেওয়া হলেও এর কিছুদিনের মধ্যেই মহিলা দলেই থাকতে চান জানিয়ে দলীয় ওই পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। এমনকি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতেও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে বিলকিস জাহান শিরিন ও শ্যামা ওবায়েদসহ অপেক্ষাকৃত তরুণ নেত্রীদের দেওয়া হয় তারচেয়ে সিনিয়র পদ, যেখানে রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি তাদের অনেক সিনিয়র ও দক্ষতাসম্পন্ন।

কমিটি নিয়ে শিরিন সুলতানা  বলেন- ‘নব্বইয়ের আন্দোলন থেকে এই পর্যন্ত দীর্ঘদিন দলে সক্রিয় রাজনীতি করেছি। এখন দল যাকে যোগ্য মনে করেছে, দায়িত্ব দিয়েছে। আমি দুর্দিনে যেমন ছিলাম, ভবিষ্যতেও একজন সাধারণ সমর্থক হিসেবে দলের জন্য কাজ করে যাব। নতুন কমিটির সঙ্গে বিদায়ী কমিটির সবাই মিলেমিশে কাজ করবে বলে আশা রাখি। তবে নতুন কমিটির নামে যদি দীর্ঘদিন আমার সঙ্গে আন্দোলনে যুক্ত নেতাকর্মীদের সবাইকেই নির্মূল করা হয়, সেটা দুঃখজনক হবে।’

নবনির্বাচিত কমিটি নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে দলের সাধারণ মহিলা কর্মী থেকে নেতৃস্থানীয় সকলেই। এরই মধ্যে তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নতুন কমিটি প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হয় বিদায়ী কমিটির ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিনের কাছে।

তিনি বলেন- ‘কমিটির মেয়াদ যেহেতু উত্তীর্ণ হয়েছে,  নতুন কমিটি হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আমি যেহেতু দলের একটা দায়িত্বে ছিলাম তাই নতুন কমিটি কাদেরকে নিয়ে করা হলো, কবে করা হলো এটা জানার অধিকার আমার ছিল। দল কাকে দায়িত্ব দিবে এটা তো আসলে দলের সিদ্ধান্ত। তবে ঢাকা মহানগরের কমিটিতে আরো যোগ্যতাসম্পন্ন নেত্রীরা এলে সাধারণ কর্মীরা হয়ত উৎসাহ পেত। যারা কাজ করেছে, রাজপথে আন্দোলন করেছে, হামলা-মামলা-হুলিয়া সহ্য করেছে সেসব নেত্রীরা পদ-পদবী পাননি, তারা বঞ্চিত হয়েছেন। যিনি কেন্দ্রের সভাপতি হয়েছেন তিনি স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য মির্জা আব্বাসের স্ত্রী। এর আগে তিনি দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তবে ঢাকা সিটি করপোরেশন ইলেকশনে যেহেতু আব্বাস ভাই গ্রেফতারি পরোয়ানার জন্য গণসংযোগে উপস্থিত থাকতে পারেননি, তার হয়ে ভাবি কাজ করেছেন। যিনি সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন তিনি ছিলেন ঢাকা মহানগরের সভাপতি। তার সাংগঠনিক দক্ষতার অভাব আছে। তিনি কোনোদিন থানাভিত্তিক কর্মকাণ্ডেও অংশ নিতেন না। অধিকাংশ সময় দেশের বাইরে কাটানো এই নেত্রীর সাংগঠনিক কাজে কোনো উৎসাহ নেই। তাই সাধারণ নেতাকর্মীরা হতাশ হবে এটাই তো স্বাভাবিক।’

সদ্য নির্বাচিত কমিটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের কর্মীরাও। শুধু কেন্দ্রের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকই নন, অভিযোগ আছে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ নিয়েও। গত কমিটির ঢাকা মহানগরের এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবিবা চৌধুরী বিথী অভিযোগ করেন, ঢাকা উত্তরের সভাপতি পেয়ারা মোস্তফা ওয়ান ইলেভেনে সংস্কারপন্থী ছিল। ওয়ান ইলেভেন থেকে এই পর্যন্ত কোনো আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা কেউ দেখেনি। এছাড়া এ কমিটিতে অথর্ব ও অযোগ্য লোকদের নির্বাচিত করা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

তিনি  বলেন, ওয়ান ইলেভেন থেকে এখন পর্যন্ত শিরিন সুলতানার নেতৃত্বে আমরা আন্দোলন করে এসেছি, মামলা-হামলার জন্য যখন রাজপথ শূন্য ছিল তখন পুলিশের টিয়ারশেল খেয়ে লাঠিচার্জের মুখে মহিলা দলের আমরাই লড়েছি। তখন কোথায় ছিলেন বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ? তাদেরকে তখন খুঁজে পাওয়া যায়নি, আজ ঠিকই স্বার্থ হাসিল করতে চলে এসেছেন। ত্যাগী নেতা-কর্মীদের দল ছুড়ে ফেলেছে, এসব ভাবতে ও বলতে কষ্ট হয়।

মহিলা দলের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদের সঙ্গে পরিবর্তন ডটকমের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে কমিটি নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটা চ্যালেঞ্জের মুখে আমাদের নতুন কমিটিটা এসেছে। গণতন্ত্রের আন্দোলনের পক্ষে তৃণমূল থেকে ওয়ার্ড-থানা, মহানগর, জেলাভিত্তিক ও কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত শিগগিরই আমরা আমাদের সংগঠনকে গুছিয়ে নিয়ে আসব।

নতুন কমিটির পদপ্রাপ্তরা এক এগারোর আন্দোলন থেকে প্রতিটি আন্দোলনে তেমন একটা সক্রিয় ছিলেন না এমন অভিযোগ নাকচ করে সুলতানা আহমেদ বলেন- সবাই কাজ করেছি, হয়তো কেউ কম, কেউ বেশি কিন্তু কাজ করিনি বা সক্রিয় ছিলাম না বলে যে অভিযোগ, আমার মনে হয় সেটি সত্যি নয়। এত বড় একটা দল, এখানে সবাই তো আর এক সমান কাজ করতে পারে না, কেউ বেশি করবে, কেউ হয়তো একটু কম করবে। মহিলা দলে পুরোনো যারা ছিলেন তারা অবশ্যই নতুন কমিটিতে থাকবেন এবং নতুন যারা এসেছেন তাদের সবার সহযোগিতা মিলেই দল ও সংগঠনের কাজ সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবো বলে আমরা আশা রাখি।

বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানাকে দলে মূল্যায়ন করা হয়নি, এই প্রসঙ্গে সুলতানা আহমেদ বলেন, এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি না, দল যাকে মনে করবে দায়িত্ব দেবে, সেটা আমি বলার কেউ না।

বিএনপির এইই নাজুক সময়ে সাংগঠনিক দিক থেকে প্রতিটা অঙ্গ সংগঠনকে যখন শক্তিশালী করা প্রয়োজন, তখন ঢাকা মহানগরসহ প্রতিটি জেলার প্রায় কয়েকশ’ কর্মীর মুখে এখন একই প্রশ্ন- কে এই আফরোজা আব্বাস? সুলতানা আহমেদই বা কে? বিগত আন্দোলনগুলোতে তারা কোথায় ছিলেন? নাকি এতদিন যে দলকে তারা আদর্শ মেনে এসেছিলেন সেটি আসলে একটি পরিবারতান্ত্রিক দল যেখানে বংশানুক্রম ও টাকার খেলাটাই মুখ্য। যারা ত্যাগ স্বীকার করে, জেল জুলুম খেটে নিজের গাটের পয়সা খরচ করে দলের জন্য জীবন দিচ্ছেন তারা বলির পাঠা ছাড়া আর কিছুই না।

Recent Posts

Leave a Comment