জনগণকে উপেক্ষা!

 In খোলা কলাম

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

বিএনপি’র একজন প্রভাবশালী নেতা ফেসবুকে সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি, ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টনের সাথে বেগম জিয়ার একটি ছবি পোস্ট করে বলেছেন ইনশাল্লাহ ২০১৭-তে এমন ছবি আবার দেখা যাবে। তার অর্থ হলো হিলারি ক্লিন্টন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলে এবছর শেষ হলেই বিএনপি ক্ষমতায় চলে আসবে।

২০১৭-তে কোনো সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা দেশে? কাগজে কলমে নেই। বর্তমান সংসদের পূর্ণ মেয়াদ শেষ হলে নির্বাচন হবে ২০১৯-এ। আগে হতে পারে যদি সরকার চায় আগাম নির্বাচন। সেরকম কোনো সম্ভাবনা আপাতত: দেখা যাচ্ছেনা রাজনৈতিক আকাশে। আরেকটা হতে পারে যদি বিএনপি এমন কোনো গণআন্দোলন গড়ে তুলে যাতে করে শেখ হাসিনার সরকার বাধ্য হয় নির্বাচন দিতে। কিন্তু বিএনপি’র আন্দোলন করার ইচ্ছা বা সামর্থ্য দুটো নিয়েই প্রশ্ন আছে। আর সেই প্রশ্ন দলটি নিজেই জন্ম দিচ্ছে বারবার।

তবে যে নেতার কথা বলছি, তার ফেসবুক বার্তা অন্যরকম সংকেত দেয়। বিএনপি’র সাথে যুক্ত বা এই দলকে সমর্থন করে তারা প্রায় ধরেই নিয়েছেন যে, হিলারি ক্লিন্টন জয়ী হলে তারা ক্ষমতায় আসবেন। একটি সহজ সমীকরণ হলো হিলারির সাথে সখ্য আছে শান্তিতে নোবেল পাওয়া ড. ইউনুসের। এই সরকারের সাথে যেহেতু ইউনুসের বৈরীতা চরমে পৌঁছেছে, তাই ইউনুস হিলারিকে দিয়ে প্রতিশোধ নিবেন এবং দল হিসেবে তার ফায়দা পাবে বিএনপি। এরকম একটা আগাম আনন্দ যজ্ঞ বিএনপি’তে দেখা গিয়েছিল ২০১৪-এর ভারতের লোকসভা নির্বাচনের সময়ও। কংগ্রেসের সাথে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক সম্পর্ক। ক্ষমতায় নরেন্দ্র মোদির বিজেপি এলে এই সখ্য থাকবেনা। এর রাজনৈতিক সুবিধা পাবে বিএনপি। আগাম উল্লাসের পাশাপাশি বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ’র সাথে বিএনপি চেয়ারপরসনের ফোনালাপের গল্প চাউড় করে দেওয়া হয়। সেটি আবার ভারতীয় সরকার ও বিজেপি তরফ থেকে, স্বয়ং অমিত শাহ’র অস্বীকারের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত এক মহাকেলেংকারীতে পরিণত হয়।

পুরো বিষয়টিতে কেমন যেন খটকা লাগে, বিএনপি তাহলে জনগণের মাধ্যমে নয়, বাইরের শক্তির সহায়তায় ক্ষমতা নিতে চায়? দেশের সরকারি ক্ষমতা পাওয়া যে কোনো রাজনৈতিক দলের কাছেই লোভনীয়। সেটা নিরক্ষর ভোটদাতার বুঝতে অসুবিধে নেই। বাংলাদেশের রাজনীতির চরিত্র হলো, দলসমূহ আর নেতারা মানুষকে বুঝতে চেষ্টা করেন খুব কম। ডান, বাম বা মধ্যপন্থি কারো ভেতরেই ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে পদ্ধতিগত কোনো মৌলিক ফারাক নেই। সমান হিংস্রতা নিয়ে তারা সবাই অবতীর্ণ হয়। মানুষ তার অসহায় ফলভোগী। কোন সমস্যাগুলিকে তারা প্রাধান্য দেবেন, এমনকি তাদের সমস্যাগুলি ঠিক কী, সেটাও ঠিক করে রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দলই স্থির করে জনগণ কোন কোন সমস্যা নিয়ে ভাববেন বা ভাববেন না। রাজনীতিতে এই বধিরতা এখন এতো বাড়লো যে, নেতারা এখন ভাবেন জনগণ নয়, বিদেশি শক্তি তাদের ক্ষমতা হাতে তুলে দেবে।

এই ভাবনার জোরে, তাদের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ৭ নভেম্বরেও যখন সরকার সমাবেশ করতে অনুমতি দেয়না বিএনপি বিবৃতি দেওয়া ছাড়া প্রতিবাদ করেনা। পরিস্থিতি দেখলে মনে হয় এই দল ক্ষুব্ধতাতো দূরের কথা, এদের অভিমানও হয়না। জনসাধারণের আস্থা অর্জনের জন্য সামান্য প্রচেষ্টাও লক্ষ্য করা যায়নি। বরং দেখা গেলো সরকার বিরোধিতার নামে মাসের পর মাস পেট্রোল বোমায় জনগণকে পুড়ানো হয়েছে, দরিদ্র মানুষকে সর্বশান্ত করা হয়েছে। যেন দোষ শুধুই মানুষের।

শহরকেন্দ্রিক রাজনীতিতে কেবল শ্লোগানের তাণ্ডব। রাজনৈতিক দলগুলির বানানো নিজস্ব কিছু সমস্যা নিয়ে হইচই। কোথাও ‘বাংলাদেশ’ নেই, নেই তার প্রতিনিধিত্ব। প্রতিদিন নদী ছিনতাই হয়, নারী আর শিশু লাঞ্ছিত হয়, আগ্রাসী দখলদারদের জমি দখলের উৎসব, আদিবাসী আর ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন কিছুই তাদের স্পর্শ করেনা। যেটুকু তারা বলে সেটুকু শুধু টেলিভিশনের পর্দায় গলাবাজি করার জন্য। মানুষের এমনসব প্রয়োজনে যারা নেই তারা মনুষকে পাত্তাইবা দেবে কেন? মানবাধিকার আন্দোলনকে যদি রাজনীতির মূল ধারায় লড়াইয়ে নামতে হয়, সেটা ঠিক কেমনভাবে সম্ভব হবে, তা কোনো দলই বলতে পারবে বলে মনে হয়না।

‘আমরা ক্ষমতায় গেলে দেখে নেব’ প্রতিশোধের এমন স্পৃহা ছাড়া কোনো রাজনীতি নেই আজ। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে এদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় জিগির তুলে সমাজকে বিভক্ত করার প্রয়াস স্পষ্ট। আমাদের দেশের সামাজিক কাঠামো বহুসংস্কৃতি ধন্য হলেও ভোটে জেতার জন্য সবাই মিলে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করছে। নতুন নতুন প্রজন্ম আসছে, জেনারেশন এক্স থেকে ওয়াই। তারা চাইছে উন্নয়ন, শিল্পায়ন, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ, আরও পড়াশোনার সুযোগ, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, মূল্যবৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণ আর নাগরিক অধিকারের নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ। সেই রাজনীতি কোথায়?

আমাদের রাজনীতির বড় চরিত্র সংঘাত আর সহিংসতা। সরকারকে টেনে নামানোর জন্য কত হিংসার পথেই না চলে বিরোধী রাজনীতি। ২০১৪ এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগ থেকেই এদেশে যেভাবে সহিংসতা হয়েছে আন্দোলনের নামে সেটা কোনোভাবেই রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিলনা, যেন ছিল দেশ আর মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। কিন্তু সাফল্য আসেনি। আসলে সহিংসতায় কোনো সমস্যারই স্থায়ী সমাধান হয় না। অসহিষ্ণুতা হিংসার জন্ম দিবে ঠিকই, কিন্তু সেই হিংসা ক্ষমতা হাতে তুলে দিবেনা।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন সবচেয়ে বেশি সংকটের মধ্যে আছে বিএনপি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে দু’টি বড় ভুল করেছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সাথে সাক্ষাৎ না করা এবং আলোচনার আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে টেলিফোন করেছিলেন সেখানে সাড়া না দেওয়া ছিল বড় ভুল। এরপর আর বের হতে পারেনি সেই ভুলের ঘেরাটোপ থেকে।

মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের হাত ধরাধরির নীতি অবলম্বন করে চলা বিএনপির নেতৃত্ব রাস্তায় নামতে অনীহ। অনেকগুলো জাতীয় ইস্যুতেই বিএনপি দীর্ঘদিন কোনো কর্মসূচি পালন করেনি। বর্তমান রাজনীতি, তরুণ প্রজন্মের মনোভাব ও আন্তর্জাতিকভাবে রাজনীতির যে মেরুকরণ ঘটছে সেই বিষয়গুলো অনুধাবন কতটা করতে পেরেছে তা কেবল তারাই বলতে পারবেন।

নতুন প্রজন্মের মধ্যে একাত্তরের চেতনায় জাগরণ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলন, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দেশে একটি নতুন আবহ তৈরি করেছে। সেই আবহে ধীরলয়ে হলেও আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের ধারায় নিজেকে রাখার জন্য সচেষ্ট। যদিও সমলোচনা আছে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে নিয়েই। কিন্তু ভোটের রাজনীতির অন্ধ মোহে বিএনপি মুখ ঘুরিয়ে পেছনে ছুটছে। ফলে একটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপির বিকশিত হওয়ার যে সুযোগ ছিল, তা ক্রমেই হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এই পশ্চাদমুখিতা বিএনপির অস্তিত্বের জন্যও বড় হুমকি। বিএনপি’র রাজনীতি কবে অসাম্প্রদায়িক-উদারনৈতিক পথে হাঁটবে তাই দেখার অপেক্ষায়। অপেক্ষা আরো যে, জামায়াত-হেফাজত ছেড়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পথে অগ্রসর হবে, না জামায়াত-হেফাজতকে নিয়ে সহিংসতার আগুন জ্বালাতে থাকবে দলটি।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি।

Recent Posts

Leave a Comment