তথ্যমন্ত্রী নাকি সাংবাদিকতার শিক্ষক? : প্রভাষ আমিন

 In খোলা কলাম

তথ্যমন্ত্রী নাকি সাংবাদিকতার শিক্ষক?

মাঠের রাজনীতি থেকে ধাপে ধাপে শীর্ষে পৌঁছেছেন যে ক’জন, তাদের মধ্যে হাসানুল হক ইনু একজন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন থেকে হাসানুল হক ইনুকে মাঠে দেখে এসেছি। মাঠের রাজনীতিবিদদের সাথে সাংবাদিকদের সম্পর্ক সবসময়ই চমৎকার থাকে। তবে মাঠের রাজনীতিবিদদের মধ্যে সাংবাদিকদের সাথে হাসানুল হক ইনুর সম্পর্ক একটু বেশিই ভালো।

ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ান হাসানুল হক ইনুর দলীয় রাজনৈতিক আদর্শের সাথে আমার প্রবল ভিন্নমত রয়েছে। কিন্তু রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি তাকে বরাবরই খুব পছন্দ করি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের একজন মাঠের কর্মী হিসেবে সে আন্দোলনের আপসহীন নেতা হাসানুল হক ইনু আমার পছন্দের। তারচেয়ে বেশি পছন্দের এরশাদ পতনের পর হাসানুল হক ইনুর করা মামলার কারণে। এরশাদের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল বন্দুকের মুখে সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতাদখল।

এরশাদ রাডার কিনতে দুর্নীতি করেছেন কি করেননি, সেটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের তখন মাথাব্যথা ছিল না। এরশাদ পতনের পর তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে মামলা হয়েছে। এই মামলাগুলোই হলো এরশাদকে নিয়ন্ত্রণের কৌশল। এরশাদ বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। কিন্তু তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা বিচারাধীন। জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে সংসদের প্রধান বিরোধী দল, আবার সরকারেরও অংশ। তবুও মাঝে মাঝে এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লবী কথাবার্তা বলেন।

যখনই বেশি বিপ্লবী কথা বলেন, তখন কোনো একটি মামলা নড়াচড়া শুরু হয়। এরশাদের বিপ্লবও ফুরিয়ে যায়। পোষ মেনে কুঁই কুঁই করেন। তবে এসব মামলা নয়, এরশাদের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘণের মূল মামলাটি করেছিলেন হাসানুল হক ইনু। সেই মামলাটিরও কিছু হয়নি। কিন্তু অন্তত কেউ একজন আমাদের আন্দোলনের আবেগটুকু ধরতে পেরেছিলেন এবং মামলা করে ইতিহাসে তার চিহ্ন রেখেছেন, এই কারণে হাসানুল হক ইনুর প্রতি আমার সারাজীবনের কৃতজ্ঞতা।

জাসদের পচাত্তর পূর্ব রাজনীতির প্রবল সমালোচক আমি। আমি বিশ্বাস করি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের গঠন প্রক্রিয়ার সময় জাসদ থানা লুট, পাটের গুদামে আগুন, এমপি হত্যা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও, ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণ চেষ্টা, সর্বশেষ ৭৫এর ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের নামে হঠকারিতা করে দেশকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। জাসদের সেই সহিংস হঠকারিতার সময়ও নেতৃত্বের কাতারেই ছিলেন হাসানুল হক ইনু।

৭ নভেম্বর জাসদের ব্যর্থ বিপ্লবের পথ ধরে ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। জাসদের ওপর নেমে আসে নিপীড়নের স্টিম রোলার। বারবার ভাঙনের মুখে পড়ে জাসদ। এতকিছুর পরও জাসদের মূল ধারাটি টিকে আছে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বেই। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে বিপ্লবের স্বপ্ন ভুলে জাসদ গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বেই।

আবার জামায়াতের সাথে জোট করে ক্ষমতায় এসে বিএনপি যখন যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে পতাকা তুলে দেয়, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যখন উত্থান ঘটে জঙ্গীবাদের; তখনও মাঠে নামেন হাসানুল হক ইনু। আওয়ামী লীগের সাথে ১৪ দলীয় জোটের অংশীদার হিসেবে জাসদ জঙ্গীবাদ বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৪ দলীয় জোট গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল হাসানুল হক ইনুর। ১৪ দলীয় জোট যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জঙ্গীবাদবিরোধী আন্দোলনকে টেনে নেয় নির্বাচন পর্যন্ত। নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল।

জাসদও ছিল সেই ক্ষমতার অংশীদার। দেরিতে হলেও মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পান হাসানুল হক ইনু। তিনি যখন তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন, আমার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হয়নি। সাংবাদিকবান্ধব একজন মাঠের রাজনীতিবিদ তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন, সাংবাদিকদের জন্য এরচেয়ে বেশি আনন্দের আর কি হতে পারে। দায়িত্ব পালনেও তিনি দারুণ সফল। সাংবাদিকদের যে কোনো প্রয়োজনে তার দুয়ার সব সময় খোলা।

ক’দিন আগে ভারতীয় চ্যানেলে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন পাচারের বিরুদ্ধে মিডিয়া ইউনিটির আন্দোলনেও তিনি সাংবাদিকদের পাশেই ছিলেন। তার ত্বরিৎ ব্যবস্থার কারণে অল্প সময়েই সাফল্য পায় মিডিয়া ইউনিটি, বন্ধ হয় বিজ্ঞাপন পাচার।

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর প্রতি আমার মুগ্ধতা এখনও কমেনি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ধারণাটা দারুণভাবে প্রতিপালন করে যাচ্ছেন তিনি। দীর্ঘদিনের পরিচয়-সম্পর্কের সুবাদে হাসানুল হক ইনুর মুখের ওপর সত্য কথাটা বলে দেয়া যায়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের সম্প্রচার নীতিমালা সাংবাদিকরা তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল।

আমি অনেকবার বিভিন্ন ইস্যুতে তথ্যমন্ত্রীর সাথে ভিন্নমত পোষণ করে লিখেছি, এমনকি একই অনুষ্ঠানে বলেছিও। কিন্তু তথ্যমন্ত্রী সেই ভিন্নমতকে গ্রহণ করেছেন দারুণ স্পোর্টিং স্পিরিটে। ভিন্নমতের কারণে তার সাথে কারো সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে বলে শুনিনি।

কিন্তু হাসানুল হক ইনু তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী নাকি সাংবাদিকতার শিক্ষক, আমি মাঝে মধ্যেই দ্বিধায় পড়ে যাই। তিনি প্রায়শই সাংবাদিকদের এথিক্স ও পেশাদারিত্ব শেখান। এটা তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কিনা, তা নিয়েও আমি সন্দিহান। আমি যতদূর জানি, একাডেমিক পড়াশোনায় জনাব হাসানুল হক ইনু একজন প্রকৌশলী। কিন্তু তিনি কখনোই সেই বিদ্যা কাজে লাগাননি। তিনি একজন ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ান। কিন্তু তিনি যখন আমাদের সাংবাদিকতা শেখাতে আসেন, তখন আমাদের অস্বস্তি হয়।

গত ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভবন থেকে ৫টি রাজনৈতিক দলকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়। ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। তাই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করতেই রাষ্ট্রপতি প্রথম দফায় বিএনপি, জাতীয় পার্টি, এলডিপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং জাসদকে ডেকেছেন। খবরটি শোনার সাথে সাথে এটিএন নিউজ থেকে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতিক্রিয়া আনার দায়িত্ব দেয়া হয়। সিনিয়র রিপোর্টার আরাফাত সিদ্দিকীর দায়িত্ব ছিল জাসদের প্রতিক্রিয়া আনার।

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু একই সঙ্গে জাসদের সভাপতিও। আরাফাত খোঁজ নিয়ে জানলো তথ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেবেন। তাই প্রতিক্রিয়া নিতে আরাফাত মূল শহর থেকে অনেকটাই বাইরে বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে ছুটে গেলেন।

জাসদ সভাপতির কাছে রাষ্ট্রপতির সংলাপের আমন্ত্রণের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া চাইতেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন মাননীয় তথ্যমন্ত্রী। প্রতিক্রিয়া তো দেনইনি। উল্টো সবার সামনে আরাফাত সিদ্দিকীকে বলেন, ‘আপনারা এক অনুষ্ঠানে এসে আরেক প্রসঙ্গে বক্তব্য নেন। এটা কেমন ধরনের পেশাদারিত্ব হলো।’তথ্যপ্রযুক্তির অনুষ্ঠানে এসে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া চাওয়াটাই মাননীয় মন্ত্রীর দৃষ্টিতে সাংবাদিক হিসেবে আরাফাতের পেশাদারিত্বের ঘাটতি। আমি মাননীয় তথ্যমন্ত্রীর স্পিরিটের সাথে একমত।

আমি জানি আমাদের দেশে সাংবাদিকদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা যথাযথ প্রস্তুতি না নিয়েই মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কখনো সিঁড়ির গোড়ায়, কখনো লিফটের সামনে পথ আগলে দাঁড়িয়ে প্রতিক্রিয়া চাই। আমিও মানছি, এক অনুষ্ঠানে গিয়ে অন্য বক্তব্য চাইলে মূল অনুষ্ঠান আড়ালে পড়ে যায়। কিন্তু এই প্রবণতা তো নতুন নয়। আরাফাত সেদিন প্রথম এই ‘অপরাধ’টি করেনি। সাংবাদিকরাও যেমন যেখানে সেখানে পথ আগলে দাঁড়ান, রাজনীতিবিদরাও তেমনি যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেন। হয়তো এটা হওয়া উচিত নয়।

কিন্তু এটাই এখন বাংলাদেশের রীতি হয়ে গেছে। সম্পদে, সামর্থ্যে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয়। তাই চাইলেও আলাদা আলাদা করে প্রতিক্রিয়া নেয়া সম্ভব হয় না। আর হাসানুল হক ইনু নিশ্চয়ই তথ্যমন্ত্রী হিসেবে অনুষ্ঠান শেষ করে জাসদ সভাপতি হিসেবে প্রতিক্রিয়া জানাতে বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর কার্যালয়ে ছুটে যাবেন না। যদি তিনি যান, তাহলে আমরাও যাবো। নইলে আমরা জাসদের প্রতিক্রিয়া কিভাবে পাবো, সেটা কি বলে দিতে পারেন জনাব হাসানুল হক ইনু?

আওয়ামী লীগের সাথে জোট বেঁধে নির্বাচন করেছে বলেই জাসদ আজ ক্ষমতার কাছাকাছি। জাসদ সভাপতি আজ তথ্যমন্ত্রী। একা নির্বাচন করলে বাংলাদেশে জাসদ জাতীয় সংসদে কোনো আসনই পাবে না, এটা নিশ্চিত। আর তেমন হলে সাংবাদিকরাও জাসদ সভাপতির প্রতিক্রিয়ার জন্য বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে ছুটে যেতেন না। প্রথম দফা যে ৫টি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, সাংবাদিকরা তো তাদের মধ্যে এলডিপি বা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কারো প্রতিক্রিয়া আনতে যায়নি।

ভবিষ্যতে জাসদ কখনো একা নির্বাচন করলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের গুরুত্ব এলডিপি বা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের চেয়ে বেশি হবে বলে হয় না। হাসানুল হক ইনু আজ পদাধিকারবলে মিডিয়ার মনোযোগ পান। কিন্তু এই জাসদ নেতারাই একটু কাভারেজের জন্য, নিকট অতীতে ক্যামেরার জন্য কাঙালের মত বসে থাকতেন।

এবারই প্রথম নয় হাসানুল হক ইনু প্রায়শই সাংবাদিকদের এথিক্স, পেশাদারিত্ব, দায়িত্বশীলতা শেখান। আমরা জানি আমাদের অনেক ঘাটতি আছে। বাংলাদেশে যেমন সাংবাদিকদের ঘাটতি আছে, তেমনি রাজনীতিবিদদেরও নানা সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু আমরা কখনোই রাজনীতিবিদদের এথিক্স বা কোথায় কী বলতে হবে, কতটুকু বলতে হবে তা শেখাতে যাই না।

হাসানুল হক ইনু তথ্যমন্ত্রী হয়ে কেন তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়েছেন, তা নিয়ে কি আমরা প্রশ্ন তুলেছি? রাজনীতিবিদরা যে প্রায়শই ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গান, হাসানুল হক ইনু যে বাংলাদেশের সব ঘটনার জন্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে দায়ী করেন; আমরা কি কখনো তাকে এ নিয়ে কিছু বলেছি?

রাজনীতিবিদরা ওনাদের কথা বলবেন, আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় অংশটুকু নেবো। তেমনি সাংবাদিকদেরও তাদের কাজ করতে দিতে হবে। মাননীয় তথ্যমন্ত্রী যদি বলতেন, আমি এই বিষয়ে কথা বলবো না বা এখানে বলবো না। আমাদের কোনো আপত্তি থাকতো না। কিন্তু তিনি সবার সামনে তার বক্তব্য নিতে অত দূরে ছুটে যাওয়া একজন রিপোর্টারকে সাংবাদিকতা না শেখালেও পারতেন। এটা দৃষ্টিকটু ও অশোভনীয়।

হাসানুল হক ইনু প্রকৌশল বিদ্যায় পড়াশোনা করে মন্ত্রী হলেও আরাফাত সিদ্দিকী কিন্তু সাংবাদিকতায় পড়েই সাংবাদিক হয়েছেন। হাসানুল হক ইনু অনেক দক্ষ, যোগ্য; রাজনীতির জন্য তার ত্যাগ অপরিসীম। কিন্তু আমি নিশ্চিত আরাফাত সিদ্দিকী অন্তত সাংবাদিকতাটা হাসানুল হক ইনুর চেয়ে ভালোই জানেন।

প্রভাষ আমিন : সাংবাদিক, কলাম লেখক।
probhash2000@ gmail. com

সূত্র : পরিবর্তন ডটকম।

Recent Posts

Leave a Comment