‘প্রচ্ছদ হচ্ছে বইয়ের বিজ্ঞাপন’

 In শিল্প-সাহিত্য, সফল মানুষ

 

ধ্রুব এষ বাংলাদেশের স্বনামখ্যাত চারুশিল্পীদের অন্যতম একজন, যিনি প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত ও খ্যাত দেশে-বিদেশে। জন্ম হাওর-অধ্যুষিত মায়াবি জোছনার জেলা সুনামগঞ্জে। শৈশব থেকেই বই ও বইয়ের প্রচ্ছদের প্রতি তার তীব্র আকর্ষণ। কবিতা, গল্প ও উপন্যাসও লেখেন। বিমূর্ত নকশার প্রতি তার ঝোঁক বেশি। প্রচ্ছদে তিনি ব্যবহার করেন উজ্জ্বল রং। নব্বই দশক থেকে তিনি বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। প্রকাশক-লেখক-পাঠকসহ সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয় তার আঁকা প্রচ্ছদ। একান্ত আলাপচারিতায় এ শিল্পী বলেছেন অনেক কথা। সেসব কথার নির্বাচিত অংশের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব প্রকাশিত হলো :

হুমায়ূনধ্রুব এষ পাঠকের কাছে এক যুগলবন্দি। কেমন ছিল সে যাত্রা? শুরুটাই বা কীভাবে হলো?প্রথমদিকে আমি সবচেয়ে বেশি প্রচ্ছদ করেছি ইমদাদুল হক মিলনের। তার তিন-চার বছর পর হুমায়ুন স্যারের প্রচ্ছদ করার সুযোগ আসে। আমি তখন তার মুগ্ধ পাঠক। এক প্রকাশক একদিন এসে বললেন একজন লেখকের প্রচ্ছদ করতে হবে; কিন্তু উনি বেশ খুঁতখুঁতে স্বভাবের। প্রচ্ছদ ভালো না হলে উল্টাপাল্টা কথা বলতে পারেন। আমি বললাম, কে তিনি? হুমায়ূন আহমেদের নাম বলতেই রাজি হয়ে গেলাম। প্রচ্ছদ করতে দিল ‘১৯৭১’ মঞ্চ নাটক। প্রচ্ছদ করলাম। প্রকাশক তার কাছে নিয়ে গেলো। উনি পছন্দ করলেন না। আরও দুইটা করলাম, পছন্দ হলো না। আরও দুইটা করে পাঠালাম, এবারও পছন্দ করলেন না। প্রকাশক এসে বললেন, হুমায়ুন স্যার আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন। আমি গেলাম তার সঙ্গে দেখা করতে। উনি আমাকে দেখেই বললেন, ‘ভাই তোমার তো কোনো প্রচ্ছদই আমার পছন্দ হয়নি। তুমি কি আরও প্রচ্ছদ করবে?’ আমি বললাম, হ্যাঁ, করবো। অনেকক্ষণ সেখানে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা শুনলাম। বের হয়ে প্রকাশককে বললাম, ওনার জন্য যদি আমার ১০০ প্রচ্ছদও করতে হয়, আমি তা-ই করবো। ওনাকে প্রচ্ছদ পছন্দ করাবোই। এরপরে অবশ্য খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি। একটা প্রচ্ছদ করেছিলাম সেটাই উনি পছন্দ করেছিলেন। সেই থেকে শুরু। এরপর বোধহয় আমি ছাড়া দু-একজনই স্যারের প্রচ্ছদ করার সুযোগ পেয়েছে। শুধু স্যারের প্রচ্ছদই আমি করেছি আড়াইশ’র মতো। আর লেখকের সঙ্গে আর্টিস্টের এত ব্যক্তিক সম্পর্ক তৈরি হওয়া উনি ছাড়া আমি কাউকে দেখিনি। এত মায়া দিয়ে স্যার ছাড়া আর কেউ আগলে রাখেনি। প্রকাশকরা আমাকে ঠিকমতো টাকা দিচ্ছে কিনা সেটা নিয়েও তিনি কনসার্ন ছিলেন। এমনকি তিনি নিজে প্রকাশকদের ফোন দিয়ে আমার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে খোঁজ নিতেন। এই মানুষটা সম্পর্কে আমি আসলে ব্যাখ্যা করতে পারবো না। প্রতি বছর আমি যে দু-একটা বই বের করি সেটা স্যারকে উৎসর্গ করে। যতোদিন বেঁচে থাকবো, তাই করবো। যদি একটা বই বের হয়, সেটা স্যারকে উৎসর্গ করেই বের হবে।

আপনাকে দিয়ে বইয়ের প্রচ্ছদ করানোর ইচ্ছে প্রায় সবার মধ্যেই থাকে, প্রচ্ছদ করার ক্ষেত্রে আপনি কোন বিষয়টাকে প্রাধান্য দেন?

আমি সব ধরনের বইয়ের কাজই করি। বইয়ের মান যাচাই করার সুযোগ কই আমার? আমি তো পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে এটা করছি। কেউ যদি আমাকে সিনেমার বইয়ের কাভার করতে দেয়, আমি সেটাও করবো। শাবনূর-পপির ছবি দিয়েই করবো। আমি ভাই ইন্টেলেকচুয়াল আর্টিস্ট না। প্রচ্ছদ করে কিছু পরিবর্তন করার ইচ্ছে আমার নেই। যে কারোর বই আমি করবো। বই যে মানের, প্রচ্ছদও সে মানেরই হবে।

 

প্রচ্ছদশিল্পী হতে গিয়ে, ‘কথাশিল্পীপরিচয়টা কী আড়ালে পড়ে যাচ্ছে?

কথাশিল্পী পরিচয়ের দরকারই তো আমার নেই। কোনো পরিচয়েরই দরকার আমার নেই। কালকে যদি কেউ বলে বইয়ের প্রচ্ছদেও আর্টিস্টের নাম থাকবে না, আমি বরং খুশিই হবো। কাজ করে যদি আমি তৃপ্ত হই, তাহলে নামের প্রয়োজন কেন? আমি তো জানি কোনটা আমার কাজ, সেখানে নাম থাকায় কিংবা না থাকায় কী আসে যায়?

এতো কর্মব্যস্ততায় নিজের ব্যক্তিসত্তায় কোনো দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় কি?

এই বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মেছিলেন। উনি যে পরিমাণ চিঠি লিখেছিলেন, আমরা সারা জীবনেও সে পরিমাণ কাজ করতে পারবো না। সেখানে দুটো কাজ করে যদি সবাইকে বলি অনেক করে ফেলেছি। আমার অন্তত মনে হয় না, আমি অনেক কাজ করেছি। কাজের ক্ষেত্রে আমি কোনো চাপ অনুভব করি না। চাপ অনুভব করি যখন বিভিন্নজন কাজ দিয়ে তাগাদা দিতে থাকেন কালকেই কাজ দিয়ে দেওয়ার জন্য। তাছাড়া ২৬-২৭ বছর ধরে এ পেশার সঙ্গে আছি, কোনোদিনও কাজের চাপ অনুভূত হয়নি। বরং এই কাজে আমি যে আনন্দ পাই তা কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়। প্রথমদিন কাজের প্রতি আমার যে ভালোবাসা ছিল, শেষদিন পর্যন্ত ঠিক তেমনই থাকবে।

বাংলাদেশের প্রচ্ছদের ভাষাচিত্রের প্রধান প্রবণতাগুলো কী?

প্রচ্ছদের কোনো ভাষাচিত্র নেই। ভাষা দিয়ে যে চিত্রটা তৈরি হয় সেটা লেখার। ছবির ভাষা আলাদা। প্রচ্ছদের ভাষাচিত্র হতে পারে না। প্রচ্ছদ তো আর অক্ষর দিয়ে বানানো যায় না। আমাদের আবার প্রচ্ছদের প্রবণতা কী? বাংলাদেশের প্রচ্ছদ দেখলে বোঝা যায় এটা এ দেশের প্রচ্ছদ। সেটাই তো বেশি জরুরি।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রচ্ছদে কী পার্থক্য আছে?

ভাষা এক হওয়ার কারণে পশ্চিমবঙ্গের প্রচ্ছদের সঙ্গে আমরা তুলনা করতে পারি। তাদের থেকে আমাদের প্রচ্ছদের চিন্তা-ভাবনার জায়গা অনেক আলাদা। বিশ্বের অন্য দেশের দেশের ভাষার সঙ্গে আমাদের বইয়ের তুলনা করতে পারবেন? সেখানে তো বিস্তর তফাৎ রয়েছে। প্রতিটা ক্ষেত্রেই তাই। বাংলাদেশ থেকে চূড়ান্তভাবে আন্তর্জাতিক মাধ্যমে একটাই কাজ গেছে- ফটোগ্রাফি। অসম্ভব ভালো কাজ হয়েছে এই সেক্টরে।

প্রচ্ছদশিল্পীর ভাষা লেখকের ভাষাকে অতিক্রম করতে পারে কি?

প্রচ্ছদ শিল্পীর ভাষা, লেখকের ভাষাকে কখনোই অতিক্রম করতে পারবে না। এটা সম্ভব নয়। লেখার সঙ্গে তো প্রচ্ছদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই যে এটাকে অতিক্রম করতে হবে।

প্রচ্ছদ কি পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে?

প্রচ্ছদের জন্য কেউ বই কেনে কিনা জানি না। পণ্যমূল্য হয়তো আছে; কিন্তু সেটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।

লেখক এবং প্রচ্ছদশিল্পীর মধ্যে কী ধরনের ভাবের আদানপ্রদান হওয়া প্রয়োজন?

লেখকের সঙ্গে কী জন্য ভাবের আদান-প্রদান করতে হবে? একটা অনুবাদের বইয়ের যদি প্রচ্ছদ করতে যাই তবে অনুবাদকের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করবো নাকি লেখকের সঙ্গে? সিনোপসিস পড়ে যতটুকু বোঝা যায় সেটা দিয়েই কাজ করা যায়। আর আমি কারোর কাছ থেকে আইডিয়া নেওয়া পছন্দ করি না। আইডিয়া কেউ শোনাতে পারে, সেটার প্রতি আমি অসম্মান করছি না। কিন্তু কাজ আমি নিজের মতোই করতে ভালোবাসি।

প্রচ্ছদকে আপনি বিজ্ঞাপন নাকি শিল্প হিসেবে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

বিজ্ঞাপনই মনে করি। আর দশটা মোড়কের মতোই। অনেকেই হয়তো ডিফার করবে, আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বললাম। বই না থাকলে খালি প্রচ্ছদ কোনো কাজে আসতো? প্রচ্ছদকে আমি পূর্ণমাত্রার শিল্প মনে করি না। শিল্পের নিজস্বতা আছে, স্বকীয়তা আছে। প্রচ্ছদ তো পরাশ্রয়ী। মিল্টন গ্রেসারকে প্রচ্ছদ বা গ্রাফিক্সের দেবতা বলা হয়। তিনি বব ডিলানের পোস্টার থেকে শুরু করে শেক্সপিয়ারের বইয়ের প্রচ্ছদ নতুন আঙ্গিকে করেছেন। যদি বই না থাকতো তাহলে এইসব প্রচ্ছদ মূল্যহীন হয়ে পড়তো। ভেতরে লেখা না থাকলে এবার বইমেলায় আমি ৭০০টা প্রচ্ছদ করে টাঙ্গিয়ে রাখলে কেউ কিনবে? কিন্তু আবার একটা গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের যদি কুৎসিত প্রচ্ছদ হয়, লোকে তাও কিনবে।

পাঠকের তো আসলে এত সময় থাকে না বই নেড়েচেড়ে তারপরে কেনার সেক্ষেত্রে অনেকেই হয়তো প্রচ্ছদ দেখে আকৃষ্ট হয়ে বই কেনেন

সেটা আমিও এক সময় কিনতাম। কিন্তু সেটা তো প্রচ্ছদের প্রতি আমার একধরনের দুর্বলতা ছিল সে কারণে। একবার আমি একটা বই পেলাম, ‘চারু মজুমদারের শেষদিনগুলো’। চারু মজুমদারের শেষ সময়ে তার যে ডাক্তার ছিল, উনি লিখেছিলেন। বইটার প্রোডাকশন বলেন, প্রচ্ছদই বলেন- কিছুই হাতে নেওয়ার যোগ্য না। কিন্তু তারপরেও আমি বইটা কিনেছিলাম কেবল কনটেন্টের জন্য। এখন পাঠক তো অন্তত এটুকু বুঝবে যে বইটি কিনছে তার ভেতরের লেখার মান কী রকম?

অলঙ্করণ এবং প্রচ্ছদের মধ্যে পার্থক্য মূলত কী?

অলঙ্করণ আর প্রচ্ছদ সম্পূর্ণ দুইটা ভিন্ন জিনিস। আমাদের দেশে প্রচ্ছদের মাপ হলো পৌনে নয়-ছয়। এইটুকুর মধ্যে চূড়ান্ত মাত্রায় একটা এক্সপ্রেশন তৈরি করাই হলো প্রচ্ছদ। অলঙ্করণ করতে গেলে অবশ্যই গল্পের ডিটেইলিং সেখানে আনতে হবে। পুরো লেখাটাকে অলঙ্কৃত করাকে অলঙ্করণ বলে। সত্যজিতের অলঙ্করণ দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। উনি ফেলুদায় যে ঘোড়ার গাড়ি এঁকেছেন তার থেকে আমি খুড়ের শব্দ শুনতে পাই। যে সব অলি-গলি এঁকেছেন, মনে হয় যেন আমি সেখানেই আছি। প্রচণ্ড শক্তিশালী সেসব অলঙ্করণ।

সৃষ্টির পেছনে কোনো না কোনো প্রণোদনা থাকে, নিশ্চয় আপনার আঁকা এবং লেখার পেছনেও কোনো প্রণোদনা আছে?

প্রণোদনা কাকে বলে? এইসব আমি বুঝি না। কাজ করে তৃপ্তি পাই তাই কাজ করি।

বিষয় নির্বাচন করে লেখেন নাকি লিখতে লিখতে বিষয় এসে যায়?

এতকিছু চিন্তা করি না। লিখতে লিখতে যেটা মাথায় আসে তাই লিখে ফেলি।

লেখার পেছনে কি কোনো উদ্দেশ্যে অথবা সামাজিক দায়বদ্ধতা কাজ করে?

আমার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। আমি সবকিছু আমার মতোই করি। লেখালেখি তো আমি শিশুদের নিয়ে করে থাকি আর এর বাইরে যেগুলো করি সেখানে খুন-খারাপিই বেশি। এর মধ্যে দায়বদ্ধতা আছে কিনা আমি জানি না। সবাই ভালো থাকুক, এটাই চাই। সমাজে অন্য সবার যেটুকু দায় আছে, আমারও ততোটুকুই। এর চেয়ে আলাদা কিছু নেই।

প্রচ্ছদশিল্পীদের নিয়ে একটি অভিযোগে আছেতারা সময়মতো কাজ বুঝিয়ে দেয় না, কমিটমেন্টের জায়গাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আমি যেহেতু নিজে কমিটমেন্টের জায়গা ঠিক রাখি, সেখানে কে কী করছে সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। অন্যদের কমিটেড করার দায়িত্ব আমার না।

সাম্প্রতিক যে ধর্মীয় সহিংসতা, জঙ্গিবাদের উত্থান, নির্বিচারে হত্যা হচ্ছে, বাংলাদেশে তা ঠিক কতোটা মানানসই?

এটা আমাদের ব্যর্থতা। মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে আর আমরা কেবল আহাজারি করবো- এটা তো হতে পারে না।

এর থেকে উত্তরণের উপায় কী?

এটা আমি কী করে বলবো? এগুলো তো রাজনীতিবিদদের বলার কথা, তারা বলবেন।

তারপরও, আপনার কোনো সাজেশন নেই?

যদি এখন দেশে যুদ্ধ লাগে, আমি কী সাজেশন দিতে যাবো, নাকি যুদ্ধ করবো? যুদ্ধ করতেই নিশ্চয় যাবো। সাজেশন যারা দেওয়ার তারা দেবে। আমরা যদি পারি, সহযোগিতা করবো। আমার সাজেশনে তো আর রাষ্ট্র চলবে না। জীবন মানেই যুদ্ধ। পৃথিবী কবে যুদ্ধ ছাড়া ছিল? সারা পৃথিবীতে প্রতিদিন মানুষ খুন হচ্ছে। বিশ্ব যেখানে আক্রান্ত, সেখানে দেশ নিয়ে কী ভাববো?

Recent Posts

Leave a Comment