কেমন হিরো, হিরো আলম? : গাজী মুনছুর আজিজ

 In খোলা কলাম

‘ইন্টারনেটে খোঁজার ক্ষেত্রে বলিউড তারকা সালমান খানকে পেছনে ফেলেছেন বাংলাদেশের হিরো আলম।’- ইন্টারনেট। হিরো আলমকে নিয়ে এই লেখা হলেও, পার্শ্বকাহিনি বা চরিত্র হিসেবে হাজির হয়েছে আরও অনেকে। যার কোনোটা হিরো আলমের সম্পুরক আবার কোনোটা বিপ্রতীপ।

০১.
কয়েক বছর আগের কথা। আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুনের ৬০তম জন্মদিন উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে নাসির আলী মামুনকে নিয়ে একটি বইও প্রকাশিত হয়। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন দেশবরেণ্য একজন কবি। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, গতকাল (গতকাল বলতে অতি সম্প্রতি) যে মেয়েটা মিডিয়ায় কাজ করতে শুরু করেছে, হয়তো সে কোনো এক অখ্যাত কোম্পানির চানাচুরের একটি বিজ্ঞাপন করেছে, কিংবা কোনো এক মিউজিক ভিডিওতে অভিনয় করেছে তার জন্মদিন উদযাপনের খবরও পত্রিকায় ছাপা হয় বা মিডিয়ায় আসে।

এমনকি জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তিনি কোন রঙের পোশাক পরবেন, কিংবা জন্মদিনে কেক কোথা থেকে আসবে, জন্মদিন কোথায় উদযাপন করবেন এমন সব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যও ছাপা হয় পত্রিকায়, সঙ্গে তার সাম্প্রতিক বিশাল একটি ছবিও থাকে। কিন্তু আলোকচিত্রশিল্পী হিসেবে এদেশে কিছুটা হলেও সুখ্যাতি পাওয়া নাসির আলী মামুনের ৬০তম জন্মদিন উপলক্ষে কোনো মিডিয়াতেই তেমন কোনো সংবাদ আসেনি।

০২.
বছর দুই বা তিন আগে কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার ফেসবুকে লিখেছিলেন, লেখকরা তারকা নন। তারা সারাজীবন লেখলেখি করলেও তারকা হতে পারেন না। পত্রিকায় গল্প-কবিতা-উপন্যাস লিখে কিছু টাকা পাওয়া যায় (তাও আবার অনিয়মিত)। জাকির তালুকদারের সেই লেখায় প্রকাশকদের কথাও আছে। লেখাটার শেষটায় তিনি লিখেছেন অনেক কিছু সত্ত্বেও লেখকরা তারকা হতে পারেন না।

০৩.
নাটক পাড়ায় দীর্ঘদিন নাট্যচর্চা করেও অনেক নাট্যকর্মী মঞ্চনাটকের বাইরে যেতে পারেন না কিংবা ছোট পর্দায় বা বড় পর্দায় নিজেদের দেখানোর সুযোগ পান না। কিন্তু অভিনয়ের ‘অ’, গানের ‘গ’ কিংবা নাচের ‘ন’ না জেনেও অনেকে ছোটপর্দায় বা বড় পর্দায় অভিনয় করছেন (যদিও তাদের অভিনয় হয় না বললেই চলে)। এই ‘না জানা’রা সুযোগ পান পরিচালক বা প্রযোজকদের পরিচিত হিসেবে বা কাছের মানুষ হিসেবে বা স্বজন হিসেবে।

ছেলেদের বেলায় যা হোক, মেয়েদের বেলায় অনেক ক্ষেত্রেই ‘দেখতে সুন্দর’ তাই চান্স পেয়ে যান বা তথাকথিতরা চান্স পাইয়ে দেন বা সুযোগ করে দেন। অথচ দীর্ঘদিন মঞ্চের সঙ্গে জড়িত থেকে, নাচ, গান বা অভিনয় শিখেও ছোট পর্দায় বা বড় পর্দায় সুযোগ পান না অনেকে। এ প্রসঙ্গে মিডিয়ায় একটা একটা কথাও প্রচলন আছে ‘যোগাযো’ না থাকার কারণে সুযোগ পান না অনেকে। কিংবা যোগাযোগ নাই বলেই তারা হয়তো সুযোগ পান না।

০৪.
মিডিয়ায় কাজের একটা প্লাটফর্ম হিসেবে র্যা ম্প মডেলিংকে বেছে নেন অনেক আগ্রহী। কিন্তু দীর্ঘদিন র্যা ম্প মডেলিং করেও অনেকে খুব একটা বড় ব্যানারে কাজের সুযোগ পান না। কিন্তু মিডিয়ায় একদম নবীন হয়েও ছোট পর্দায় কাজের সুযোগ পান অনেকে। এক্ষেত্রেও যাদের ‘যোগাযোগ’টা আছে তারাই পান বোধ করি। আবার কেউ কেউ তো র্যা ম্প মডেলিং করে নায়িকাও হয়েছেন (যদিও তারা র্যা ম্পেই ঠিক মতো হাঁটতে পারেন না, আর অভিনয়তো দূরের কথা)।

০৫.
অভিনেতা ডা. এজাজুল ইসলাম কিছুদিন আগে একটি দৈনিক পত্রিকায় ইন্টারভিউতে বলেছেন, ‘অনেকেই কমেডি আর ভাঁড়ামি বোঝেন না। তারা কমেডি আর ভাঁড়ামিকে এক মনে করেন বা ভাবেন।’ সত্যিই তাই। কমেডি আর ভাঁড়ামিকে আমরা অনেকেই আলাদা করতে পারি না। ভাবি দুটোই এক বিষয়। আর সেজন্য সস্তা ভাঁড়ামি করে অনেকে মিডিয়ায় খুব কম সময়ে জনপ্রিয় হয়ে যান। অন্যদিকে সস্তা ভাঁড়ামির বিপরীতে প্রকৃত কমেডি অভিনয় শিল্পীরা আড়ালেই থেকে যান বা আমরা তাদের চিনি না। সেজন্য প্রকৃত কমেডি অভিনয় শিল্পীদের কাজের সুযোগও কম দেখা মেলে।

০৬.
মো. আশরাফুল হোসেন আলম (তিনি হিরো আলম নামে পরিচিত)। বাড়ি বগুরায়। ডিসের ব্যবসা করেন বলে ডিস আলম নামেও পরিচিতি পেয়েছেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছেন। যদিও জিততে পারেননি। অবশ্য হিরো আলম নামেই বেশি পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। সস্তা মিউজিক ভিডিওতে অভিনয় করে সেই ভিডিও ক্যাবল টিভিতে প্রচার করেই মূলত তার পরিচিতির দুয়ার খুলেছে। এসব সস্তা মিউজিক ভিডিও তিনি নিজের উদ্যোগেই নির্মাণ ও প্রচার করে থাকেন। এসব মিউজিক ভিডিও আবার অধিকাংশই ঢালিউড বা বলিউডের অনুকরণ করে তৈরি করা। মূলত ভাঁড়ামির জন্যই এসব মিউজিক ভিডিওর মাধ্যমে তিনি পরিচিতি (হাসির খোরাক হন) পান মানুষের কাছে।

মিউজিক ভিডিওতে নিজেকে হিরো চরিত্রে উপস্থান করে তিনি নিজেকে হিরো দাবী করেন। এমনকি মো. আশরাফুল হোসেন আলম বা ডিস আলমের পরিবর্তে তিনি নিজের নামের আগে ‘হিরো’ বসিয়ে ‘হিরো আলম’ নাম ধারণ করেন। সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও তিনি পেজ খুলেন হিরো আলম নামে। সেই পেজে নিজের মিউজিক ভিডিওগুলো ও নিজের কার্যক্রমের ছবি আপলোড করেন।

হিরো আলমের এসব সস্তা মিউজিক ভিডিও আর তার নানা ছবি দেখে ফেসবুকে অনেকেই নানা মন্তব্য করেন। অধিকাংশ মন্তব্যই মজার ও হাস্যকর। কিন্তু কেউ কেউ হিরো আলমের এ মহান ‘প্রতিভা’কে মহান ভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। এমনকি হিরো আলমকে তারা সত্যিকার অর্থেই ‘হিরো’উপাধি দিয়ে নানা মন্তব্য করেন। আর এ মন্তব্যের ফলে আলমও ভাবলেন ‘তিনি তো সত্যিকার অর্থেই মহান হিরো’ হয়ে গেলেন।

সেইসব মন্তব্যের সূত্র ধরেই আলম ঢাকায় আসতে শুরু করেন। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন লোকের কাছে গিয়ে গিয়ে সেলফি তোলেন ও ফেসবুকে আপলোড করেন। অনেক সেলিব্রেটিও আলমকে কাছে পেয়ে মজা করে সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করেন (মজা করার জন্য)। আর এতে আলম নিজেকে আরও বড় মাপের ‘হিরো’ বলে দাবী করে বসেন। ব্যাস, এতেই মো. আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে ডিস আলম হয়ে গেলেন হিরো আলম। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি যেতে লাগলেন টিভি শোতেও। পেলেন বিজ্ঞাপনের ডাকও।

০৭.
ব্যক্তি আলমের প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। আর বিদ্বেষ থাকবেই বা কেনো? তিনি তো আর ‘আমার বাড়া ভাতে ছাই দেননি।’ তার চেহারা কেমন, তার উচ্চতা কতো, তার উচ্চারণ কেমন কিংবা তিনি কি রঙের-কি ডিজাইনের পোশাক পরেন এসব নিয়েও আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। তিনি নিজে ভাঁড়ামি করে কিছু মানুষকে সামান্য হলেও ক্ষণিক সময়ের জন্য আনন্দ দেন এটা ভালো কথা। এটা করে তিনি নিজেও খুশি থাকেন। আর এটা করে নিজেকে নিজেই হিরো দাবী করেন এটাও ভালো কথা।

তাই বলে তাকে কিছু মানুষ ‘মহান হিরো’ বলে উপস্থাপন করবেন? তাকে দিয়ে বিজ্ঞাপন বানাবেন? হ্যাঁ, তার সরলতার জন্য তাকে ধন্যবাদ দেয়া যেতে পারে। তার কাজের জন্য তাকে সাধুবাদ জানানো যেতে পারে। তাই বলে তাকে রাতারাতি ‘সত্যিকার হিরো’ বলে আখ্যা দেয়া যেতে পারে কি? তাহলে দিনের পর দিন যারা পড়াশোনা করে মিডিয়ায় কাজ করছেন, যারা মিডিয়ায় কাজের জন্য নাচ, গান, অভিনয় বা র্যা ম্প শিখছেন তাদের প্রতি কি অন্যায় করা হচ্ছে না?

০৮.
আলমকে আলমের স্থানেই রাখা ভালো। তিনি তার মতো করেই বড় হবেন। তাকে বাড়তি খেতাব বা তকমা না দিয়ে তার যে স্বাভাবিক চরিত্র সেটা ঠিক রাখাই ভালো (কারণ তার পিঠে দুটো পাখা লাগিয়ে দিলেইতো আর সে উড়তে পারবে না!)। সর্বশেষ খবর হলো, ইন্টারনেটে সার্চের ক্ষেত্রে বলিউড তারকা, সালমান খানকেও ছাড়িয়ে গেছে হিরো আলম।

ইন্টারনেটের কল্যাণে এর আগে পাকিস্তানের এক চা বিক্রেতার ভাগ্য বদলে গেছে, নেপালের এক সবজিওয়ালি পেয়েছে কল্পনাতীত নতুন জীবন। আমাদের হিরো আলমের ভাগ্যে প্রকৃতার্থে তেমন কিছু ঘটবে কি, নাকি হাওয়ার ফুৎকারে হারিয়ে যাবে তার এই অর্জন? হিরো আলমের কাছে পূর্ণিমার চাঁদ যদি ঝলসানো রুটি হয়ে থাকে। তার ভাগ্য যদি না বদলায়। হিরোর বিত্ত-বৈভব ও সম্মান যদি না জুটে, তাহলে এ প্রশ্ন ওঠা সংগত যে, কেমন হিরো, হিরো আলম?

০৯.
দেশের অন্যতম বৃহৎ মোবাইল অপারেটর প্রতিষ্ঠান বাংলালিংক। তারাও আলমকে নিয়ে সস্তা ভাঁড়ামি করতে ছাড়েনি। নানা সেক্টরে দেশের অসংখ্য খ্যাতিমান থাকা সত্ত্বেও বাংলালিংক আলমকে তাদের হ্যালো স্টার সার্ভিস প্রোগ্রাম বিভাগে ‘আসল হিরো’ বলে উপাধি দিয়েছে এবং আসল হিরোর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার জন্য গ্রাহকদের তারা অফিসিয়াল এসএমএস, এমএমএস ও তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। অবশ্য তাদের এ রুচি দেখে ফেসবুকে ব্যাপক সমালোচনাও করেছেন অসংখ্য গ্রাহক।

১০.
ছেলেবেলায় একটা গল্প পড়েছি। গল্পটি হলো একটি গরু মাঠে ঘাষ খাচ্ছে। তখন একটি ব্যাঙ গরুটিকে দেখে ভাবলো গরুর মতো তার পেটটাও বড় হলে তার ভালো লাগবে। এজন্য ব্যাঙ নিজের পেট ফুলোনো শুরু করলো এবং একটা সময় পেট ফেটে ব্যাঙটি মারা গেলো।

বেশ কিছুদিন আগে পত্রিকায় সংবাদ দেখলাম বাংলাদেশের কোনো এক গ্রামের একজন স্বশিক্ষিত লোক বিমান (ইজি বাইকের মতো কিছু একটাতে পাখা লাগিয়ে দিয়েছেন) বানিয়েছেন। তার দাবী বিমানটি আকাশে উড়বে। এ নিয়ে পত্রিকায় সংবাদও ছাপা হয়েছে। কিন্তু কোনো সংবাদেই দেখলাম না বিমানটি উড়তে।

সংবাদের সব ছবিই দেখলাম বিমানটি মাটিতেই বসা আছে। তারপর সেই বিমানের (তথাকথিত) আর কোনো খবর পাইনি। আসলে আমরা অনেকেই কিছু না বুঝেই মন্তব্য, আলোচনা, সমালোচনা, কাউকে হিরো আবার কাউকে জিরো বানাতে সময় নিই না (অনেকটা জোয়ারের নৌকায় পাল তুলে দেয়ার মতো)।

গাজী মুনছুর আজিজ : সাংবাদিক ও লেখক।
gazimunsuraziz@gmail.com

Recent Posts

Leave a Comment