চাপের মুখেও দল গোছাচ্ছে বিএনপি

 In লিড নিউজ
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘরোয়াভাবে প্রস্তুতি শুরু করেছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে একটি কর্মপরিকল্পনাও তৈরি করছে দলটির হাইকমান্ড। এরই অংশ হিসেবে পুরোদমে চলছে দল পুনর্গঠনের কাজ। নির্বাচনে ইতিবাচক ফল আনতে ঢেলে সাজানো হচ্ছে সব উইং। এরই মধ্যে প্রায় অর্ধেক সাংগঠনিক জেলার নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। মূল দলের পাশাপাশি অঙ্গসংগঠনের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোও পুনর্গঠন করা হচ্ছে।

পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা, নির্বাচনী ইশতেহার তৈরিসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর প্রাথমিক কাজ শুরু করেছেন দলটির সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকে হাইকমান্ডের ‘সবুজ সংকেত’ পেয়ে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় নিয়মিত যাওয়া-আসা শুরু করেছেন।

দলীয় সূত্র জানায়, হামলা-মামলাসহ নানা চাপের মুখে পড়ে বাধ্য হয়ে ঘরোয় প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছে বিএনপি। এরপরও সব দুর্বলতা ও ভুলত্রুটি শুধরে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে আগামী নির্বাচনী মাঠে নামতে চায় দলটি। এক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে দল গোছানোকে। তারা মনে করেন, নির্বাচনে ইতিবাচক ফলের জন্য শক্তিশালী সংগঠনের বিকল্প নেই। বিগত সরকারবিরোধী দুই দফা আন্দোলনে তৃণমূলের সাংগঠনিক অবস্থা তছনছ হয়ে পড়ে। হামলা, মামলা ও ক্ষমতাসীনদের নানা নির্যাতনে অনেক এলাকায় নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে দলটি। সাংগঠনিক দুর্বলতার চিত্র বিগত স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ফুটে উঠে।

সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে অন্যতম কারণ মনে করা হচ্ছে সাংগঠনিক দুর্বলতা। সংগঠন শক্তিশালী না থাকায় সরকারবিরোধী ভোট টানতে ব্যর্থ হয় দলটি। সাংগঠনিক দুর্বলতার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়েও চিন্তিত দলটির হাইকমান্ড। তাই কোন্দল নিরসন করে সংগঠনকে শক্তিশালী করার দিকেই নজর হাইকমান্ডের। এ লক্ষ্যে পুরোদমে চলছে তৃণমূল পুনর্গঠনের কাজ।

দলটির নেতারা মনে করেন, বিএনপির মতো বড় দলে পদের চেয়ে নেতার সংখ্যা বেশি। তাই যে কোনো কমিটি ঘোষণার পর একটি অংশের বিদ্রোহ দেখা যায়। নির্বাচনের আগে আগে এসব কমিটি করা হলে সময় স্বল্পতার কারণে কোন্দল নিরসন করা সম্ভব হতো না। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ত জাতীয় নির্বাচনে।

এ বিষয়টি মাথায় রেখে দুই বছর আগে থেকেই দল গোছানোর কাজে হাত দেয়া হয়েছে। নতুন কমিটি ঘোষণার পর পরিস্থিতি যাতে সামাল দেয়া যায়। বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলোর পুনর্গঠনের কাজ শেষ হলেই আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারে নামবে দলটির হাইকমান্ড। নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বিএনপির এক নীতিনির্ধারক জানান, নির্বাচনের এতদিন আগে ইশতেহার তৈরির পেছনেও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগে এমন একটি ইশতেহার দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে যা সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হয়। তাই এখন থেকেই ইশতেহারের খসড়া তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাছাই-বাছাই শেষে তৈরি করা হবে চূড়ান্ত ইশতেহার। কথার গল্পমালায় না সাজিয়ে বাস্তবতার আলোকেই ইশতেহার তৈরি করা হবে বলে জানান ওই নেতা।

জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর  বলেন, বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। আমরা সম সময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত আছি। নির্বাচনের মাধ্যমেই আমরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যেতে চাই। অতীতে আমরা বেশ কয়েকবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছি। তাই যে কোনো সময় নির্বাচন হলে বিএনপি এতে অংশ নেয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীন আমরা নির্বাচন চাই। যাতে সব দল অংশগ্রহণ করতে পারে এবং ভোটাররা নির্ভয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন।

বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। সেই কমিশন গঠনকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপের পর অনেকটা আশাবাদী হলেও সার্চ কমিটি ঘোষণায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন তারা। কিন্তু তবুও হাল ছাড়ছেন না। নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে ক্ষমতাসীনদের চাপে রাখা সম্ভব হলে ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য একটি ইসি গঠনে সরকারকে বাধ্য করা যাবে। ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য ইসি গঠন হলেও আপাতত বড় ধরনের আন্দোলনে যাবে না দলটি।

এরপর তারা নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার গঠনের ওপরই জোর দেবে। দলটির নেতারা মনে করেন, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার নিরপেক্ষ না হলে ইসি যতই শক্তিশালী হোক তাদের পক্ষে অবাধ নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হচ্ছে- নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার। তাই অনেক কিছু ছাড় দিয়ে হলেও তারা সহায়ক সরকার বাস্তবায়নেই গুরুত্ব দেবে। তাই আগামী কয়েক মাসে দলটি এমন কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবে না যাতে নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়।

তাদের মতে, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন হলে বিএনপি বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে। দলীয় ভোটের পাশাপাশি সরকারবিরোধী বড় একটি অংশের ভোটও তাদের বাক্সে পড়বে। তাই যে কোনো মূল্যে সব দলের অংশগ্রহণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনই তাদের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে সর্বস্তরে দল গুছিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। সম্প্রতি তৃণমূল পুনর্গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা মোহাম্মদ শাহজাহানসহ সংশ্লিষ্টদের ডেকে কথা বলেন দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সেখানে তৃণমূল পুনর্গঠনের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চাওয়া হয়। মোহাম্মদ শাহজাহান পুরো বিষয়টি চেয়ারপারসনকে অবহিত করেন। এরপর খালেদা জিয়া তাকে দ্রুত বাকি জেলা কমিটিগুলোর পুনর্গঠন শেষ করার নির্দেশ দেন। চেয়ারপারসনের এমন নির্দেশনা পাওয়ার পর মোহাম্মদ শাহজাহান বাকি কমিটি শেষ করতে দ্রুত কাজ করে যাচ্ছেন।

পুনর্গঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক নেতা  বলেন, দল গোছানোর পাশাপাশি তাদের কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পুনর্গঠনের পাশাপাশি প্রতিটি সংসদীয় আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে বলা হয়েছে। যারা আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে ইচ্ছুক তাদের জেলা বা উপজেলায় গুরুত্বপূর্ণ পদ না দিতে হাইকমান্ডের পরোক্ষ নির্দেশনা রয়েছে।

জানতে চাইলে মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, তৃণমূল পুনর্গঠনের কাজ পুরোদমে চলছে। ক্ষমতাসীন দলের বাধাসহ কিছু জটিলতার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করা যাচ্ছে না। তারপরও আমরা থেমে নেই। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে সব ইউনিটের কমিটি গঠন শেষ করা সম্ভব হবে। আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি বলেন, বিএনপির মতো একটি বড় দলের সব সময় নির্বাচনের প্রস্তুতি থাকে। নির্বাচনের জন্য সংগঠনের বিকল্প নেই। আমরা এখন সংগঠন গোছানোর দিকেই নজর দিচ্ছি।

মূল দলের পাশাপাশি অঙ্গসংগঠনগুলো পুনর্গঠনের কাজ পুরোদমে চলছে। ইতিমধ্যে স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল, মহিলা দলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। কৃষক দল, তাঁতী দলসহ অন্য কমিটিগুলোরও কাজ চলছে। ঢাকা মহানগরীতে গতি আনতে দুই ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দ্রুতই ঘোষণা করা হবে উত্তর ও দক্ষিণের নতুন কমিটি। সংগঠন গোছানোর পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা তৈরির কাজও শুরু করেছে দলটি। ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে দল থেকে যাদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল ওই তালিকার ওপর ভিত্তি করেই কাজ করা হচ্ছে। ওই দুই নির্বাচনে যারা মুত্যুবরণ করেছেন বা দলে নিষ্ক্রিয় তাদের বাদ দেয়া হচ্ছে। প্রতিটি সংসদীয় আসনে কমপক্ষে তিনজন করে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এছাড়া গোপনে জরিপ চালিয়েও একটি তালিকা তৈরি করবে হাইকমান্ড। দুই তালিকা থেকে সমন্বয় করে মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হবে। এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিলেন এবং দলের প্রতি আনুগত্য রয়েছে এমন যোগ্যতা বিবেচনায় নিয়েই করা হচ্ছে এসব তালিকা। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে জেলা ও উপজেলা বিএনপি কমিটির ‘সুপার ফাইভ’ নেতাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সূত্র জানায়, সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকে সবুজ সংকেত পেয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। ঢাকা মহানগরের সিনিয়র এক নেতা রাজধানীর একটি আসনে নিয়মিত স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। সম্প্র্রতি ওই নেতাকে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে জানান, চেয়ারপারসন তাকে রাজধানীর ওই আসন থেকে আগামী নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। তার নির্দেশেই প্রতি সপ্তাহে একদিন সেখানে যাচ্ছি।

জানা গেছে, সবকিছু ঠিক থাকলে ২০ দলের ব্যানারেই আগামী নির্বাচনে যাচ্ছে বিএনপি। জামায়াত নির্বাচন করতে না পারায় এবার আসন ভাগাভাগি নিয়ে জটিলতা কম হবে। জামায়াত ছাড়া অন্য দলগুলোর কয়েকটিকে কিছু আসন ছাড় দিলেই তারা খুশি হবেন। সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০টি আসন জোটের শরিকদের ছাড় দেয়া হতে পারে। সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকার পাশাপাশি আগামী নির্বাচনের ইশতেহার তৈরির লক্ষ্যে ঘরোয়া প্রস্তুতি শুরু করেছে দলটি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ কয়েক নেতার পাশাপাশি পেশাজীবীদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে এ কাজে। খাত অনুযায়ী কাজ করতে অভিজ্ঞদের দায়িত্বও দিয়েছেন দলের চেয়ারপারসন। ‘ভিশন ২০৩০’-এর আলোকেই তৈরি করা হবে আগামী নির্বাচনী ইশতেহার।

জানতে চাইলে বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীম  বলেন, আমরা আন্দোলন ও নির্বাচনের লক্ষ্যে দল গোছানোর কাজ করছি। তৃণমূলে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশে যোগ্য প্রার্থীকে তারা ভোট দিতে মুখিয়ে আছে। জনগণের সেই ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

কুষ্টিয়া-৩ আসনের বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ সোহরাবউদ্দিন  বলেন, সরকারের হামলা-মামলা উপেক্ষা করেও নেতাকর্মীদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি, এখনও করছি। সংগঠন গোছানোর পাশাপাশি নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছি।

Recent Posts

Leave a Comment