দারিদ্র্য যখন দরজায়, মহান ব্রত তখন জানালা দিয়ে পালায়

 In খোলা কলাম
আবদুল মোনেম
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে বিদ্যমান শিক্ষাপদ্ধতি দেখে অভিভূত, মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হয়ে দেশের শিক্ষাবিদরা আমাদের সন্তানদের জন্যও সেই পদ্ধতিকে উপযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করলেন এবং তাদের সুপারিশে শেষ পর্যন্ত সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতি চালু করা হল। উন্নত বিশ্বের যেসব দেশে অংশগ্রহণমূলক শিক্ষণ-শিখনপদ্ধতি বা সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতি প্রচলিত আছে সেসব দেশের বিদ্যমান শিক্ষা অবকাঠামো, শিক্ষকদের যোগ্যতা, দক্ষতা, নিয়োগ প্রক্রিয়া, শিক্ষকদের পরিচালনা, বিদ্যালয় পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের শ্রেণীকক্ষগুলো আধুনিক প্রযুক্তি তথা মাল্টিমিডিয়ানির্ভর। কাগুজে-পুস্তকের স্থান দখল করে নিয়েছে ই-বুক। বই ও ব্যাগের বোঝা শিক্ষার্থীদের আর বয়ে বেড়াতে হয় না। শিক্ষকদের অধিকাংশই সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। তাদের দক্ষ পেশাদার শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নেই কোনো ঘুষ-দুর্নীতি, ছলা-কলা বা দু-নম্বরী। শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা একশ ভাগ নিশ্চিত। তাদের সামাজিক মর্যাদাও অন্য যে কোনো পেশার চেয়ে উচ্চে। ফলে শিক্ষকতাই শিক্ষকদের পেশা ও নেশা, শিক্ষার্থীরাই তাদের ধ্যানজ্ঞান।
পক্ষান্তরে আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অংশগ্রহণমূলক শিক্ষণ-শিখনপদ্ধতি বা সৃজনশীলপদ্ধতির বাস্তবমুখী পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন এখনও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সম্ভব হয়নি অংশগ্রহণমূলক বা সৃজনশীল উপযোগী পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নও। এমনকি প্রণীত পুস্তকে যেসব সৃজনশীল প্রশ্ন উদাহরণস্বরূপ সন্নিবেশিত করা হয়েছে, এগুলোর অনেক প্রশ্নেরই সমাধান শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে তো সম্ভব নয়ই, এমনকি শিক্ষকদেরও প্রায়ই দ্বিধাগ্রস্ত হতে হয় কিংবা অনেক ঘাম ঝরাতে হয়। গত এক দশকেও ১ শতাংশের ওপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মাল্টিমিডিয়ার আওতায় আনা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ পর্যায়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষক ছাড়া অন্য সব শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা নিন্মবিত্ত ও নিন্মমধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকদের কাছে যৎকিঞ্চিত থাকলেও সমাজের উচ্চমধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত কিংবা নীতিনির্ধারণী ক্ষমতাসম্পন্ন লোকদের কাছে প্রায় শূন্যের কোঠায়। আর্থিক অনিরাপত্তা তাদের নিত্যসঙ্গী। প্রাইভেট টিউশনিতে যেসব শিক্ষকের চাহিদা নেই, তাদের বরাবরই নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। প্রাইভেট টিউশনি আইনত নিষিদ্ধ হওয়ায় আবার এ ক্ষেত্রে চাহিদাসম্পন্নদেরও সামাজিক মর্যাদা আরও হ্রাস পেয়েছে। তাই বলা যায়, যেমন শুধু আঁটিটাই ছিল সাধের আম পাওয়ার একমাত্র ভরসা, তেমনিভাবে অংশগ্রহণমূলক এ শিক্ষণ-শিখনপদ্ধতিতে সৃজনশীল বা কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নে পরীক্ষাপদ্ধতিই হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির আধুনিকায়নের একমাত্র ভরসা। শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন না ঘটিয়ে, যথাযথ শিক্ষা অবকাঠামো নিশ্চিত না করে, যোগ্য-দক্ষ-দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত না করে সৃজনশীল বা কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতি প্রয়োগের ফলাফল দাঁড়াচ্ছে শুধু সার্টিফিকেটধারীদের সংখ্যাবৃদ্ধি তথা কুশিক্ষিত মানুষের রাজত্ব কায়েম করা।
অংশগ্রহণমূলক বা সৃজনশীল বা কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতিকে যদি শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রমে সত্যিই যথাযথভাবে প্রয়োগ করা যায় তাহলে তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতার বিকাশে অনন্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলেই বিশেষজ্ঞমহল বিশ্বাস করে। এ পদ্ধতির যথাযথ প্রয়োগ ও কার্যকারিতার জন্য শিক্ষকদের যথেষ্ট যোগ্যতা, দক্ষতা, নিষ্ঠা, প্রচেষ্টা, পড়াশোনা ও প্রস্তুতি দরকার। খাতা দেখা, প্রশ্ন প্রণয়ন ইত্যাদি যুক্ত করলে স্কুল আওয়ারের বাইরেও শিক্ষকদের কমপক্ষে আড়াই-তিন ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা দরকার হয়। সবমিলিয়ে একজন কমিটেড শিক্ষকের প্রায় সাড়ে দশ-এগার ঘণ্টা এতদসংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিত থাকা দরকার। এর বিনিময়ে ৮ম বেতন-স্কেল অনুযায়ীও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের যে বেতন-ভাতা দেয়া হচ্ছে তাতে অনেক এলাকায় বাসাভাড়াও হয়ে ওঠে না। সারা দেশের মাত্র ৪ থেকে ৫ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাসিক ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা বা তার বেশি বেতন দিয়ে থাকে বা দিতে সক্ষম। মাসিক ২ থেকে ৩ হাজার টাকার বেশি বেতন দিতে সক্ষম নয় অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাও আবার বছরের পর বছর বকেয়া পড়ে থাকে। অনেককে আবার কম-বেশি ঘুষ-দুর্নীতির মধ্য দিয়েই এ পেশায় ঢুকতে হয়। তদুপরি দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রশাসন; অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ভূমিদালাল, মাদকব্যবসায়ী, কালবাজারি, দুর্নীতিবাজ, লম্পট ও চরিত্রহীনদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটিগুলোর দৌরাত্ম্য শিক্ষকদের মেরুদণ্ডহীন প্রাণীতে পরিণত করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। ফলে যোগ্য-দক্ষ, ডেডিকেটেড ও কমিটেড লোকদের এ পেশায় আসার মানসিকতা অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আবার বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত অবস্থা, উপযুক্ত শিক্ষা উপকরণের অভাব ইত্যাদি মিলিয়ে কোনো বেসরকারি বিদ্যালয়ে তো নয়ই, এমনকি সরকারি বিদ্যালয়গুলোতেও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষণ-শিখনপদ্ধতি চর্চার পরিবেশ নেই। ফলে বেশির ভাগ শিক্ষক সন্তান-সংসারের কল্যাণ কামনা করতে গিয়ে একান্ত বাধ্য হয়েই বিদ্যালয়ের কাজে যতটা সম্ভব কম সময় ব্যয়ে সচেষ্ট থাকেন। বাজারে প্রচলিত গাইড দেখে প্রশ্ন প্রণয়ন করে পরীক্ষা নেন, প্রাইভেট টিউশনির ধান্ধা করেন; এমনকি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে শিক্ষার্থীদের নানাবিধ নীতিগর্হিত কর্মকাণ্ডে পরিচালিত করতেও কুণ্ঠিত হন না।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সংজ্ঞানুযায়ী কোনো ব্যক্তির দৈনিক আয় ১.৯৯ ডলার বা এর কম হলে তাকে অতি দরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেই অর্থে দৈনিক ২ ডলার আয়ই হচ্ছে দারিদ্র্যসীমা। দৈনিক এর চেয়ে কম উপার্জনকারী ব্যক্তি অতিদরিদ্র শ্রেণীভুক্ত। পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছয়জন ধরেই অষ্টম পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানা যায়। ফলে দৈনিক ২ ডলার মাথাপিছু আয় এবং বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রতি ডলারের বাজার মূল্য ৮০ টাকা ধরে ৬ সদস্যের একটি পরিবারের বার্ষিক আয় দাঁড়ায় প্রায় ২ী৬ী৩৬৫ী৮০ টাকা= ৩,৫০,৪০০ টাকা। মাসিক আয় দাঁড়ায় প্রায় ২৯,২০০ টাকা। যেসব পরিবারের মাসিক আয় ২৯,২০০ টাকার নিচে জাতিসংঘের সংজ্ঞানুযায়ীই তাদের জীবনযাত্রার মান দারিদ্র্যসীমার নিচে। এরূপ আয়ে বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে গ্রামে যদিওবা কোনো রকমে টিকে থাকা যায়, শহরে টিকে থাকা খুবই দুরূহ। বাচ্চার জামা কিনতে চাইলে স্কুলের বেতন দেয়া যায় না, স্ত্রীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে বাসাভাড়ার টাকা কমে যায় ইত্যাকার সমস্যা। গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির উচ্চমূল্য, লাগামহীনভাবে বাসাভাড়া বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া, অনিয়ন্ত্রিত পরিবহন ভাড়া, শিক্ষা-চিকিৎসা ব্যয়ে লাগামহীন অবস্থা ইত্যাদি কারণে তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। অথচ ৮ম পে-স্কেল অনুসারেও শুধু বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং গুটিকয়েক সহকারী প্রধান শিক্ষক ব্যতীত মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত প্রায় সব শিক্ষকেরই মোট বেতন-ভাতা দারিদ্র্যসীমার নিচেই অবস্থান করছে।
অন্যদিকে জাতিসংঘের ঘোষণা অনুয়ায়ী বাংলাদেশ নিন্মমধ্য আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায় এবং মাথাপিছু গড় আয় ১,৩১৪ ডলারে উন্নীত হওয়ায় ৬ সদস্যের পরিবারের বার্ষিক গড় আয় হওয়ার কথা প্রায় ১,৩১৪ী৬ী৮০ টাকা =৬,৩০,৭২০ টাকা। পারিবার প্রতি মাসিক আয় হওয়ার কথা ৫২,৫৬০ টাকা। সারা দেশে বড়জোর ৪০০ থেকে ৫০০ বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকের বেতন-ভাতা এ সীমাকে স্পর্শ করতে পেরেছে বলে অনুমান করা যায়। কোনো দেশের জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষক দেশের গড় আয়ের কম বেতনভুক্ত থাকবেন কিংবা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করবেন, তাকে কি ন্যায়সঙ্গত অভিহিত করা যায়? শিক্ষকদের আর্থিক সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত রেখে তাদের দ্বারা শিক্ষার মানোন্নয়নের প্রচেষ্টা ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে আশা করা যায় কি? আবার এ দারিদ্র্যপীড়িত শিক্ষকদের আয়ের ওপর প্রত্যক্ষ করারোপকে জুলুম বৈ অন্য কিছু বলা যায় কি?
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষামন্ত্রী একাধিকবার শিক্ষকদের জন্য বিশেষ বেতন-স্কেল প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন; কিন্তু আজ অবধি এ প্রতিশ্রুতির কোনো বাস্তব রূপ দেশবাসী প্রত্যক্ষ করতে পারেনি। পক্ষান্তরে প্রাইভেট টিউশনি বন্ধের নির্দেশনার মাধ্যমে শিক্ষকদের এ কাজ থেকে বিরত করা না গেলেও তাদের সম্মানহানি ঘটানো গেছে বহুদূর। দ্বিতীয়বার একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পরও মাননীয় মন্ত্রী শিক্ষকদের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেননি। এমনকি বিক্ষিপ্তভাবে কিছু প্রতিষ্ঠানকে সরকারীকরণ করা হলেও সার্বিকভাবে জাতীয়করণের কোনো পদক্ষেপ নেই। মাননীয় মন্ত্রী প্রাইভেট টিউশনি নিষিদ্ধ করার পরিপ্রেক্ষিতে একাধিকবার শিক্ষকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, শিক্ষকতা একটি সেবামূলক পেশা, কম বেতনের কথা জেনেই শিক্ষকরা এ পেশায় এসেছেন, তাছাড়া রাষ্ট্রের সক্ষমতার বিষয়টিও শিক্ষকদের মনে রাখতে হবে। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, রাজনীতি কি সেবামূলক পেশা নয়? রাজনীতিতে কি অঢেল অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকা উচিত? রাষ্ট্রের সক্ষমতার বিষয়টি কি শিক্ষকদের চেয়ে রাজনীতিকদের বেশি ভাবা উচিত নয়?
অংশগ্রহণমূলক শিক্ষণ-শিখনপদ্ধতি বা সৃজনশীলপদ্ধতির সুফল জাতির কাছে পৌঁছে দিতে চাইলে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, কানাডাসহ যেসব দেশ থেকে আমাদের দেশে এরূপ পদ্ধতি আমদানি করা হয়েছে, সেসব দেশের সমপর্যায়ের শিক্ষকদের সঙ্গে অন্যান্য চাকরিজীবীর বেতন-ভাতার তূলনামূলক অবস্থা বিচার করে বাংলাদেশেও অন্যান্য সরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা জরুরি এবং তা অবশ্যই মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১,৩১৪ ডলার অনুযায়ী পারিবার প্রতি মাসিক গড় আয়ের সীমা ৫২,৫৬০ টাকার কম হওয়া উচিত নয়। অন্যথায় শিক্ষার মানোন্নয়নের সব চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাতে এ প্লাস, গোল্ডেন এ প্লাসের মহোৎসবই আমরা দেখতে পাব, কোয়ালিটি এডুকেশন সম্পূর্ণ অধরাই থেকে যাবে।
আবদুল মোনেম : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণমুক্তি পার্টি
Recent Posts

Leave a Comment