ট্রাম্পের আমেরিকায় গৃহবিবাদ

 In জাতীয়, দেশের বাইরে

 

ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় বদহজম হতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে। জনগণ তাদের প্রথাগত গণতন্ত্রের রূপরেখায় একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছে ঠিকই, তবে সমগ্র দেশের জনপ্রিয় ভোটে এগিয়ে হিলারি ক্লিনটন। তাই হিলারি আর বার্নি স্যান্ডার্সের সমর্থকেরা ক্ষোভে-বিক্ষোভে মাতিয়ে তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরগুলি, যা সাম্প্রতিক ইতিহাসে একদমই বিরল।

নিউইয়র্কের ট্রাম্প টাওয়ারের সামনে এবং ইউনিয়ন স্কয়ারের সামনে বুধবার সন্ধ্যার আগে হাজার হাজার মানুষ, ‘আমার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নয়’ বলে স্লোগান দিতে থাকে। যদিও, ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভেদ আর বিদ্বেষ ছড়িয়ে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হ্ওয়ার পর প্রথম ভাষণে বলেছেন, ‘আমাদের দেশ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বিভক্ত।’ এখন এই বিভক্ত দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজটিই হবে তার অগ্রাধিকার কাজ। সে সবার প্রেসিডেন্ট হতে কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন। তবে তার বক্তব্যে আস্থা কম মানুষের আর প্রতিবাদকারীদের।এই বিভক্তির রেখা বেশ স্পষ্ট হতে থাকে নির্বাচনের আগে থেকেই। তাই এ নিয়ে নির্বাচনের রাতেই হিলারি আর প্রেসিডেন্ট ওবামার মধ্যকার কথোপকথনে এই বিষয়গুলি আলোচনায় এসেছে বলে জানান তিনটি পক্ষই।  ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়কে মেনে নিয়ে তাকে হিলারি কর্তৃক স্বাগত জানানোর পর অপেক্ষমান ভোটার আর সমর্থকদের সামনে আসেন নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। রাত আড়াইটার দিকে নিউইয়র্কে আয়োজিত তার বিজয়ী মঞ্চে এসে ট্রাম্প বলেন, ‘হিলারি আমাকে ফোন দিয়েছিল এবং কথা হয়েছে আমাদের মধ্যে।’ এ সময় যে বিশাল নির্বাচনী প্রচারণা হিলারি ক্লিনটন দেখিয়েছেন এবং কঠোর পরিশ্রম করেছেন তার জন্য তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ট্রাম্প বলেন, আমি ভেতর থেকে বিশ্বাস করি সে তার পুরো জীবনে মানুষের জন্য এবং আমেরিকার জন্য কাজ করেছেন।

এদিকে, নির্বাচনী ফলাফল মেনে নিয়ে সকাল সাড়ে ১০টায় নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে কর্মী সমর্থক এবং ভোটারদের সামনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে হিলারি বলেন, অবশ্যই আমাদের নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প সকল আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট হবেন বলে আশা প্রকাশ করে হিলারি বলেন, একটা নির্বাচনই সব নয়। যেসব মূল্যবোধ আর নীতি নৈতিকতা নিয়ে আমরা আন্দোলন চালিয়েছিলাম সেগুলিকে এগিয়ে নিতে হবে। এ সময় প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও জয়ী না হতে পারায় সকলের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন হিলারি। বলেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই স্বপ্ন হয়তো অন্য কেউ পূরণ করবে। এ সময় আমেরিকাকে ঐক্যবদ্ধ করতে সবার ভূমিকা প্রত্যাশা করেন হিলারি ক্লিনটন।

এর আগে রাত সাড়ে ৩টার দিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নির্বাচনী ফলাফলের ভিত্তিতে আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বাগত জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। হোয়াইট হাউসে এ সম্পর্কিত একটি ব্রিফিংয়ে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেন, আমি তাকে আগামী বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসে সপরিবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, কীভাবে তার হাতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারি তা নিয়ে আলোচনা করবো। এ সময় ওবামা বলেন, ‘হিলারির সাথেও আমার কথা হয়েছে এবং এখন হিলারি আর আমরা মিলে কীভাবে আমেরিকাকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করতে পারি সেটা নিয়েই কাজ করছে আমার প্রশাসন।

‘নীরব ভোটাররা, আমেরিকার ভবিষ্যত নিয়ে আর নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে শঙ্কায় থাকা গ্রামের সাদা ভোটারদের ভোট বিপ্লবে ট্রাম্প এই জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন বলেই বলছে বিশ্লেষণগুলি। আর সেটা স্বীকার করছেন রিপাবলিকান দলে ট্রাম্পের কট্টরবিরোধী মানুষগুলোও।’

‘ডোনাল্ড ট্রাম্প তার জয়কে নিজ হাতেই তৈরি করেছেন, শুধুমাত্র আমেরিকার জনগণের প্রকৃত ক্ষোভ আর চাহিদা অনুযায়ী কাজ করেছেন। এখন ট্রাম্পের এই জয়ের জন্যেই সিনেট আর কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন হয়েছে’ বলে স্বীকার করে নিয়ে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে ট্রাম্পের নেতৃত্ব প্রত্যাশা করেছেন রিপাবলিকান হাউস স্পিকার পল রায়ান। যার সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্পর্ক সাপে-নেউলের মতো। রিপাবলিকান দলের শীর্ষ এই নেতা নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত প্রকাশ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনে কাজ করেননি। এমনকি ট্রাম্পের কারণে হাউস এবং সিনেটে রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠতা কমে যাবে বলে বার বার শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

ট্রাম্পের এই জয় যেমন কল্পনার বাইরে, তেমনি ট্রাম্প নির্বাচিত না হতে পারলে তার ভোটাররা বিদ্রোহ করতে পারেন বলে প্রস্তুতি ছিল বিশ্লেষক মহলে। তবে ট্রাম্প জয়ী হলে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়বে এমন কোনো ধারণা ছিল না বেশিরভাগ মানুষের। ট্রাম্পের পরাজয় নিয়ে বিভক্তির যে শঙ্কা ছিল, এখন তার জয়ে সেই বিভক্তির প্রকাশ বেশ স্পষ্ট হ্ওয়াতে আরেকটি সিভিল ওয়ার বা জনযুদ্ধের শঙ্কা জোরালো হচ্ছে অনেক আলোচনায়।

আফ্রিকান আমেরিকান বিশ্লেষক ভ্যান জোন সিএনএন-এর সাথে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে এক আলোচনায় আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেছেন, আমি আমার বাচ্চার সাথে সকালে নাস্তার টেবিলে বসে নাস্তা খাব কিভাবে। সারাজীবন আমি তাকে শিখিয়েছি যে মানুষকে ব্যঙ্গ করা খারাপ। এখন এমন একজন চরিত্র যে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের ব্যঙ্গ করেন, নারীদেরকে ভোগ্যপণ্য মনে করেন তিনি আমাদের প্রেসিডেন্ট!

কান্না জড়িত কন্ঠে এই কথাগুলি বলার সময় তিনি বলেন, আমরা অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি, ইন্টারনেটে জয় পরাজয় নিয়ে কথা হচ্ছে। তবে যে কথা আমরা বলছি না সেটা হলো, ‘এটা একটা সাদা মানুষের চপেটাঘাত’, যা করা হয়েছে একজন কালো প্রেসিডেন্টকে মেনে না নিতে পেরে। ‘এটার পরিণতি ভয়ঙ্কর’।

কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে এই বিক্ষোভ সেটি বলা যাচ্ছে না এখনই। ‘ব্লাক লাইভ ম্যাটারস’ নামক একটি সুপ্ত আন্দোলন চলছে আমেরিকায় অনেক দিন ধরে। তাদের গুপ্ত হামলায় অনেক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন সম্প্রতি কয়েকটি শহরে। টেক্সাক, মিনোসোটা, শিকাগো এবং অন্য জায়গায়। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা কট্টর সাদা জাতীয়তাবাদী নেতারা ট্রাম্পের প্রশাসনে ঢুকলে এর প্রতিবাদ আরো জোরালো হবে।

নিউইয়র্কে অভিবাসীবিরোধী এবং কালো মানুষের নির্যাতনকারী হিসেবে বেশ খ্যাতি রয়েছে সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানির। ঘোষণা এসেছে তিনি এরই মধ্যে আইনমন্ত্রী (এটর্নি জেনারেল) এর পদবী নিশ্চিত করেছেন। তার হাতে থাকবে পুলিশ, অভিবাসন, সন্ত্রাসদমন, ন্যায়বিচার বিভাগ। বোঝাই যাচ্ছে কোন পথে হাটছে ট্রাম্পের সরকার। এখন দেখার বিষয় বাকি দিনগুলিতে ট্রাম্পের রোলার কোস্টার চলে, নাকি প্রতিবাদের আগুনে পিছু হটে ট্রাম্প সরকার।

নির্বাচনী প্রচারণার সময় যতগুলো বিষয়কে পরিবর্তনের এজেন্ডা বানিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, তার সবগুলোই ছিল প্রচলিত রীতিনীতি আর প্রথার বাইরে। ধারাবাহিক প্রচারাণায় সেসব বিষয়ে বক্তব্য দিলেও, নির্বাচনের একবারে আগে স্পষ্ট করে প্রথম ১০০ দিনের মধ্যেই কিছু কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। পেনসিলভানিয়ার গেটিসবাগের প্রচারাভিযানে যেসব বিষয়কে অগ্রাধিকার দেবেন বলে জানিয়েছিলেন তা হচ্ছে-

১. যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০ লাখের বেশি অপরাধী ও অবৈধ অভিবাসীকে বিতাড়িত করার প্রক্রিয়া শুরু করা। ২. যেসব দেশের সরকার তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানাবে তাদের ভিসা-মুক্ত ভ্রমণ সুবিধা বাতিল করা। ৩. বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সব ধরনের নির্বাহী আদেশ রদ করা। হোয়াইট হাউজের কর্মকর্তাদের লবিংয়ের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা। ৪. কংগ্রেস সদস্যদের দায়িত্বে থাকার মেয়াদ কমিয়ে আনা। ৪. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জাতিসংঘের নেওয়া প্রকল্পগুলোতে অর্থ দেওয়া বন্ধ করা। ওই অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের অবকাঠামোগত সংস্কারে কাজে লাগানো। ৫. চীনকে ‘কারেন্সি ম্যানিপুলেটর’ দেশ ঘোষণা করা ইত্যাদি।

যুক্তরাষ্ট্রের মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল বা নির্মাণ এবং নির্মাণ খরচ মেক্সিকো সরকারের কাছ থেকে আদায়ের কথা নির্বাচনী প্রচারের শেষদিন পর্যন্ত বলে এসেছেন ট্রাম্প। জয়ের পর এ বিষয়ে নিজের সমর্থকদের পুনরায় আশ্বস্ত করেছেন ট্রাম্প। কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে ‘নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড’ চুক্তি নিয়ে ট্রাম্প নতুন করে আলোচনা শুরু করতে পারেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে। তবে নির্বাচনে জয়ের পর তার বিজয়ী ভাষণে ট্রাম্প আর্ন্তজাতিক বিশ্বকে ভীতসন্তস্ত্র না হতে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, উভয়ের স্বার্থকে বজায় রেখেই কাজ করবেন তিনি।

এ সবই শপথ গ্রহণের পর নিজের নির্বাহী ক্ষমতা বলে করতে পারবেন ট্রাম্প। পেনসিলভেনিয়ার ভাষণে তিনি এসব কাজ বাস্তবায়নের জন্য তাকে নির্বাচিত করা ছাড়াও সিনেট এবং কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে রিপাবলিকান সব ব্যালটে ভোট দিতে বলেছিলেন। ভোটারা সেটাই করেছে, অর্থাৎ সিনেট, কংগ্রেস এবং হোয়াইট হাউস সবখানে রিপাবলিকানদের দখলে এসেছে। এসব প্রতিশ্রুতি পালনে এখন ট্রাম্প কতখানি বাস্তবসম্মত ভূমিকা পালন করতে পারেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।

Recent Posts

Leave a Comment