তারকাদের কাছের যোদ্ধার গল্প

 In বিনোদন

আদর রহমান, হাবিবুল্লাহ সিদ্দিক ও নাদিয়া মাহমুদ

মুক্তির গানের দৃশ্যএ সময়ের তরুণদের হাতেই ভবিষ্যৎ। সেই সঙ্গে ঐতিহ্যের প্রাচুর্যও তো তাঁদের বয়ে নিয়ে যেতে হবে সামনে। অতীত দৃষ্টান্ত ও কিংবদন্তি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবেন তাঁরা। তাই আজ এ প্রজন্মের কয়েকজন শিল্পীর কাছেই তাঁদের নিজ পরিবারের কিংবদন্তিসম মুক্তিযোদ্ধার ব্যাপারে জানতে চাওয়া। শিল্পী পরিবারের সেই সদস্যের গল্পই তাঁরা আজ বললেন, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় রেখেছেন সাহসী ভূমিকা, যাঁর গল্প এখনো অনুপ্রাণিত করে শিল্পীদের। বিভিন্ন অঙ্গনের তরুণ তারকাদের সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন

আদর রহমান, হাবিবুল্লাহ সিদ্দিক নাদিয়া মাহমুদ

আফরান নিশোবঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে নিশোর বাবা যুদ্ধে চলে যান
‘আমার বাবা যুদ্ধ করেছেন ১১ নম্বর সেক্টরে। ওনার কাছে থেকে আমি ছোটবেলায় শুধু না, বড় হয়েও অনেক গল্প শুনেছি।’ এভাবেই কথা শুরু করলেন অভিনেতা আফরান নিশো। তাঁর বাবা আব্দুল হামিদ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেই যুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। নিশোর কথায় স্পষ্ট, বাবার গল্পটা তাঁর কত চেনা। বলেন, ‘বাবা অনেক অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন। সেসব গল্প শুনেছি। একবার নদীতে পাক হানাদার বাহিনীর নৌবহরে হামলা চালান বাবা ও তাঁর সঙ্গীরা। সফল অপারেশনে জয়ী হন তাঁরা। আরেক ঘটনায় বাবাসহ সবাইকে অনেকক্ষণ কচুরিপানাওয়ালা পুকুরে ডুবে থাকতে হয়।’
এই সময়ের স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসসংশ্লিষ্ট নাটকে অভিনয় করতে গেলে প্রায়ই বাবার গল্পগুলো মনে পড়ে তাঁর। বলেন, ‘এই ঘটনাগুলি আমার জন্য বেশ সহায়ক হয়। ওই অনুভূতি নিয়ে অভিনয় করতে পারি।

পূজা সেনগুপ্তদাদু আর ঠাকুরদাকে নিয়ে এখনো গর্ব করেন পূজা
নৃত্যশিল্পী পূজা সেনগুপ্তের ঠাকুরদা (দাদা) সুখেন্দ্র বিকাশ সেনগুপ্ত ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীর সদস্য ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে সেই চাকরি ছেড়ে দেন তাঁর ঠাকুরদা, যোগ দেন যুদ্ধে। পূজার নানা চরেন্দ্র কুমার সরকারেরও মুক্তিযুদ্ধে ছিল অনন্য অবদান। পূজা বলেন, সে সময় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে থাকতেন তাঁর নানা। তিনি ছিলেন একজন প্রভাবশালী স্থানীয় রাজনীতিক। যুদ্ধ শুরু হলে তাঁর প্রাণনাশের হুমকি আসে। কিন্তু এরপরও দেশ ছেড়ে যাননি তিনি। তবে একসময় পরিবারের সদস্যদের অনুরোধে ভারতে যেতে হয় পূজার মাসহ পুরো পরিবারকে। তখন পূজার নানা সেখানে গিয়ে শরণার্থীশিবিরে ৭০০ টাকার বিনিময়ে রিলিফ সুপারিনটেনডেন্টের চাকরি পান। পূজা গর্বভরা কণ্ঠে বলেন, ‘দাদু (নানা) আর ঠাকুরদার এই গল্পগুলো শুনে শুনে বড় হয়েছি। তাঁদের সেই অবদানের গল্প আজও অনুপ্রাণিত করে।
কোনালকেরানীগঞ্জ থেকে হেঁটে ভারতের সীমানায়
সংগীতশিল্পী কোনালের দাদা ও নানা দুজনেই মুক্তিযোদ্ধা। নানা আর নানার ছোট ভাই একসঙ্গেই যুদ্ধে গিয়েছিলেন। কোনাল খুব বেশি দিন তাঁর নানা নুরুল ইসলাম মোল্লাকে পাননি। মুক্তিযুদ্ধের বেশির ভাগ গল্পই তিনি শুনেছেন তাঁর নানার ছোট ভাই হাফিজ আহমেদ মোল্লার কাছ থেকে। যুদ্ধের সময় তিনি ছাত্র ছিলেন। ‘আমার নানা ও তাঁর ছোট ভাই তাঁদের মায়ের কাছ থেকে মাত্র ১৩৫ টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। কেরানীগঞ্জ থেকে পায়ে হেঁটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছে যান তাঁরা। সেখান থেকেই যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে প্রবেশ করেন।’ বলছিলেন কোনাল।
কোনালের নানারা দুই ভাই প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাঁর নানা যুদ্ধ করেছিলেন সাভার, নবাবগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জ এলাকায়।
নানার কাছ থেকেই কোনাল জানতে পারেন, শরণার্থীশিবিরে লাখ লাখ বাঙালি তখন কেমন জীবন যাপন করেছে। ভারত সরকারের নির্দেশে তখন মুদির দোকানদারেরা নাকি বিনা মূল্যেও বাঙালি শরণার্থীদের কাছে পণ্য বিক্রি করতেন। এসব গল্পই শোনালেন কোনাল।

উর্মিলা শ্রাবন্তী করকাদেরিয়া বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ
তরুণ অভিনেত্রী উর্মিলার বাবা ব্রিগেডিয়ার (অব.) অনন্ত কুমার কর তরুণ বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। অল্প কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন তিনি। স্বাভাবিকভাবে বাবার গল্পটা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হন উর্মিলা। বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন আমার আইডল। তাঁর অনুপ্রেরণা আর চাওয়াতেই এখনো অভিনয়ে করে যাচ্ছি।’
১৯৭১ সালে উর্মিলার বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ওই সময় টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনীর হয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধে অংশ নেওয়ার অপরাধে তাঁদের টাঙ্গাইলের বাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। উর্মিলার এক দাদু (বাবার জ্যাঠা) মারা যান তাঁর বাবার সামনে। তাঁর আরেক দাদুকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রয়াত বাবা মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনাই বলেছেন উর্মিলাকে। সেসব ঘটনা নিয়ে নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছা আছে তাঁর। বললেন, ‘ওই সব সত্য ঘটনা নিয়ে আমার নাটক নির্মাণের ইচ্ছে আছে।’
মুমতাহিনা টয়াগেরিলা যোদ্ধার মেয়ে
‘আমার নানা আইয়ুব আলী ও বাবা এ বি এম বদরুদ্দৌজা চৌধুরী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। আমার নানা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলেন। সেখান থেকে সরাসরি ভারতে চলে যান। তারপর আবারও ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। একটা দলে কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন যুদ্ধকালীন সময়ে।’ নানার গল্প দিয়ে শুরু করেন মডেল ও অভিনয়শিল্পী মুমতাহিনা টয়া। পরে শুরু করেন বাবার গল্প। তাঁর বাবা ক্লাস নাইনে পড়ার সময় দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে তিনি এপ্রিলের শেষ দিকে বাড়ি ছাড়েন। চলে যান ভারতের সোনাইমুড়ায়। সেখান থেকে মেলাঘরে। টয়া বলেন, ‘আমার বাবাকে ট্রেনিং দিয়েছেন মেজর মতিন ও সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ। ট্রেনিং শেষে একজন গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে বেশির ভাগ অপারেশনে অংশ নিয়েছেন বাবা। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় হয়েছে সেসব অপারেশন।’ তিনি জানান, অস্ত্র আনা-নেওয়ার কাজও করেছেন তাঁর বাবা। টয়া বলেন, ‘বাবার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আমার জন্য অনেক বড় অনুপ্রেরণা। মাঝেমধ্যে তাঁর কাছে গল্প শুনতে বসি।’

শবনম ফারিয়াবাড়ি থেকে পালিয়ে যুদ্ধে
অভিনেত্রী শবনব ফারিয়ার বাবা চিকিৎসক মীর আবদুল্লাহ। ১৯৭১ সালে তিনি সবে মেডিকেলের দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণে অসংখ্য মানুষের মধ্যে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রেরণা পেয়েছিলেন মূলত তখনই। শবনমের বাবা তখন থাকতেন তাঁদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলবে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পরই এক রাতে বাড়ির কাউকে কিছু না বলে ভারতে রওনা দিলেন তিনি। উদ্দেশ্য, ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধ করবেন, দেশকে স্বাধীন করবেন। বাবার কাছ থেকে শোনা সেই সময়কার গল্প শোনালেন শবনম। ‘আমার বাবাসহ আরও কয়েকজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা তখন রাতের অন্ধকারে নৌকায় করে ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন। টানা তিন দিন তাঁরা না খেয়ে ছিলেন। আশপাশে যেসব বাড়ি ছিল, অধিকাংশই জনশূন্য। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে নিজের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কাউকে আবার পাকিস্তানি আর্মি ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ক্ষুধায় টিকতে না পেরে কুমিল্লার দিকে এক গ্রামে আমার বাবা ও তাঁর সঙ্গীরা নৌকা থামালেন। সেখানে এক হিন্দু পরিবার তাঁদেরকে মুড়ি ও গুড় খেতে দিয়েছিল। পরে খাওয়ার জন্য সঙ্গে করে কিছু গুড় দিয়েও দিয়েছিল। শুধু সেটা খেয়েই বাবা আর তাঁর সঙ্গের যোদ্ধারা ছিলেন আরও কয়েক দিন।’ বলছিলেন শবনম।

শবনম তাঁর বাবাকে নিয়ে গর্ব বোধ করেন। কারণ, যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য কোনো মুক্তিযোদ্ধা সনদ তিনি গ্রহণ করেননি। তাঁর একটাই কথা, ‘আমি তো সনদের জন্য যুদ্ধ করিনি। দেশকে স্বাধীন করা কর্তব্য ছিল। সেই কর্তব্য পালনের চেষ্টা করেছি।’

মুহিনমুহিনের দাদা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নানা বীর প্রতীক
২০০৬ সালে ক্লোজআপ ওয়ান প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় রানারআপ হয়েছিলেন সংগীতশিল্পী মুহিন। প্রতিযোগিতার দেশাত্মবোধক গানের পর্বে মুহিন গেয়েছিলেন, ‘যেই মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তিসেনা’ গানটি। গান শেষ হওয়ার পর জানালেন তাঁর নিজের দাদা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের একজন শহীদ। বলতে গিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন মুহিন। বিচারকদের চোখেও তখন পানি। টিভি সেটের সামনে বসে থাকা অনেক দর্শকেরও চোখ ভিজে উঠেছিল সেদিন। মুহিনের দাদা আবদুর রাজ্জাক খান পুলিশের চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পুলিশ বাহিনী থেকে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর তাঁরা এক জোট হয়ে সরকারি ব্যাংকগুলো জব্দ করার অভিযান চালান। সোনালী ব্যাংকে সংঘটিত একটি অপারেশনে পাকিস্তানি সেনার গুলিতে শহীদ হন মুহিনের দাদা। মুহিন জানালেন, তাঁর নানা আজিজুল হক একজন বীর প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনের আর.আই ছিলেন তিনি। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী কুষ্টিয়া পুলিশের অস্ত্রাগার লুটের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল। মুহিনের নানার নেতৃত্বেই সেই অপারেশনে বাঙালিরা সফল হয়েছিল। ১৯৮১ সালে তাঁকে বীর প্রতীক উপাধি দেওয়া হয়। মুহিনের পাঁচ মামাও মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।
সভ্যতাসভ্যতার বাবা শরণার্থীশিবিরের জন্য ওষুধ জোগাড় করতেন
মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগীতশিল্পী সভ্যতার বাবা খোদাবক্স শানু ছিলেন ভারতে। সেখানে শরণার্থীশিবিরের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। সভ্যতা ছোটবেলা থেকেই বাবার কাছ থেকে গল্প শুনেছেন শরণার্থীশিবিরের মানুষের নানা দুর্ভোগ আর যুদ্ধ শেষে তাদের বাড়ি ফেরার। সভ্যতা বললেন, তাঁরা বাবা শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলোতে ওষুধ সরবরাহ করতেন। কলকাতার বিভিন্ন ওষুধের দোকান ঘুরে ঘুরে সেখানে জমে থাকা বিনা মূল্যের ‘সৌজন্য’ প্যাকেটগুলো সংগ্রহ করতেন। এরপর তা নিয়ে আসতেন শিবিরে। উল্লেখ্য, সভ্যতার বাবা প্রয়াত খোদাবক্স শানু ছিলেন একজন গুণী সংগীতশিল্পী ও শিক্ষক।

Recent Posts

Leave a Comment