বিশে বিষ ক্ষয়

 In খোলা কলাম

প্রভাষ আমিন

বিশে বিষ ক্ষয়

আওয়ামী লীগ শুধু নয়, বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসেই সবচেয়ে বর্ণাঢ্য জাঁকজমকপূর্ণ কাউন্সিল হয়ে গেল পুরো ঢাকা, এমনকি পুরো দেশ কাঁপিয়ে। অনানুষ্ঠানিক হিসেবে কাউন্সিলের বাজেট ১০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কাউন্সিলের আগে সপ্তাহজুড়ে ঝলমলে ছিল ঢাকা। সাজ সাজ রব ছিল দেশজুড়ে।

পত্রিকার খবর অনুযায়ী এত বর্ণাঢ্য আয়োজনে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন স্বয়ং শেখ হাসিনাও। উপ-কমিটির কাছে জানতে চেয়েছিলেন খরচের উৎসও। শেখ হাসিনা রাশ টানার পরও এত আয়োজন, না টানলে কী হতো কে জানে। আলোকের ঝরনাধারা বইয়ে দেয়া অপচয় আর দুদিন মানুষের দুর্ভোগ বাদ দিলে কাউন্সিল সফলই হয়েছে।

তবে আসলে কতটা সফল হয়েছে? এই কাউন্সিল থেকে আওয়ামী লীগ বা দেশের প্রাপ্তি কী? এই প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছুদিন। আপাতত নতুন সাধারণ সম্পাদক পেয়েছে আওয়ামী লীগ। এই কাউন্সিলের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল, সাধারণ সম্পাদক পদে বদল আসবে কি না? শেষ পর্যন্ত গুঞ্জন সত্য হয়েছে। ছাত্রজীবন থেকে আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ওবায়দুল কাদের পেয়েছেন নতুন দায়িত্ব। সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক নিজেই তার উত্তরসূরী হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের নাম প্রস্তাব করে দলীয় রাজনীতিতে সৌহার্দ্যের এক নতুন বার্তা দিয়েছেন।

দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচকতার এক নতুন যাত্রা শুরু হতে পারে এই কাউন্সিল থেকে। আমন্ত্রণ পেয়েও আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে যোগ দেয়নি বিএনপি। তবে আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্বকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব। বিএনপি যোগ না দিলেও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নিয়েছেন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে। তবে আমি ইতিবাচকততা খুঁজেছি কাউন্সিলের উদ্বোধনী অধিবেশনে শেখ হাসিনার বক্তব্যে। তিনি নিজেদের উন্নয়নের কথা বলেছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন, সামনের লক্ষ্যের কথা বলেছেন। কিন্তু বিরোধী দলকে নিয়ে একটি লাইনও বলেননি। দারুণ ব্যতিক্রম। সাধারণত শেখ হাসিনার বক্তব্যের বেশিরভাগ জুড়েই থাকে বিএনপি-জামায়াত জোটকে তুলোধুনো। অপরকে গালাগালি করে সময় নষ্ট করার চেয়ে দল ও দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়াই মূল কাজ হওয়া উচিত। শেখ হাসিনা এবার সেটাই করেছেন। তাঁকে অভিনন্দন।

আওয়ামী লীগ পেয়েছে নতুন সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু দেশ কী পেলো? এ নিয়ে অনেক আলোচনা হবে। প্রাপ্তিও কম নয়। একটা বড় প্রাপ্তি হলো, শৃঙ্খলা। প্রথম দিনে প্রায় ৫০ হাজার অতিথি যোগ দিয়েছেন কাউন্সিলে। খাওয়া নিয়ে, বসা নিয়ে কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি; এটা সত্যিই ব্যতিক্রম। দলীয় পদ-পদবি নিয়েও দৃশ্যমান কোনো ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছিল না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দারুণ ঐক্যবদ্ধ মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। এখন কর্মীরা যদি এই ঐক্য, এই শৃঙ্খলার শিক্ষা নিয়ে তৃণমূলে ফিরে গিয়ে থাকেন, তাহলেই কাউন্সিলকে সত্যিকারের সফল বলা যাবে।

তবে আমি পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছি না। শেখ হাসিনা তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার প্রত্যয়ে নেতাকর্মীদের বলেছেন, সারা দেশ থেকে হতদরিদ্র মানুষ, যাদের ঘর নেই, খাবার নেই, তাদের তালিকা পাঠাতে। সরকার তাদের ঘর বানিয়ে দেবে, খাবার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু এই তালিকা করার কথা শুনেই আমার শঙ্কা। কদিন আগে সরকার হতদরিদ্রদের জন্য ১০ টাকা কেজি চাল দেয়ার এক চমৎকার উদ্যোগ নেয়। মূলত আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নেয়া অসাধারণ এই উদ্যোগ মাঠে মারা যেতে বসেছে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের লোভের ফাঁদে পড়ে। হতদরিদ্রদের তালিকায় নাম উঠে গেছে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের, তাদের স্বজনদের। তাই যে কর্মসূচি আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বড় স্লোগান, তাই এখন বুমেরাং হতে বসেছে। তাই আবার তালিকা মানেই, আরো দুর্নীতি, আরো স্বজনপ্রীতি। শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে বারবার তৃণমূল কর্মীদের কথা বলেছেন। সত্যিই আওয়ামী লীগের প্রাণ এই তৃণমূল কর্মীরা। কিন্তু এই তৃণমূল কর্মীরাই কি এখন দলের জন্য দায় হয়ে যাচ্ছেন? সমস্যাটা অন্যখানে। টানা আট বছর ক্ষমতায় থাকা এবং সংগঠনের দুয়ার খুলে দেয়ার ফলে আওয়ামী লীগে এখন অনেক আগাছার ভিড়, কচুরিপানায় আটকে যেতে বসেছে নৌকার চলা, হাইব্রিডদের আনাগোনায় আড়ালে পড়ে গেছেন তৃণমূলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। এই দলছুট হাইব্রিডরাই নৌকাকে ডোবাতে বসেছে। ক্ষমতার জৌলুসে এই সমস্যাগুলো এখন অনেকটাই আড়ালে পড়ে আছে। তলে তলে অনৈক্য আর দুর্নীতির ঘুণ যে সংগঠনের ভিত কেটে দিচ্ছে, সে খবর কি রাখেন কেন্দ্রীয় নেতারা? মন্ত্রী-এমপিরা সাধারণ মানুষ তো বটেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছ থেকেই অনেক দূরে সরে গেছেন। সবাই নিজ নিজ বলয় তৈরি করে ব্যস্ত অর্থ উপার্জনে। আওয়ামী লীগের একেকজন এমপি নিজ নিজ এলাকায় দানবে পরিণত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী নেতাকর্মীকে চিনি যারা অপেক্ষায় বসে আছেন, কবে নির্বাচন আসবে, কবে তাদের দলের এমপিকে হারাতে জান দিয়ে মাঠে নামবেন। অনেকেই চান আওয়ামী লীগ ২৯৯ আসনে জিতুক, খালি তার এলাকা ছাড়া। সব এলাকাতেই এমন ক্ষুব্ধ কর্মীরা ফুঁসছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি লাগবে না, আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগকে হারানোর জন্য যথেষ্ট।

বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিছক একটি সংগঠন নয়, একটি অনুভূতির নাম। কিন্তু এখনকার আওয়ামী লীগের সবাই কি এই অনুভূতি ধারণ করেন? করেন যে না সেটা নতুন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের গত কয়েকবছরের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে। তিনি বরাবরই ছাত্রলীগের সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, হাইব্রিডদের আনাগোনা, আত্মপ্রচারে মগ্ন নব্য আওয়ামী  লীগারদের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার। ছাত্রজীবন থেকে আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ওবায়দুল কাদের ত্যাগী আওয়ামী লীগার আর হাইব্রিড আওয়ামী লীগার সবাইকে চেনেন। এতদিন তিনি রাস্তাঘাটে ঘুরে ঘুরে অন্যায়-অবিচার সাফ করেছেন। এবার তার দায়িত্ব আওয়ামী লীগের ময়লা পরিষ্কারের। এই প্রথম ছাত্রলীগের কোনো সভাপতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেলেন। দীর্ঘদিন মাঠের রাজনীতি করে আসা ওবায়দুল কাদের মাঠে নির্যাতন সয়েছেন, কারা ভোগ করেছেন। রাজনীতির শিক্ষা নিয়েছেন পদে পদে ঠেকে ঠেকে। তাই তার দায়িত্ব অনেক বেশি। কাউন্সিলের মাধ্যমে সারা দেশে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে, ওবায়দুল কাদেরের দায়িত্ব তা ধরে রাখা এবং নির্বাচন পর্যন্ত টেনে নেয়া।

আওয়ামী লীগের এবারের কাউন্সিল দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় আনতে পারে ইতিবাচক পরিবর্তন। আগেই বলেছি ওবায়দুল কাদের মাঠের রাজনীতির মানুষ। তার নেতৃত্বে নিশ্চয়ই গণতন্ত্র আরো বিকশিত হবে। এখন সংসদে বিরোধী দল গৃহপালিত, মাঠের বিরোধী দল নিষ্ক্রিয়। একটা সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এ অবস্থা কাম্য নয়। কার্যকর বিরোধী দল না থাকলে সরকারি দলের মধ্যে এক ধরনের গা ছাড়া ভাব চলে আসে, তাদের ভুলগুলো চোখে পড়ে না। তাই দেশের স্বার্থেই সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ জরুরি।

এই কাউন্সিলের পর যদি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজেদের শুধরে নেয়, দল যদি হয় হাইব্রিডমুক্ত, দেশে যদি ফিরে আসে সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, এর ধারাবাহিকতায় যদি আগামী নির্বাচন হয় সুষ্ঠু ও সবার অংশগ্রহণমূলক; তাহলেই কাউন্সিল থেকে যে উন্নত, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের বার্তা এসেছে; তা পূর্ণতা পাবে।

আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিল থেকেই ঘটুক দল থেকে, দেশ থেকে; অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, বিভেদ, হিংসা, হানাহানির বিষমুক্তি।

প্রভাষ আমিন : সাংবাদিক, কলাম লেখক।

Recent Posts

Leave a Comment