‘তোমাদের দিকে তাকিয়ে সুস্থ থাকতে চাই’

 In বিশেষ প্রতিবেদন, রাজনীতি, সফল মানুষ

'তোমাদের দিকে তাকিয়ে সুস্থ থাকতে চাই'

বিশ্ব প্রবীণ দিবস কেবল পার হয়ে গেল শনিবার। সন্ধ্যায় ৮৩ বছর বয়সী শিক্ষাবিদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের মুখোমুখি হয়েছিলাম। এই জীবনে লিখেছেন ৭০টি বই। একজন সফল শিক্ষক তিনি। এখনও শিক্ষকতা চালিয়ে যাচ্ছেন। নিরন্তর লিখে যাচ্ছেন। আরো বেঁচে থাকতে চান শুধু লেখার জন্য। সফলতা আর পরিতৃপ্ত জীবনের কথা বলার পাশাপাশি জীবনকে উপভোগ করা এই মানুষটি তার ব্যক্তি জীবনের কথা শুনিয়েছেন অকপটে।

সাক্ষাৎকার দিতে চেয়েছিলেন আরো একদিন আগে। শারীরিক সামান্য অসুস্থতার জন্য প্রথমদিন পারেননি। তারপর আছে এই বয়সেও ব্যস্ততা। এ প্রতিবেদক তার বাসায় পৌঁছার আগে থেকেই তৈরি ছিলেন। নিজের লেখার টেবিলের সামনে বসে প্রথমেই শুরু করলেন কথা বলা। তারপর জমে উঠে আলাপচারিতা।

 

কেমন আছেন স্যার? বাসার সবাই কেমন পরিবারের সবাই?
আমরা খুব সুখী পরিবার। আমার সন্তানেরা আমাকে ঘিরেই থাকে। এই যে সন্ধ্যাবেলা। একটু পর একজন একজন করে ওরা আসবে। আমাকে ঘিরে থাকবে। ও (স্ত্রী বেগম সেলিমা আহমদ) বেঁচে থাকতে এই অভ্যাস হয়েছিল। এখনও সন্তানেরা তা ধরে রেখেছে।

আমি খুব গর্ববোধ করি। আমার এখন তিন পুরুষ শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের ক্ষেত্রে এটা ব্যতিক্রম। আমরাও ব্যতিক্রম। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম। আমার মেয়ে এখন শিক্ষক। আমার নাতনিও শিক্ষক। আর অন্যভাবে বললে, আমরা পাঁচ পুরুষ শিক্ষক। আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন। আমার দাদাও। অন্যদের সঙ্গে আমাদের মেলানো যাবে না।

আমার ছেলেমেয়েদের আমি দেশের বাইরে স্থায়ী হতে দেইনি। আমি আমার সন্তানদের নিয়ে গর্বিত। মাঝে-মধ্যে সন্তান নাতি-নাতনিরা ঘরের বাইরে গেলে খুব অস্বস্তিতে থাকি। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলি- আমি যখন কানাডা থেকে পিএইচডি করে দেশে ফিরে আসি, তখন আমার কানাডিয়ান শিক্ষকরা বলছিল, সবাই এখানে থাকার জন্য আসে, আর তুমি ফিরে যাচ্ছ? আমি বলেছিলাম- আমার একটা স্বাধীন দেশ আছে। আমি মারা গেলে ওই মাটিতে কবর হবে। চলে এসেছিলাম। এখন মনে হয়- সেসময় ভুল করেছিলাম। তখন থেকে গেলে আমার ফ্যামেলিটাতো এখন নিশ্চিন্তে শান্তিতে থাকত।

এটা কী আপনার মনের কথা?
[একটু সময় নিয়ে] মুখে বলি ঠিকই যে বিদেশ থেকে গেলে ভাল করতাম। আবার বারবার মনে হয়। না এখানে আমার কবর হবে।

স্যার আপনার দর্শন
বাপু আমি মিথ্যা কথা কম বলি। মিথ্যা কথা হয়ত বলি। দুই একটা হতে পারে। তা খুব প্রয়োজনে। সত্য বলতে কী বোঝায় বলতে পারব না। তবে জীবনে খুব বাজে কোনো ইনকাম করিনি। এখনও নিজের খাওয়া-দাওয়া নিজের উপার্জনে। আমার এক ছাত্রের একটা বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে পড়াই এখনও।

প্রবীণ দিবস নিয়ে আপনার ভাবনাটা কেমন?
প্রবীণ দিবস এলেই বয়স্কদের দিকে যেন একটা করুণার চোখে তাকানো হয়। এটা খুব ভয়ংকর খারাপ কথা। প্রবীণদের কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করতে হবে। আমরা ভিত্তিটা তৈরি করে যাব। সেই ভিত্তির উপর তোমরা চলবে।

আপনার জীবনের ফিরে দেখা ৮৩ বছর যদি সংক্ষেপে পাওয়া না পাওয়া হিসাবে তুলে ধরতে চান তাহলে কী বলবেন?
আমার জন্ম ১৯৩২ এর ১৫ ডিসেম্বর। যদিও আমার স্কুলের হেড স্যারের কারণে সার্টিফিকেটে জন্মতারিখ এক জুলাই ১৯৩৩। আমার সাত আট বছর বয়সের সময়কার কথাগুলো মনে আছে। আমি আর আমার বড় বোন পাঁচ মাইল হেঁটে স্কুলে যেতাম। আমি একেবারে গ্রামের মানুষ।

খুব মনে পড়ে। আমার স্মরণশক্তি ছোটবেলা থেকেই ভাল ছিল। ১৯৪২-এ ক্লাস ফোর এ তৎকালীন মালদা ডিস্ট্রিক্ট এ ফার্স্ট হয়ে বৃত্তি পেলাম। স্কলারশিপ পেলাম তিন টাকা। এতেই পুরো পরিবারে আনন্দের ঢেউ।

আমি ইন্টারমিডিয়েটে বোর্ডস্ট্যান্ড করলাম। আমার চাঁপাইনবাবগঞ্জের কলেজ আদিনা ফজলুল হক কলেজ বন্ধ হয়ে যাবার কথা ছিল। আমার রেজাল্টের কারণে কলেজটা টিকে গেল।

১৯৫২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ঘোড়ার গাড়িতে চেপে এসে ফজলুল হক কলেজে পৌঁছলাম। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাইনি।

এই ৮৩ বছর বয়স কি বোঝা মনে হয়? বিরক্ত লাগে?
না।না বাপু। বোর লাগেনা। আমার এই ৮৩ বছর বয়স জীবনকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। আমার এখনতো অন্য আর কোনো কাজ নেই। আমি সৈয়দ শামসুল হক বা কবীর চৌধূরী না। তারা অন্যরকম বলতেন ধর্ম নিয়ে। আমি তা না। আমার আল্লাহতালায় প্রচণ্ড বিশ্বাস আছে।

তাহলে জীবনকে উপভোগ করছেন?
হ্যাঁ। এনজয় করছি। বোরতো নয়ই। আমি এখন অতীতটা দেখি, বর্তমান দেখি, ভবিষ্যতটাও দেখি।

আমার বয়সী বা কাছাকাছি বয়সের যারা আছেন তাদের আপসেট হওয়ার কিছু নাই। বয়সটা এমন একটা জিনিস যার উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই। তাই একে সানন্দে গ্রহণ করতে হবে। এবং গ্রহণ করতে হবে একটা লক্ষ সামনে রেখে।

আমার কাজ যেগুলো আছে, সেগুলো শেষ করে যেতে চাই। এখনও কিছু লেখার আছে বাপু। এই কাজগুলো করে যেতে পারলে আমি খুশি হব। মরেও শান্তি পাব। তোমাদের দিকে তাকিয়ে সুস্থ থাকতে চাই।

আপনার বিয়ের স্মৃতি
আমরা ১৯৫৬-এর ১৫ আগস্ট বিয়ে করেছি। (কিছুটা বিষন্ন হয়ে উঠেন এমাজউদ্দিন আহমদ)। মনটা খারাপ হয়ে যায়। এখন অসম্পূর্ণ লাগে।

(নামাজের সময় হল। নামাজ পড়তে নিজের শয়নকক্ষে গেলেন। তার পেছন পেছন এ প্রতিবেদকও। নিজের বিছানার কাছে সামান্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালেন এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। খাটের দিকে হাত বাড়িয়ে আবার শুরু করলেন…)

ও এখানে শুয়ে থাকত। আমি বলতাম একটু বাইরে যাচ্ছি। যত তাড়াতাড়ি পারি চলে আসব। আমাদের ইডেন কলেজে পড়ত। ওখানেই আমাদের দেখা সাক্ষাৎ। পরে বাবা-মায়ের পছন্দ হলে তাদের ইচ্ছাতেই বিয়ে হয়। আমাদের দুজনের কাছে দুজনের পছন্দের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। একটা সুখী জীবন ছিল- ইট ওয়াজ এ হ্যাপি লাইফ।

আমি কানাডা থেকে পিএইচডিতে বিরতি দিয়ে দেশে এসেছিলাম ১৯৭৫-এর ছয় নভেম্বর। ও আমার বাচ্চাদের যেমন আমি চেয়েছিলাম তেমন দেখে রেখেছে। কিন্তু এখনকার মতোই অবস্থা ছিল। একটা মেয়ে একা থাকলে যেমন রিস্ক থাকে।

কী রিস্ক?
এখনও যেমন। একা একটা মেযে থাকলে বাইরে যেতে সমস্যা। ওর একা একা বাজার করতে হত। ও খুব বাইরে যেতে চাইত। আমি ওকে পৃথিবীর অনেক দেশে ঘুরাতে নিয়ে গেছি। পূর্বের দেশ সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া হংকংতো আছেই। ইউরোপ আমেরিকায় নিয়ে গিয়েছি। দেশ-বিদেশ ঘুরিয়েছি। এই স্মৃতিগুলো জড়িয়ে আছে।

আপনিতো সারাক্ষণ স্ত্রীর শয্যা পাশে থাকতেন
অসুস্থ যখন হল, সারাক্ষণ সন্তানদের চিন্তা করত। শুধু বলত- আমার সন্তানদের কী হবে? পাঁচ বছর অসুস্থ ছিল। প্রথম দুই বছর জ্ঞান ছিল। কথা বলতে পারত।

আমি বরাবরই ওর মাথার কাছে থাকতাম। যেটাকে হ্যাপি লাইফ বলে। এটা ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে না।

(উল্লেখ্য, ৬০ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে চলতি বছরে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী সেলিমা আহমদ মারা গেছেন।)

Recent Posts

Leave a Comment