৪৩ হাজার কোটি টাকা হিসাবের বাইরে

 In জাতীয়
প্রতি বছর দেশ থেকে পাচার হচ্ছে গড়ে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে মামলা হচ্ছে মাত্র দেড় হাজার কোটি টাকার। এটি মোট পাচারকৃত অর্থের ৩ শতাংশ। আর বাকি প্রায় ৯৭ শতাংশ অর্থ (৪৩ হাজার কোটি টাকা) পাচারের কোনো রেকর্ড নেই। ফলে এ পরিমাণ অর্থ হিসাবের আওতায় আসছে না।

পাচার হওয়া অর্থের একটি বড় অংশ জমা আছে সুইস ব্যাংকে। আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) এবং এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ (এপিজি) প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

জিএফআই এবং এপিজির প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এক দশকে (২০০৪-১৩) দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে ৪ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। ওই হিসাবে প্রতি বছর গড়ে পাচার হয় ৪৪ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। বিপরীতে গত ৭ বছরে (২০০৯-১৫) বাংলাদেশে অর্থ পাচারের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৮৪টি। যার সঙ্গে অর্থ জড়িতের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা। ওই হিসাবে বছরে ১৫৪২ কোটি টাকা পাচারে প্রায় ৪১টি মামলা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে সফররত অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান  বলেন, অর্থ পাচারের মামলার রেকর্ড সংক্রান্ত এপিজির প্রতিবেদনের ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করব না।তবে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও সিআইডি বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার চেষ্টায় অর্থ পাচার সংক্রান্ত রেটিংয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকা থেকে বেরিয়ে আসছে বাংলাদেশ। এতে বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম শনিবার বলেন, পাচারের এই অর্থ দেশে থাকলে বিনিয়োগ বা ভোগে ব্যবহার হতো, যা উৎপাদন হার বাড়াত। দেশের একশ্রেণীর মানুষ অবৈধভাবে আয় করে বিদেশে পাচার করছে। নিম্ন আয়ের মানুষ তা দেখছে। এতে সামাজিক অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকলে বৈষম্য বাড়বে, যা সমাজে বিশৃংখলা তৈরি করবে। অথচ উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হচ্ছে, শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখা। অর্থ পাচার প্রতিরোধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), আইনশৃংখলা ও গোয়েন্দা সংস্থাকে আরও সতর্ক হতে হবে।

সূত্র মতে, জিএফআই দেশ থেকে অর্থ পাচার নিয়ে এবং এপিজি বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বিপরীতে মামলা রেকর্ড নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।

দেখা গেছে, ২০০৯ সালে অর্থ পাচার হয়েছে ৫ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। ওই বছর অর্থ পাচারের মামলা হয়েছে ২টি। যার সঙ্গে অর্থ সম্পৃক্তের পরিমাণ মাত্র ৬৫২ কোটি টাকা। বাকি ৪ হাজার ৫৪০ কোটি টাকার কোনো রেকর্ড নেই।

২০১০ সালে ৪৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হলে বিপরীতে মামলা হয়েছে ১৯টি। এসব মামলার সঙ্গে প্রায় ৭২ কোটি টাকা জড়িত।

একইভাবে দেখা গেছে, ২০১১ সালে অর্থ পাচার হয় ৪৭ হাজার কোটি টাকা। একই বছরে ১৫৭ কোটি টাকা পাচারের ৩৫টি মামলা হয়। বাকি টাকার রেকর্ড নেই।

২০১২ সালে ৫৭ হাজার কোটি টাকা পাচার হলে মামলা হয়েছে প্রায় ৯০ কোটি টাকার। মামলার সংখ্যা হচ্ছে ১৩২। পরবর্তী বছর ২০১৩ সালে অর্থ পাচার বেড়ে ৭৭ হাজার কোটি টাকা দাঁড়ায়। একই বছরে কিছু মামলার সংখ্যাও বেড়েছে। ওই বছর মামলা হয়েছে ৯০২০ কোটি টাকা পাচারের। মামলা সংখ্যা বছরে ৬৬টি।

তবে ২০১৪ ও ২০১৫ সালের অর্থ পাচার নিয়ে জিএফআই এখনও কোনো রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। তবে এপিজির রিপোর্ট অনুযায়ী এ দুই বছরে বাংলাদেশে অর্থ পাচারের মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে ৭৩৮ কোটি টাকা পাচারের বিরুদ্ধে ২০টি এবং ২০১৫ সালে ১১টি ঘটনার মাধ্যমে ৭৩ কোটি টাকা পাচারের মামলা হয়।

জানা গেছে, মানব পাচার, ব্যাংক জালিয়াতি, স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালানের মাধ্যমে অধিকাংশ অর্থ পাচার হয়েছে। আর পাচার সংক্রান্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামলাগুলো হয়। এ ধরনের ২৮৪টি মামলার মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ৪৩টি মামলার। চারটি মামলায় দণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে। ৭৬টি ঘটনা তদন্ত শেষে নিষ্পত্তি হয়।

অর্থ পাচারের মামলার তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ছয় বছরে অর্থ পাচারের প্রায় ৪শ’ ঘটনাকে সামনে রেখে তদন্ত করা হয়। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ১টি, ২০১০ সালে ৫৬টি, ২০১১ সালে ৬৭টি, ২০১২ সালে ৮০টি, ২০১৩ সালে ৮১টি, ২০১৪ সালে ৮৯টি এবং ২০১৫ সালে ২৬টি তদন্ত শেষ হয়েছে।

জানা গেছে, এপিজির রিপোর্টে বিদেশে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন সংক্রান্ত মামলার বিষয়গুলোও গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। জিএফআই প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচারের পরিসংখ্যান নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে। সর্বশেষ ২০১৩ পর্যন্ত ঘটনাক্রম নিয়ে ২০১৫ সালে রিপোর্ট প্রকাশ করে।

এপিজি বাংলাদেশের ওপর সর্বশেষ রিপোর্ট প্রকাশ করে ২০১৬ সালে। গত নভেম্বর মাসে প্রকাশিত সংস্থাটির রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ মূলত মানব পাচার, স্বর্ণ চোরাচালানের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশটির সীমান্ত এলাকায় খাদ্যসামগ্রী, বন্যপ্রাণী, আগ্নেয়াস্ত্র এবং সিগারেটের অবৈধ বাণিজ্যের রমরমা অবস্থা চলছে। মানব পাচারের রুট হিসেবেও দেশটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

রিপোর্টে ব্যাংকিং খাত সম্পর্কে বলা হয়, অর্থ পাচারের কৌশল হিসেবে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করা হচ্ছে, যা ইতিমধ্যেই শনাক্ত হয়েছে। সন্ত্রাসী অর্থায়নের ঝুঁকি আছে বলে স্থানীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রিপোর্টে উল্লেখ করা হচ্ছে।

টাকা পাচার প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের নিরাপত্তার অভাব আছে। এছাড়া নিজের সঞ্চিত অর্থ নিরাপদ স্থানে রাখার মানসিকতাও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। দুই কারণে দেশ থেকে টাকা বিদেশ চলে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, দেশে বিনিয়োগের প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। এর পেছনেও দুটি কারণ আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এর একটি হচ্ছে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় এবং দ্বিতীয় দুর্নীতি।

তিনি টাকা পাচার নিয়ন্ত্রণে বন্দরে পণ্যের আন্ডারইনভেসিং এবং ওভারইনভয়েসিং বন্ধ করতে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানো এবং বিদ্যমান আইন ও নীতি সংস্কারের সুপারিশ করেন।

এই অর্থনীতিবিদের মতে, পরিবেশ তৈরি হলে বৈধ বা অবৈধ আয়ে দেশেই বিনিয়োগ হবে। কিন্তু তা না থাকায় অনেক বৈধ আয়ও বিদেশে চলে যাচ্ছে।

Recent Posts

Leave a Comment