গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ঘরে আগুন : কারা দায়ী, জানাতে হাইকোর্টের নির্দেশ

 In জাতীয়

 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও চিত্রের একটি দৃশ্য l ছবি: সংগৃহীতগাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ এলাকায় সাঁওতালদের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় কারা জড়িত এবং এতে পুলিশের কোনো সদস্য জড়িত কি না, তা তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। তদন্ত করে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিমকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত বলেছেন, ‘সম্পূরক আবেদনে গণমাধ্যমে আসা যেসব ছবি দেওয়া হয়েছে, তা দেখে আমরা চোখ বন্ধ করে থাকতে পারি না।’
আগুন দেওয়ার ওই ঘটনায় পুলিশ সম্পৃক্ত বলে সম্প্রতি গণমাধ্যমে আসা খবর যুক্ত করে রিট আবেদনকারীদের দাখিল করা এক সম্পূরক আবেদনের শুনানির পর গতকাল বুধবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
হাইকোর্টের এই আদেশে স্থানীয় সাঁওতালরা খুশি। তারা বলছে, এখন পুলিশের দায়িত্ব ভিডিও চিত্র দেখে ওই ঘটনার জন্য কারা দায়ী তা খুঁজে বের করা।
ওই হামলার ঘটনায় গোবিন্দগঞ্জ থানায় গত ১৬ নভেম্বর স্বপন মুর্মুর করা অভিযোগ (যেটি মামলা) এবং ২৬ নভেম্বর থমাস হেমব্রেমের করা অভিযোগ (যেটি সাধারণ ডায়েরি) একই বিবেচনায় পুলিশের ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পদস্থ কর্মকর্তা দিয়ে তদন্তের জন্য রংপুর রেঞ্জের পুলিশের উপমহাপরিদর্শককে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত বলেছেন, পুলিশ সুপারের নিচে নয় এমন পদমর্যাদার কর্মকর্তা তদন্ত কার্যক্রম তদারক করবেন। পরবর্তী আদেশের জন্য ৮ জানুয়ারি দিন ধার্য করেছেন আদালত।

গত ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জে রংপুর চিনিকলের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। সাঁওতালরা তাদের ওপর হামলা, ঘরে আগুন দেওয়া, পুরোনো বসতবাড়িতে লুটপাট ও হত্যার অভিযোগ করে। এ ঘটনায় সাঁওতালদের পক্ষে থানায় পৃথক অভিযোগ করা হয়। এর মধ্যে একটি সাধারণ ডায়েরি হিসেবে, অন্যটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। এ ছাড়া ঘটনার দিন পুলিশ বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করে।

এদিকে ওই ঘটনায় হাইকোর্টে পৃথক রিট হয়েছে। এর মধ্যে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), ব্রতী সামাজিক কল্যাণ সংস্থা ও অ্যাসোসিয়েশন অব ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ১৭ নভেম্বর হাইকোর্ট রুলসহ অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেন। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে থমাস হেমব্রেমের করা অভিযোগ (সাধারণ ডায়েরি) এজাহার হিসেবে গণ্য করতে আবেদন করে এই তিন সংগঠন। ওই ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে রিট করেন আহত দ্বিজেন টুডুর স্ত্রী অলিভিয়া হেমব্রেম ও গণেশ মুর্মুর স্ত্রী রুমালিয়া কিসকু।

৬ নভেম্বর আগুন লাগানোয় পুলিশের সম্পৃক্ততা নিয়ে ১৩ ডিসেম্বর কয়েকটি জাতীয় দৈনিকসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে করা সম্পূরক আবেদনটি দাখিল করেন রিট আবেদনকারী তিন সংগঠনের আইনজীবী আবু ওবায়দুর রহমান। তিনি বলেন, এখানে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ কীভাবে সাঁওতালদের বাড়িতে আগুন দিচ্ছে। ওই ঘটনায় থমাস হেমব্রেম অভিযোগ করেন, যেখানে বিস্তারিত ও স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছ, সেখানে এটি সাধারণ ডায়েরি হিসেবে নেওয়া হয়েছে।

এরপর রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ওপর হামলার ঘটনা তদন্তে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গঠিত কমিটির তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন, পর্যবেক্ষণ ও পাঁচ দফা সুপারিশ তুলে ধরেন। গতকাল শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন। প্রতিবেদনে পাঁচ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, সংখ্যালঘু সাঁওতাল সম্প্রদায়ের প্রতি সব সময় সহানুভুতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও পুলিশকে বলা যেতে পারে; সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ করে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরাজমান আতঙ্ক দূর করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও শিক্ষকসমাজকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের যথাযথ মানবিক সহায়তা প্রদান করতে হবে; সাঁওতাল সম্প্রদায় ও অন্যদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং আত্মরক্ষামূলক বিষয়ে আরও দক্ষতা অর্জন করে পুলিশকে এ রকম ঘটনায় আরও কোমল, নমনীয় ও মানবিক হতে হবে।

সাঁওতালদের মধ্যে স্বস্তি

গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, বিচারককে তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার খবর শুনে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামের সাঁওতালদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। তারা আশা করছে, সুষ্ঠুভাবে তদন্ত হবে।

গতকাল মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামে গিয়ে জানা যায়, স্থানীয় সাঁওতালরা হাইকোর্টের নির্দেশের কথা শুনেছে। জানতে চাইলে জয়পুর গ্রামের ভিরজিউলিশ হেমব্রেম (৪৫) বললেন, বিচারক তদন্ত করবেন শুনে তাঁরা খুশি হয়েছেন। মাদারপুর গ্রামের দুলাল হাসদা (৪০) বলেন, ‘আমাদের নেতা ফোন করে বলেছেন, এখন সুষ্ঠুভাবে তদন্ত হবে, আমরা বিচার পাব।’ একই গ্রামের মোসেস মারানডি (৪২) বলেন, ‘এ খবর শুনে আমাদের সব লোকজন খুশি হয়েছে। তবে চিনিকল নিজেরা পিলার ভেঙে আমাদের দোষ দিচ্ছে। আমরা ভয়ে আছি।’ এ প্রসঙ্গে সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ইক্ষু খামার জমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহসভাপতি ফিলিমিন বাস্কে মুঠোফোনে বলেন, ঘটনার পর থেকে আমরা বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করে আসছি। বিচারককে তদন্তের নির্দেশ দেওয়ায় সবাই স্বস্তি পাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কাঁটাতারের পিলার ভাঙার পর আমাদের লোকজনের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। চিনিকল সাঁওতালদের হয়রানির চেষ্টা করছে।

 এদিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটে পুলিশের আগুন লাগানোর ভিডিও চিত্র দেখানো হলে বিভিন্ন মহলে আলোচনার ঝড় ওঠে। তবে সাঁওতালদের ঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনায় কোন পুলিশ সদস্য জড়িত, গতকাল পর্যন্ত সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ৬ নভেম্বর পুলিশের দল গুলি ছুড়তে ছুড়তে সাঁওতালদের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। পরে তাদের মধ্য থেকে ঘরে আগুন লাগানো হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাহেবগঞ্জ এলাকার এক কৃষক বলেন, ‘আমরা কাছ থেকে ঘটনার দিন পুলিশকে আগুন দিতে ও ছোটাছুটি করতে দেখেছি। কিন্তু সব পুলিশের মাথায় হেলমেট ও গায়ে জ্যাকেট থাকায় কাউকে চেনা যায়নি। তবে গোবিন্দগঞ্জ থানার পুলিশকে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে।’ এ প্রসঙ্গে সাঁওতাল নেতা ফিলিমিন বাস্কে বলেন, ‘ওই ভিডিও চিত্রে স্পষ্ট দেখা যায়, পুলিশ আমাদের ঘরে আগুন দিচ্ছে। ঘটনাটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। পুলিশকেই ভিডিও চিত্র দেখে বের করতে হবে, সেদিন কারা দায়িত্বে ছিল।’

জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, গোবিন্দগঞ্জ থানাসহ গাইবান্ধার সাতটি থানার পুলিশ, গাইবান্ধা পুলিশ লাইন থেকে রিজার্ভ পুলিশ ও ডিবি ৬ নভেম্বর সাঁওতালদের উচ্ছেদ অভিযানে অংশ নেয়। গোবিন্দগঞ্জ থানার কারা ঘটনার দিন অভিযানে অংশ নেয়, তা বলতে অস্বীকৃতি জানান ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা (ওসি) সুব্রত সরকার। গাইবান্ধার পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ভিডিও চিত্রের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

কাঁটাতারের পিলার ভাঙচুর: গত মঙ্গলবার ভোররাতে বাণিজ্যিক খামারের কাঁটাতারের বেড়ার ২৬টি পিলার ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। ওই দিন সকালে স্থানীয় লোকজন সাহেবগঞ্জ বাণিজ্যিক খামারসংলগ্ন জয়পুর গ্রামের দক্ষিণ অংশে কিছু পিলার ভাঙচুর অবস্থায় জমিতে পড়ে থাকতে দেখে চিনিকল কর্তৃপক্ষকে খবর দেয়। এ ব্যাপারে সাহেবগঞ্জ বাণিজ্যিক খামারের উপব্যবস্থাপক হুমায়ন কবির বাদী হয়ে ১৩ জনকে আসামি করে গোবিন্দগঞ্জ থানায় মামলা করেন। রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল আউয়াল বলেন, ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার টাকা।

মামলার পরিস্থিতি: এ ঘটনায় মোট তিনটি মামলা হয়। এর মধ্যে ঘটনার দিন রাতে পুলিশ বাদী হয়ে সরকারি কাজে বাধা দেওয়ায় ৪২ জনের নাম উল্লেখ করে ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে মামলা করে। এ মামলায় চারজন সাঁওতালকে গ্রেপ্তার করা হলেও পরে তাঁরা জামিন পান। স্থানীয় সাংসদ আবুল কালাম আজাদ ও ইউপি চেয়ারম্যান শাকিল আহম্মেদকে অভিযুক্ত করে থমাস হেমব্রেম বাদী হয়ে ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে এই মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় এক মাসেও কেউ গ্রেপ্তার নেই। গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুব্রত সরকার বলেন, মামলাগুলোর তদন্ত করা হচ্ছে।

গত ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রংপুর চিনিকলের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিরবিদ্ধ নয়জন ও গুলিবিদ্ধ হন চারজন। এই সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন সাঁওতাল নিহত হন।

Recent Posts

Leave a Comment