সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা, সংখ্যালঘু ও পাওয়ার পলিটিকস

 In খোলা কলাম

সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা, সংখ্যালঘু ও পাওয়ার পলিটিকস

প্রথমে ভেবেছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ইস্যু নিয়ে কিছু লিখব না। লিখে কি লাভ হয় বা হবে তা আমার বোধগম্য হয়নি। আমার লেখার দৌড় খুব বেশি দূর নয়। তবুও বিবেক এখনো পুরোপুরি মরে যায়নি বলেই লিখছি। আমার লেখা হয়ত অবস্থাগত (কোন পরিবর্তন আনবে না, কিন্ত কেউ যদি তার মনকে গোঁড়া পন্থার (Radicalism) অবস্থান বদলে উদার পন্থার (Liberalism) দিকে নিয়ে আসতে পারে তবে সেটাই হয়ত এ লেখার সার্থকতা।

একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়েই শুরু করছি। আমি ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে পড়ি তখন। আমরা যে স্যারের কাছে কেমিস্ট্রি পড়তাম তিনি ছিলেন একেবারে আপাদমস্তক ধার্মিক মানুষ। সকল নিয়ম কানুন মেনে চলা মানুষ। তার অনেক হিন্দু ছাত্র ছিল, কখনোও দেখিনি তিনি তাদের সাথে কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করেছেন।

আমার আব্বা, আমাদের জেলার দক্ষিণপশ্চিম অঞ্চলে অনেক জনপ্রিয় একজন আলেম। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি আমাদের বাড়িতে অনেক মানুষের আনাগোনা, অনেক হিন্দু মানুষও আসতেন। নানা পরামর্শের জন্য; কখনো তাকে তাদের তাড়িয়ে দিতে বা রাগ করতে দেখিনি।

আমার এক বন্ধু হিন্দু, তাকে আমার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। আব্বা আম্মা দুজনেই যথেষ্ট আদর করেছেন তাকে, দেখেছি এবং তার কাছেও এর স্বীকৃতি পেয়েছি অনেকবার। আধুনিককালে এসেও দেখেছি ধর্মীয় সম্প্রীতির মেলবন্ধন। আর এসব উদাহরণ তাদের কাছেই দেখেছি যারা স্বীকৃত, যাদের ধর্ম সংক্রান্ত অগাধ পাণ্ডিত্য আছে বলেই আমার বিশ্বাস। তবে আজ জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসারের শতক বলে খ্যাত একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসেও কেন দেখতে হয়- অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপর হামলা হয়? কোন অধিকারে কিসের তাগিদে ‘মালাউনের বাচ্চা’ বলে গালি দেওয়া হয়? তাও আবার সরকারের মন্ত্রী হয়ে?

২.
সাম্প্রদায়িকতা বা কম্যুনালিজম (Communalism) শব্দটিতেও একধরনের হিংস্রতার বীজ বপন করা।

হ্যাঁ রে ভাই, সাম্প্রদায়িকতা কি? ‘৪৬ এ যেমনটা ঘটেছিল কলকাতায় তারই সূত্র ধরে নোয়াখালীতে ঠিক তেমনটাই ঘটেছিল, তবে একটু বর্ধিত মাত্রায়। সেদিকে আলোকপাত করতে যাচ্ছি না। বলছিলাম সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে; বাংলাদেশ খুব সম্ভবত পৃথিবীর অন্যতম সম্প্রীতির দেশ, ‘৪৬ এর পরে মোটা দাগে কোথাও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা ঘটেনি। যা দুই একটা ঘটেছে তা বিচ্ছিন্ন আকারে; ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থে। সাম্প্রাদায়িকতার প্রশ্ন কেন আসে? বার বার ঘুরে ফিরে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন কেন আসে? কেন জাতি হিসেবে আমাদের মাঝে বাংলাদেশি বাঙালি জাতীয়তাবাদ গ্রো করে না? নাকি আসলে করতে দেওয়া হয় না? বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন কি এই হিন্দু-মুসলিম পরিচয় মুখ্য ছিল? নাকি স্বাধীন বাংলাদেশ মুখ্য ছিল?

আসলে আমাদের সুকৌশলে সাম্প্রদায়িক হতে শেখানো হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক হতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমাদের আতুড় ঘরে আগে মিলেমিশে থাকতে শেখানো হতো আর এখন শেখানো হয় এক ধরনের একা বাঁচো; স্বার্থপরতার নীতি। স্কুল কলেজগুলোতে হিংসা করতে শেখানো; নৈতিকতার বালাই নেই! নৈতিকতা, অসাম্প্রদায়িক মনোভাব ইত্যাদি ইত্যাদি বড় হয়ে শেখার বিষয় নয়। এগুলো নাড়ি কাটার পর শেখার বিষয়; এসবের মধ্য দিয়ে যাওয়ার বিষয়। অসাম্প্রদায়িক একটা জাতিকে দীর্ঘ সময় ধরে সাম্প্রদায়িকতার পাঠ দেওয়া হচ্ছে; এখন চলছে ফাইনাল স্টেজ, সাথে চলছে ছোটখাটো রিহার্সাল। খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে এই বিষবাষ্প। আখেরে কার লাভ? হিন্দু, মুসলমান নাকি অন্য কারোর? এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্য আমাদের একটু ক্ষমতার রাজনীতি নিয়ে জ্ঞানার্জন করতে হবে।

৩.
সংখ্যালঘু (Minority) আরেকটি হতচ্ছাড়া তবে ব্যাপক আলোচিত শব্দ। এখন কথা হলোও কারা এই সংখ্যালঘু আর কারা সংখ্যাগুরু?

প্রথমে আমাদের ভূখণ্ডের কথাই ধরা যাক। এখানে মার্জিনালি প্রায় ৮০ শতাংশ মুসলিম। বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে হিন্দুরাই মেজরিটি, এছাড়াও অন্যান্যরা সংখ্যায় খুবই কম। এই বাকি বিশ শতাংশকে বলা হচ্ছে সংখ্যালঘু! আচ্ছা এদের কি সংবিধানে সংখ্যালঘু বলা হয়েছে? খুব জানতে ইচ্ছে করছে? আমার যতটুকু ক্ষুদ্র জ্ঞান তাতে সংবিধান বা অন্য কোথাও এদের সংখ্যালঘু বলা হয়নি।

সংবিধানের আর্টিকেল ৪১ অনুযায়ী : ১. আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা-সাপেক্ষে

(ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে;

(খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায় নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে।

এখানে বা রাষ্ট্র পরিচালনার অন্য কোন বিধিতে কোন সম্প্রদায় কে সংখ্যালঘু প্রতিপন্ন করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না।

আবার, আর্টিকেল -২৮ (১) অনুযায়ী : ধর্ম, বর্ণ গোষ্ঠী অন্যান্য (….) কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না।

তাই যদি হয়, তবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন একজন মন্ত্রী কি করে এক বিশেষ সম্প্রদায়কে মালাউনের বাচ্চা বলেন? হতে পারে তারা তার ধর্মাবলম্বী নয়। এসব মন্তব্য কিসের আলামত দেয়? কিছুদিন পর পর হুটহাট এমন দাঙ্গার উদ্ভব হয় কিসের কারণে?

রাষ্ট্র পরিচালনার যেসব বিধিবিধান, তাতে কোথাও উল্লেখ নেই হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এরা সংখ্যালঘু। তবে মিডিয়ায় তাদেরকে সংখ্যালঘু, আর অন্যদের সংখ্যাগুরু বলে উপস্থাপন করছে কারা? প্রশ্নটা খুব সোজা হলেও উত্তরটা এতটা সোজা নয়।

এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য আপনাকে পাওয়ার পলিটিকস নামক একটি চ্যাপ্টার পড়তে হবে।

৪.
ক্ষমতা বা পাওয়ার, ক্ষমতার রাজনীতি বা পাওয়ার পলিটিকস। আমাদের দেশের রাজনীতিতে একটাই লক্ষ্য থাকে সেটা হলো যেকোন উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়া; এবং ক্ষমতার মধু চন্দ্রিমা যতটা পারা যায় প্রলম্বিত করা। তাতে যত মানুষ কোরবানি হয় হোক। ক্ষমতায় টিকে থাকতেই হবে।

শুধু বর্তমান নয় সেই ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু করে আজ অব্দি প্রতিটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামার পেছনে এই পাওয়ার পলিটিকস দায়ী।

একনজরে একটু দেখে নিই পাওয়ার পলিটিকস ও দাঙ্গার সম্পর্ক। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সংঘটিত হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ছিল ভারত ত্যাগের পূর্বে ব্রিটিশের ঘৃণিত কৌশল ‘ভাগ করো, শাসন করো’র ফসল। বাংলায় দাঙ্গা বাধিয়ে দেওয়ার একটা বাস্তব পরিস্থিতি সে সময় সাময়িক সময়ের জন্যে হলেও বিরাজমান ছিল, ধূর্ত ব্রিটিশ তা বুঝেছিল।

১৯৩৭ সালে ভারতবর্ষের বাংলায় ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ শ্রেণী হিসেবে আবির্ভূত হয়। সে সময়ে বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। এই শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য চাকরির বাজার ছিল খুবই সংকুচিত। কারণ মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহিত হয়েছিল হিন্দু সম্প্রদায় থেকে প্রায় শতবর্ষ পরে। ফলে ব্রিটিশের কেরানির বাজার প্রায় সবটাই হিন্দুদের দখলে ছিল। পূর্ববাংলার মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী মনে করেছিল হিন্দু-মুসলমান দুই জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হলে পূর্ববাংলা থেকে হিন্দুদের তাড়িয়ে দেওয়া যাবে এবং ‘চাকরির বাজার’ একচ্ছত্রভাবে তাদের দখলে চলে আসবে। কারণ পূর্ব বাংলায় মুসলমানরা ছিল নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠ। হিন্দু সম্প্রদায়কে তাড়িয়ে দেওয়ার পর তাদের স্থাবর সম্পত্তি দখলের স্বপ্ন দেখত মুসলিম লীগের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গুণ্ডাপাণ্ডারা।

তদানীন্তন সময়ে আরো একটা বাস্তবতা ছিল পূর্ববাংলায়। ব্রিটিশ ভারতে পূর্ববাংলার দশজন জমিদারের মধ্যে নয়জনই ছিলেন হিন্দু সম্প্রাদায়ের। বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক প্রজাকুল ছিল দরিদ্র মুসলমান। এই দরিদ্র কৃষক প্রজাকুল মনে করেছিল হিন্দু-মুসলমান তত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ হলে তারা হিন্দু জমিদারদের শোষণ, অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু এই দরিদ্র মুসলিম কৃষক প্রজাকুল কখনোই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রভাবে প্রভাবিত হয়নি। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে দেখা গেছে পূর্ববাংলায় মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের একটা অংশ অতি উৎসাহ নিয়ে দাঙ্গায় অংশ নিচ্ছে। ভারত ভাগের পর মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ সত্যি সত্যিই ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ চাকরির বাজারের নিরঙ্কুশ মালিক বনে গিয়েছিল এবং একই সঙ্গে মুসলিম লীগের গুণ্ডাপাণ্ডা হিসেবে ‘দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া হিন্দুদের’ স্থাবর সম্পত্তিও দখল করেছিল।

১৯৪৮ সাল থেকে ‘৫২ সালের মধ্যেই পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজের পাকিস্তান প্রীতি থেকে মোহভঙ্গ ঘটে। সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ ভূস্বামী ও সামরিক কর্তাদের স্বৈরশাসন ও জাতিগত নিপীড়ন, শোষণ পূর্ব বাংলার বাঙালিদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ‘৫২ এর রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলন বাঙালিদের চেতনা থেকে দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রভাব মুছে দিতে শুরু করে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালার ঘটনা ঘটায়। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ঘটলেও কৃষকের জীবনের কোনোই পরিবর্তন ঘটে না। গ্রাম-শহরের শ্রমিক শ্রেণী ও মেহনতি মানুষের জীবনের সংকটের কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না সদ্য স্বাধীন পাকিস্তান। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিশাল বিজয় এবং মুসলিম লীগের ভরাডুবির মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলায় পাকিস্তানের মৃত্যু ঘণ্টা বেজে যায়।

গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষে পূর্ববাংলার বাঙালির চেতনা থেকে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব ক্ষীণ হয়ে পড়লেও সমাজে তার অবশেষ বজায় ছিল। ১৯৬৪ সালে খুব অল্প পরিসরে হলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আরেক দফা হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ঘটাতে পেরেছিল। বাস্তবে এসব দাঙ্গা ছিল এক তরফা। মুসলিম লীগের গুণ্ডারা হিন্দুদের ওপর হামলা চালায় এবং লুটপাট করে। পূর্ববাংলার বাম গণতান্ত্রিক শক্তি দ্রুত এই হামলা রুখে দিতে সক্ষম হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনেকেই মনে করেছিলেন বাংলাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার শিকড় উৎপাটিত হয়ে গেছে।

সমাজে সাম্প্রদায়িকতার নানা রূপ থাকে। পৃথিবীতে ধর্ম, বর্ণ ও জাতির মধ্যে নানা ধরনের বিভেদ ও বৈষম্য শতবর্ষ ধরে বিরাজ করছে। ফলে সমাজ জীবন থেকে সাম্প্রদায়িকতা সম্পূর্ণ মুছে যায় না। নানা ধরনের সংকীর্ণ স্বার্থ, বিশেষ করে হীন রাজনৈতিক ও বৈষয়িক স্বার্থে শাসকগোষ্ঠী অথবা প্রভাবশালীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত উসকে দেওয়া হয়। পশ্চাৎপদ ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে সাময়িক সময়ের জন্য উন্মাদনা সৃষ্টি করে সাস্প্রদায়িক হাঙ্গামা সৃষ্টি করা যায়।

১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর মদতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনরায় শুরু করা হয়। একটানা দুই দশক ধরে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করার জন্য সবকিছুই করা হয়েছে। এসবই করা হয় জিয়া-এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের ছত্রছায়ায়। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত শাসনকালে সাম্প্রদায়িকতা সশস্ত্র ইসলামী জঙ্গিবাদে রূপান্তরিত হয়। এতসব সত্ত্বেও বাংলাদেশে জঙ্গি সাম্প্রদায়িকতা কর্তৃত্বশালী হয়ে উঠতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভিঘাত এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এখনও সামাজিকভাবে সাম্প্রদায়িকতার হিংস্র আক্রমণকে রুখে দিতে সক্ষম হচ্ছে।

বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির পেছনে বৈষয়িক স্বার্থ চিন্তা প্রধান কারণ হিসেবে এখনো বিরাজ করছে। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার পর রাজধানী ঢাকা শহরের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলো থেকে যে বড় সংখ্যক হিন্দু সম্প্রদায় দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান তাদের মূল্যবান সম্পত্তি একশ্রেণীর মুসলমান প্রভাবশালী টাউট ভুয়া দলিল করে ভোগ দখল করছে। আজও যদি সুষ্ঠু তদন্ত করা হয় তাহলে এই দখলদারদের চিহ্নিত করা সম্ভব।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শুরুতে যে দাঙ্গা ঘটেছিল তাতে প্রায় ৯ লাখ হিন্দু সম্প্রদায় দেশত্যাগ করে ভারতে চলে গেছেন। তদন্ত করলে দেখা যাবে তাদের সহায় সম্পদও নানা কৌশলে দখল করে নিয়েছে দাঙ্গা সৃষ্টিকারীরা। মহাজোট সরকারের আমলেও সাতক্ষীরা, দিনাজপুরের চিরিরবন্দরসহ কয়েকটি অঞ্চলে হিন্দুদের ওপর বড় ধরনের আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এর পেছনেও ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মূল্যবান সম্পত্তি দখলের লোভ। তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে অতি সম্প্রতি পাহাড়ে ঘটে যাওয়া দাঙ্গার পেছনেও রয়েছে বৈষয়িক স্বার্থ ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র।

প্রধানমন্ত্রী যখন ‘শান্তি চুক্তি’ বাস্তবায়নের অন্যতম বাধা ভূমি সমস্যা সমাধানের বাস্তব উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দিলেন তখনই ঘটে গেল পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গা। পাহাড়ে ‘সেটেলারদের’ কায়েমি স্বার্থের নেপথ্য নায়করা দাঙ্গা বাধিয়ে ‘শান্তি চুক্তি’ বাস্তবায়ন আর একদফা বাধাগ্রস্ত করল। একটা অদ্ভুত ঘটনা পাহাড়ে লক্ষ্য করা যায়। যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঘোরতর বিরোধী পাহাড়ে গিয়ে তারা অবলীলায় বাঙালি বনে যায়! এক্ষেত্রে ‘বাঙালি-বাংলাদেশি’ বিরোধ কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না!

ভূরাজনৈতিক স্বার্থেও জাতিগত এবং সাম্প্রদায়িক বিরোধ উসকে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রেও সস্তা অনুভূতিকে ব্যবহার করতে দেখা যায়। যেমন, হঠাৎ করে পাহাড়িরা নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন! এই সেদিনও তারা নিজেদের ‘জম্মু’ জাতি হিসেবে পরিচয় দিতেন। জাতীয়তার বৈজ্ঞানিক বিচার-বিশ্লেষণের ধার তারা ধারছেন না। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে নরতত্ত্ব বিচারে আমাদের এই ভূখণ্ডে তিনটি মৌলিক জাতি সত্ত্বার উপস্থিতি রয়েছে। তারা হলো_ ১. প্রোটো অস্ট্রোলাইড, ২. মঙ্গোলাইড ও ৩. ভেড্ডিড। পাহাড়িরা হলেন ‘মঙ্গোলাইড’। তারাও বাইরে থেকে এসে এই ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন করেছিলেন। ‘আইএলও’র সংজ্ঞা বিচারেও বাংলাদেশের জন্য ‘আদিবাসী’ টার্মিনোলজি কোনোভাবেই প্রযোজ্য হয় না। পশ্চিম ইউরোপীয় কিছু দেশ এবং তাদের মদতপুষ্ট কিছু এনজিও তাদের বৈষয়িক স্বার্থে এ ধরনের অহেতুক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তাছাড়া ভূরাজনৈতিক স্বার্থে যারা বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রাখতে চায় তারাও এই ফাঁপানো তর্কের জন্ম দেওয়ার নেপথ্যে রয়েছে। বাঙালি জাতিসহ যে কোন দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক মানুষ পাহাড়ি ও সমতল ভূমির ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার ও প্রাণের দাবিগুলো দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন করবে। নেহায়েত মতলববাজ না হলে জম্মুজাতি এবং সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের অধিকার ও স্বার্থের বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াতে পারে না।

শুধু এদেশীয় পাওয়ার পলিটিকস নয় আন্তর্জাতিক অনেক চালু ঘোড়াই এখন আছে বাংলাদেশ নামক দাবার বোর্ডে। সুতরাং, সাধু সাবধান। ‘তুমি মুসলমান হও আর হিন্দু হও নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিয়ে নিজের স্বাধীনতা বিপন্ন করো না।’

লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

Recent Posts

Leave a Comment