আমার পিতা আমার অহঙ্কার : মোহাম্মদ নাসিম

 In খোলা কলাম

শহীদ এম মনসুর আলী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম মহানায়ক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে চার জাতীয় নেতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের অন্যতম এম মনসুর আলী। তিনি আমার গর্বিত পিতা এবং সবসময় সবমুহূর্তে আদর্শিক নেতা। যখনই কোনো কাজ করি, চিন্তা করি, আমার চিন্তা-চেতনায় সবসময় আমার পিতার স্পর্শ আর আবেগ অনুভব করি। তিনি যেমন জীবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন, মরণেও আজ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই আছেন। আমার পিতা তার পরিবারের বাইরে প্রতিটি মুহূর্ত বঙ্গবন্ধুর কথা ভাবতেন, বঙ্গবন্ধুর কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধু ছাড়া যেন তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। মাঝেমধ্যে আমার মনে হতো তিনি যেন আমাদের চেয়ে বঙ্গবন্ধুকে বেশি ভালবাসতেন। তিনি যখন রাজনৈতিকজীবন শুরু করেছেন, ওই মুহূর্ত থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছাড়া তার রাজনৈতিক কর্মকা-ের কোনো কিছু করারই চিন্তা করতেন না। আমি তার সন্তান হিসেবে দেখেছি, ৬ দফার আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অনেক সহকর্মী যখন তাকে ত্যাগ করে চলে গেছেন, কারাবন্দি অবস্থা থেকেও আমার পিতা মনসুর আলী শত প্রলোভন ও চাপের মুখেও তখনকার পিডিএমপন্থি আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান, সালাম খানদের সঙ্গে যোগদান করেননি। দীর্ঘ কারাজীবন ভোগ করেছেন। কিন্তু নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে বেইমানি করেননি। আমার পিতার দৃঢ় অভিব্যক্তি ও মনোভাবকে দেখেছি, ১৯৬৬-৬৭ সালে যখন এম মনসুর আলী পাবনা কারাগারে বন্দি ছিলেন, আমিও ছাত্রাবস্থায় পিতার সঙ্গে ওই মুহূর্তে একই কারাগারে আটক ছিলাম। দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম শেষে যখন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানে কারাগারে বন্দি, তখন আমার পিতাসহ জাতীয় চার নেতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে মুজিবনগর সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দেন। ওই দুঃসাহসিক ও গৌরবময় মুহূর্তগুলো দেখা বা জানার সুযোগ আমার হয়েছে। আমি দেখেছি, ওই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোয় এম মনসুর আলী কী দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ মনোভাব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিনিয়ে আনতে ও জীবিত বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার জন্য অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং কাজ করে গেছেন। খোন্দকার মোশতাকের মতো এক সুযোগসন্ধানী বিশ্বাসঘাতক ওই প্রবাসী মুজিবনগর সরকারে প্রতিমুহূর্তে চেষ্টা করেছে ওই চার জনের মধ্যে ফাটল ধরানো এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করার নানারকম প্রলোভনের জাল বিস্তার করে মুজিবনগর নেতৃত্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য। কিন্তু একটি বিপদগ্রস্ত এবং জাতির যুগসন্ধিক্ষণে শহীদ এম মনসুর আলী অন্য তিন নেতার সঙ্গে থেকে সব ভয়ভীতি, অনিশ্চয়তা ও প্রলোভন উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধকে সফল করেছেন। সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আমার পিতা মনসুর আলী ওই কয় মাস অনন্য সাধারণ জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে মুজিবনগরের রণাঙ্গনে ছুটে বেড়িয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকেছেন, সাহস দিয়েছেন। প্রবাসী সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দলীয় শত-শত সহকর্মী, দেশ থেকে পালিয়ে আসা হাজার হাজার কর্মীকে আর্থিক সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। আমি দেখেছি, হাজার অনিশ্চয়তা ও অমানিশার মধ্যে সাধারণ বাঙালির চেয়েও দীর্ঘদেহী আমার পিতার উজ্জ্বল প্রত্যয়দীপ্ত মুখচ্ছবি। তিনি সর্বদা বলতেন, বাঙালিদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী ও জীবিত বঙ্গবন্ধুকে আমরা ইনশাল্লাহ মুক্ত করব। আসলে জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে মুজিবনগরে যে মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব সংগঠিত হয়েছিল, তা নিয়ে একটি মহাকাব্য রচনা করা যেতে পারে।

একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামো গড়ে তোলা, চট্টগ্রাম ও খুলনা পোর্ট পুনরায় চালু করে কার্যকর বন্দরে পরিণত করা, সর্বোপরি এক নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, স্বাধীনতাবিরোধী এবং তথাকথিত হঠকারী বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী নামধারীদের অপতৎপরতা রোধ করে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা করা ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ। তবু তিনি দক্ষতার সঙ্গে সেসবের মোকাবিলা করেছেন। আমার পিতাকে চিরদিনের জন্য হারানোর আগে মাত্র কয়েক ঘণ্টা তার সঙ্গে ছিলামÑ ১৫ আগস্টের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। ওই সময় তাকে দেখেছি কী উদ্বেগ ও প্রচ- বেদনা নিয়ে একদিকে বঙ্গবন্ধুকে হারানোর কথা মনে করেছেন, অন্যদিকে প্রতিশোধ এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে দলীয় সহকর্মী ও তদানীন্তন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন।

এম মনসুর আলী আত্মগোপন অবস্থাতেও চেষ্টা করেছেন নানাভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। কতিপয় সহকর্মীর ভীরুতা, আপসকামিতা এবং জীবন রক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টা, অন্যদিকে তখনকার সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্বের চরম ব্যর্থতা, চরম কাপুরুষতার কারণে তিনি ভীষণভাবে ব্যর্থ ও হতাশ হয়েছিলেন। কিছু করতে না পারার বেদনায় তার অশ্রুসিক্ত চেহারা দেখেছিলাম। একটা জিনিস ধ্রুবতারার মতো সত্য, তিনি জীবন দেবেন; কিন্তু অন্য অনেকের মতো বিশ্বাসঘাতকতা করে খোন্দকার মোশতাকের হাতে হাত মেলাবেন নাÑ ওই দৃঢ় প্রত্যয় তার মধ্যে দেখেছি। এ কারণে তিনি মাথা উঁচু করে বলিষ্ঠকণ্ঠে বিশ্বাসঘাতক মোশতাকের মুখের ওপর বলেছিলেন, ‘তোমার মতো বেইমানের সঙ্গে আমি হাত মেলাব না। জীবন দেব, প্রধানমন্ত্রী হবো না।’ তিনি তার কথা রেখেছিলেন।

এম মনসুর আলী আপস করেননি, আত্মসমর্পণ করেননি, জীবনের ভয়ে মাথা নত করেননি। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দি অবস্থায় ঘাতকের হাতে জীবন দিয়েছেন তিনি। ১৫ আগস্টের পর বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক বিশ্বাসঘাতক-কাপুরুষের জš§ হলেও মৃত্যুঞ্জয়ী চার নেতার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরদিন। যারা জীবন দিয়েছেন, জাতির জনকের সঙ্গে বেইমানি করেননিÑ তাদের মধ্যে একজন আমার পিতা শহীদ এম মনুসর আলী, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পরিচয়, আমার পিতা শহীদ এম মনসুর আলী। তাকে আমি হারিয়েছি। এর চেয়ে বড় বেদনা, বড় কষ্ট আমার জীবনে আর কিছু নেই। কিন্তু আমার জীবনে সবচেয়ে বড় গর্ব ও অহঙ্কার হলো, আমি খোন্দকার মোশতাকের মতো কোনো বেইমানের সন্তান নইÑ শহীদ এম মনসুর আলীর মতো একজন সাহসী মৃত্যুঞ্জয়ী পিতার সন্তান।

নেতা বা নেতার আদর্শের সঙ্গে বেইমানি নয়, বিশ্বাসঘাতকতা নয়, কোনো আপসকামিতা নয়, আমার শহীদ পিতার ওই আদর্শ ধরেই কাজ করছি, কাজ করে যাবÑ ৩ নভেম্বর শহীদ পিতার প্রতি এটিই আমার প্রত্যয়দীপ্ত শ্রদ্ধা।

 

* মোহাম্মদ নাসিম : এমপি, মন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য

Recent Posts

Leave a Comment