ভোটযুদ্ধে প্রস্তুত নারায়ণগঞ্জ

 In দেশের ভেতর, বিশেষ প্রতিবেদন
ভোটযুদ্ধে প্রস্তুত নারায়ণগঞ্জ

জনতার স্রোতে গতকাল আইভীর ভোটপ্রার্থনা (বাঁয়ে), ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে রাজপথে সাখাওয়াত, ব্যালট বাক্স সরবরাহে কর্মীদের ব্যস্ততা

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে কাল ভোট গ্রহণ। প্রস্তুত নির্বাচন কমিশন।

প্রস্তুত নারায়ণগঞ্জ। আর দেশবাসীর দৃষ্টিও তাই নারায়ণগঞ্জে। নির্বাচন ঘিরে কিছুটা উত্তেজনা থাকলেও সর্বত্র নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে রয়েছেন বিজিবি, র‍্যাব ও পুলিশের সদস্যরা। থাকবে চার স্তরের নিরাপত্তাবলয়। কেউ ভোট কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করলে গুলি চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থায় আজ ভোট কেন্দ্রগুলোয় ব্যালট বাক্স, ব্যালট পেপারসহ নির্বাচনী সামগ্রী পাঠানো হবে। নির্বাচন কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জজুড়ে এখন উৎসবের আমেজ। গত মধ্যরাত পর্যন্ত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রচারণায় উত্তাল ছিল এই বন্দরনগরী। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঘাম ঝরিয়েছেন দুই হেভিওয়েট মেয়র প্রার্থী আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভী ও বিএনপি সাখাওয়াত হোসেন খান। এরই মধ্যে সোমবার মধ্যরাত থেকে বহিরাগতরা নারায়ণগঞ্জ ছেড়েছেন। গত মধ্যরাত থেকে সব ধরনের প্রচারণা নিষিদ্ধ। ভোটযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নারায়ণগঞ্জ। কার ভাগ্যে আছে শেষ হাসি— এখন কেবলই দেখার অপেক্ষা। ভোটের দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। আজ মধ্যরাত থেকে আগামীকাল মধ্যরাত পর্যন্ত নৌযান, স্থলযান, বেবিট্যাক্সি, অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পো, ইজিবাইকসহ সব যানবাহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে সেখানে। এ ছাড়া সোমবার থেকেই মোটরসাইকেল চলাচলে চলছে নিষেধাজ্ঞা। তবে নির্বাচনে প্রার্থী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, অনুমতিপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক, সাংবাদিকসহ নির্বাচনী এজেন্টদের জন্য এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না। একইভাবে জাতীয় মহাসড়কেও এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না। মহিলা, প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক ভোটারদের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারে কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ছিল। তারা মিছিল-শোডাউন করেছেন। অনেকের বিরুদ্ধে কালো টাকা ছড়ানোর অভিযোগও ছিল। কয়েকজনকে জরিমানাও করেছে নির্বাচন কমিশন। ভোটের দিন কাউন্সিলরদের নিয়েই উত্তপ্ত পরিবেশ বিরাজ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রশাসনের। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে ২৭টি সাধারণ ও ৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড রয়েছে। মোট ভোটার ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৩৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৪১ হাজার ৬৭৫ আর নারী ২ লাখ ৩৬ হাজার ৬৪ জন। কেন্দ্র ১৭৪টি। নির্বাচনে মেয়র পদে ৭, সাধারণ কাউন্সিলর ১৫৬ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আগামীকালের ভোট নিয়ে সরকারি তোলারাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সহকারী অধ্যাপক জীবন কৃষ্ণ মোদক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসবের পাশাপাশি উদ্বেগও বিরাজ করছে। তবে এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন। সবাই সবাইকে চেনেন। নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে। নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি রয়েছে। দুপুরে শহরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে গণসংযোগকালে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘প্রচারণার আজ শেষ দিন। আর কারও অভিযোগ শুনব না। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও করব না। আমিও চাই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হোক। ’ তবে নির্বাচনের শেষ দিনেও শঙ্কার কথা জানিয়েছেন ধানের শীষের মেয়র প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান। নগরীর মাসদাইরে গণসংযোগকালে তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু ভোট নিয়ে আমি এখনো শঙ্কায় আছি। নির্বাচনের শুরু থেকেই সেনা মোতায়েন চেয়েছিলাম। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তা করেনি। এ কারণেই ভোটারদের মধ্যে এখনো উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা বিরাজ করছে। ’ এদিকে গত মধ্যরাত পর্যন্ত নগরীর অলিগলি ছিল প্রচারে মুখরিত। মিছিল, শোডাউন, লিফলেট বিতরণ আর মাইকের স্লোগানে উত্তপ্ত ছিল নগরী। সরেজমিনে শহরের চাষাঢ়া, বিবি রোড, ডিআইটি রোড, ২ নম্বর রেলগেট, কালিবাজার, খানপুর, সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি বাতেনপাড়া, সিআই খোলা, হীরাঝিল, আদমজী কদমতলী, বন্দরের মুরাদপুর, চাপাতলি, কুড়িপাড়া, ইস্পাহানি, নবীগঞ্জ, মদনগঞ্জসহ ২৭টি ওয়ার্ডেই চলছে জোর প্রচারণা। মেয়র প্রার্থীদের তুলনায় সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রচারই বেশি লক্ষ্য করা গেছে। হাজার হাজার সমর্থক নিয়ে মিছিল করেন তারা। সেলিনা হায়াৎ আইভী গতকাল দেওভোগ এলএন রোড, নতুন পালপাড়া মোড়, কাঠের দোতালা, দেওভোগ পাকা রোড বড় মসজিদ, পুরাতন দেওভোগ পাকা রোড, খানকা রোড, জামাল উদ্দিন সড়ক, গার্মেন্টস গলিসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে নিজ বাড়িতে এসে গণসংযোগ শেষ করেন। বিএনপি প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান সকালে শহরের মাসদাইরে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপি সভাপতি তৈমূর আলম খন্দকারের বাসায় বৈঠক করেন। পরে তিনি নেতাদের নিয়ে শহরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাইকপাড়া, জল্লারপাড়ে গণসংযোগ করেন। গতকাল ইশতেহার ঘোষণা করেছেন ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী মুফতি মাসুম বিল্লাহ। এ ছাড়া বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির মেয়র প্রার্থী মাহবুবুর রহমান ইসমাইল ও ইসলামী ঐক্য জোটের মুফতি ইজহারুল হক নগরীর বিভিন্ন স্থানে গণসংযোগ করেন।টাকা ছড়ানোর অভিযোগ : বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধে টাকা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। অর্থশালী প্রার্থীদের লোক ভোট কিনতে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ধরনা দিচ্ছেন। নগদ অর্থ ছাড়াও ভোটারদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে শাড়ি, লুঙ্গি, টি-শার্ট, থ্রিপিসসহ নানা উপহারসামগ্রী। ভোট কিনতে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ও সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ উঠেছে, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের এক কাউন্সিলর প্রার্থী ২ থেকে ৩ হাজার টাকা দিয়ে ভোট কিনছেন। এই প্রার্থীর পক্ষে ভোট নিতে নগদ টাকাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ ছুঁয়ে শপথ করানো হচ্ছে ভোটারদের। ১ নম্বর ওয়ার্ডে এক প্রার্থী বহিরাগত লোকদের টাকা দিয়ে ভোট কিনছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে রিটার্নিং অফিসার নুরুজ্জামান তালুকদার জানান, ‘২৭টি ওয়ার্ডে ২৭ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত রয়েছেন। কোনো অনিয়মের অভিযোগ পেলে তত্ক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নির্বাচনী প্রচারে যেতে না দেওয়ায় গতকাল ইসির কাছে নালিশ করেছে দলটি। বিদায়ের আগে ভালো নির্বাচন করার ব্যবস্থা নিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে তারা। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল শেরেবাংলানগর ইসি কার্যালয়ে সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ অভিযোগ করেন।

বিশেষ নজরদারিতে ১৩৭ কেন্দ্র : নাসিক নির্বাচনে ১৩৭টি কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ, যা মোট কেন্দ্রের শতকরা ৭৯ ভাগ। একটি গোয়েন্দা সংস্থা ওই কেন্দ্রগুলোয় গোলযোগের শঙ্কা করছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা জানান, ১৭৪ ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ১৩৭টিকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। নগরীর ১৭৪টি কেন্দ্রের সবখানে ২৪ জন করে নিরাপত্তা সদস্য নিয়োজিত রাখা হলেও ১৩৭টি কেন্দ্রকে বিশেষ নজরে রাখা হবে। ভোট কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা হলে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান। গতকাল দুপুরে নারায়ণগঞ্জের মাসদাইর পুলিশ লাইনস এলাকায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানিয়ে বলেন, আইনে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষায় গুলি চালানোর বিধান রয়েছে। নির্বাচনে কেউ কেন্দ্র দখল ও ব্যালট বাক্স ছিনতাই বা জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি ছুড়বে। যদি কোনো পুলিশ সদস্য গুলি না ছোড়েন তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনের চাহিদার অতিরিক্ত ফোর্স দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজন হলে আরও দেওয়া হবে। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, কে সরকারি বা বিরোধী দল তা দেখার সময় নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন, নাগরিকদের নিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব পদক্ষেপ নেবে। এদিকে নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মাঠে নেমেছেন ২২ প্লাটুন বিজিবি সদস্য। এর মধ্যে ১০ প্লাটুন থাকবে সিদ্ধিরগঞ্জে। এ ছাড়া শহর এলাকায় ৭ প্লাটুন ও বন্দর এলাকায় ৫ প্লাটুন বিজিবি থাকবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে পুলিশের ৩টি করে মোট ৮১টি টিম টহলে থাকবে। প্রতিটি টিমের সদস্য হবেন ১২ জন। ভোট গ্রহণকালে শিল্পপুলিশের ২০০ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। পুলিশের ৪ হাজার, র‍্যাবের ৬০০, বিজিবির ২২ প্লাটুন, কোস্টগার্ড ৩ প্লাটুন, আনসারসহ প্রায় সাড়ে ৯ হাজার সদস্য মাঠে থাকবেন। ভোটের পরদিন পর্যন্ত তারা দায়িত্ব পালন করবেন। ভোট কেন্দ্রে অস্ত্রসহ পুলিশ ৭, অস্ত্রসহ ব্যাটালিয়ন আনসার ৩, অঙ্গীভূত আনসার/ভিডিপির ১৪— মোট ২৪ জন সদস্য থাকবেন। নির্বাহী হাকিম ৫ ডিসেম্বর থেকে মাঠে রয়েছেন ২৭টি ওয়ার্ডে। সরেজমিনে দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জের প্রবেশদ্বার, নারায়ণগঞ্জ শহর, বন্দর ও সিদ্ধিরগঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বসানো হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক চৌকি। পাড়া-মহল্লায় র‍্যাব-পুলিশ ও বিজিবি টহল দিচ্ছে।

 

Recent Posts

Leave a Comment