খালেদার প্রস্তাবনা নাকচ করা সঙ্গত কি : মুজতবা খন্দকার

 In খোলা কলাম

খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না গিয়ে ভুল করেছেন। গত তিন বছর ধরে বহু মানুষ, বহু গণমাধ্যম ক্রমাগত এটা বলে খালেদা জিয়াকে তার রাজনৈতিক ভুল ধরিয়ে দিতে পেরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন। সবশেষ সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হকও সেদিন প্রথম আলোর কাছে সেটাই বললেন। আমি অবাক হয়েছি আমার শ্রদ্ধাভাজন বর্ষীয়ান এই আইনজীবীর এই মন্তব্যে।

রফিক উল হক আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন। মঈন, ফখরুদ্দিনেরর জরুরি সরকারের সময়ে নানা কারণে তাকে কাছাকাছি থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। আমার মনে পড়ে। গণমাধ্যমের চোখ এড়িয়ে তিনি আইন পেশায় নিজেকে ব্রত রেখেছেন পাঁচ দশক ধরে। ছিলেন এরশাদের অ্যাটর্নি জেনারেল। এক সময় পদত্যাগও করেন। ২০০৫ সালে যখন টালমাটাল অবস্থা তখন এক প্রকার জোর করে তার একটি ইন্টারভিউ আমি করেছিলাম। আমার প্রথম প্রশ্ন ছিলো তার কাছে- এই সরকারের প্রস্থান কীভাবে হবে? তিনি আমাকে উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, টুথপেস্টের টিউব থেকে পেস্ট বের করলে তা কি ফের ঢুকানো যায়? যায় না। তেমনি সেনাবাহিনীকে ব্যারাক থেকে বের করলে তাদের আর ব্যারাকে ঢুকানো যায় না। ব্যারিস্টার হক এরশাদকে ইঙ্গিত করে কথাটি বলেছিলেন। তিনি বাস্তবতা মেনে কথাটি বলেছিলেন বলে তখন আমার মনে হয়নি। কারণ এরশাদের ক্ষমতা দখলের সময় ছিলো নব্বইয়ের দশকে। কিন্তু মঈনের জরুরি সরকারের সময় ছিলো একবিংশ শতাব্দিতে। এরশাদ সরাসরি রাজসিংহাসন অপদখল করেছিলেন, নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে। মঈন এরশাদের চেয়ে ভীরু। তিনি নিজে ক্ষমতা দখল না করে পুতুল সরকার বসিয়ে নেপথ্যে রাজ্যপট চালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেননি। একটি নির্বাচন দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর নানা রকম শর্ত দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেশ ছেড়েছেন, তার সাঙ্গাত ফখরুদ্দিনসহ..। অবৈধ শাসন প্রলম্বিত করার সাহস করেননি।

ব্যারিস্টার হকের সেই টুথপেস্ট তত্ত্ব এখানে ব্যর্থ হয়েছিলো।  সুতরাং সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই আইনজীবীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলি, বেগম জিয়া পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনে না গিয়ে কিছুমাত্র ভুল করেননি, বরং তিনি যে সঠিক ছিলেন, ওই হাস্যকর নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যতে সেটা স্পষ্ট হয়েছিলো। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন ছিলো সংবিধান রক্ষার নির্বাচন। শিগগিরই আরো একটি নির্বাচন হবে। খোদ সরকার প্রধানের এমন বক্তব্যের পর, আমরা কি কেউ বলতে পারি অথবা আমাদের কারো কি কোনো দ্বিধা থাকার কথা যে বেগম জিয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো? বহির্বিশ্বেও কি ধরনের বৈধতার সঙ্কটে পড়েছিল পাঁচ জানুয়ারির সরকার সেটাও আমাদের ভোলার কোনো কারণ নেই। কিন্তু নিজের সরকারকে টিকিয়ে রাখতে এবং দেশ-বিদেশে বৈধতার সনদ নিতে সরকারকে কি না করতে হয়েছে। দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে হয়েছে।  নামমাত্র ফিতে ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া, ভারতের স্বার্থে নিজেদের অপরিমেয় ক্ষতি জেনেও ইউনেস্কোর সতর্কতা উপেক্ষা করে কেবলমাত্র ভারতের স্বার্থে সুন্দরবনে বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের ধনুকভাঙা পণ করেছে সরকার। শুধু কি তাই! পাবনার কাছে আত্মঘাতী রুপপুরে রাশিয়াকে দিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে কোনো রকম সতর্কতাও আমলে নিচ্ছেন না। সবার আশঙ্কাকে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে এসব করছে সরকার। কোনো জনগণের সরকারের পক্ষে দেশের জনগণের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে এমন প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব কিনা তা এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দুই.
যাকে দেখতে নারী তার চলন বাঁকা। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে অনেকগুলো ইতিবাচক দিক থাকলেও ইনিয়ে বিনিয়ে সেটার সাথে জামাতকে আনার চেষ্টা করে, কেউ কেউ, কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যম আবার খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। অথচ খালেদা জিয়ার বক্তব্যের কোথাও জামাত প্রসঙ্গ নেই। তিনি তার বক্তব্যে  বলেছিলেন, স্বাধীনতার পর সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। স্বাধীনতার পর, জামাত ছাড়াও তো আরো বহু দলের সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিলো… তাহলে শুধু জামাতকে টেনে এনে কেন, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনাকে হেয় করা হচ্ছে আমার বোধগম্য নয়। সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন, সুজনের পক্ষ থেকেও খালেদা জিয়ার প্রস্তাবকে ইতিবাচক ধরে আলোচনার কথা বলা হয়েছে… কিন্তু সেদিকে না গিয়ে বলা হচ্ছে খালেদা জিয়া জামাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন তার প্রস্তাবে। আমাদের নির্বাচন কমিশন যে অথর্ব, অকাল কুষ্মাণ্ড, মেরুদণ্ডহীন, সেটা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে! সেটা সবাই জানে। সুতরাং আমাদের একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন দরকার, সেটা তো সত্য। সুতরাং খালেদা জিয়ার প্রস্তাবনা সবই মানতে হবে, সেটা তো কেউ বলেনি। খালেদা জিয়া আলোচনার একটি পথ দিয়েছেন, সুতরাং তাকে শুরুতেই নাকচ করা কতখানি সঙ্গত? আমার বোধে আসে না। কিন্তু সেটাকে পজেটিভ প্রস্তাব ধরে আলোচনা চালিয়ে গেলে সমস্যা কোথায়? গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে চিল্লাবো, অথচ বিরোধী দলকে কোনো স্পেস দেবো না, তাদের সাথে আলোচনায় বসবো না.. এটা কেমনতর গণতন্ত্রের কথা!

আমরা আমাদের, সুশীল গোষ্ঠী অপটিমিস্টিক হতে ভুলে গেছি। আমরা প্যাসিমিস্টিক জাতিতে পরিণত হচ্ছি, মানি না মানবো না সংস্কৃতিতে আমাদের প্রজন্মকে উস্কে দিচ্ছি। আমরা আশাবাদী হতে যেমন চাইছি না, তেমন উত্তর প্রজন্মকেও সেদিকে ধাবিত করছি।

গ্লাসের অর্ধেক খালি আমরা বলতে শিখছি, শেখাচ্ছি, কিন্তু গ্লাসটির অর্ধেক ভরা সেটা আমরা বেমালুম ভুলে থাকছি…

আশাবাদী হতে শেখানো একটি উন্নত জাতির বৈশিষ্ট্য! কিন্তু কেন জানি জিডিপি বাড়লেও, শণৈ: শণৈ: আমাদের দেশের উন্নতি হলেও, মানসিকতায় আমরা এখনো সেকেলেই রয়ে গেছি! দুর্ভাগ্য আমাদের।

তিন.
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নির্বাচন সংক্রান্ত মনোনয়ন বোর্ডকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদটা এই জন্য যে অনেক স্মৃতি, আর শামসুজ্জোহার উত্তরসুরিদের আবেগ উপেক্ষা করে অবশেষে বোর্ড আলী আহমদ চুনকার উত্তরসুরির পাশে দাঁড়িয়েছে। মানে সেলিনা হায়াৎ আইভীর পাশে দাঁড়িয়েছে। আইভীও যে গত পাঁচ বছরে নারায়ণগঞ্জের সিটি মেয়র হিসেবে সফল তা বলা যাবে না। তবে ওসমান পরিবারের কুখ্যাত অপশাসন তো নারায়ণগঞ্জবাসীকে সহ্য করতে হয়নি সেটাই ঢের তাদের জন্য।

এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন বিএনপি কি এই নির্বাচনে যাবে? কথায় আছে নেড়ে কতবার বেলতলায় যায়? এর আগে একবার এই নির্বাচনে গিয়ে মধ্যরাতে তাদের প্রার্থী প্রত্যাহারের নাটক তো দেখেছি আমরা। সুতরাং  বিএনপি কি নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন নিয়ে নতুন করে শেক্সপিয়ারের কোন নাটক মঞ্চস্থ করতে চায়… সেটাই এখন দেখার বিষয়!

মুজতবা খন্দকার : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

Recent Posts

Leave a Comment