আমরা কেউ কথা রাখি না

 In খোলা কলাম

হীরেন পণ্ডিত

কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক বুক কষ্ট নিয়ে লিখেছিলেন- ‘কেউ কথা রাখে না’। কবিতাটিতে যেন আমাদের সবারই মনের কথাই তিনি প্রকারান্তরে বলেছিলেন। আমরা কেউ কথা রাখি না, তার প্রমাণ আপনি যে কোনো দিকে তাকাবেন সেদিকেই পাবেন। এই দেখুন না, ঢাকা শহরের সিটিং সার্ভিস বাসগুলো, সিট খালি না থাকলেও দিব্যি দাঁড়িয়ে যাত্রী নিয়ে ছুটে চলে গন্তব্যে, ভাগ্যিস ঝুলিয়ে নেয় না। আর ডাইরেক্ট সার্ভিসের কথা কী বলবেন, প্রতি স্টপেজে থামবে অথচ এর নাম ডাইরেক্ট সার্ভিস।

টেলিভিশন দেখতে যাবেন, সেখানে আজকাল বিজ্ঞাপনের মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান দেখা যায়, তবে বিরতির সময় সুন্দর ভাষায় তাদের সঙ্গে থেকে বিজ্ঞাপন দেখার জন্য সে কি আবদার, যেন মামাবাড়ির আবদার। এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান কয়েক ঘণ্টায় শেষ হয়। বাংলা ছায়াছবি হলে তো কথাই নেই, সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের মাত্রা আরো একটু বেড়ে যায়। সেই বাংলা ছায়াছবি আপনি যে চ্যানেলেই দেখেন। বাজারে যাবেন সেখানে এর মাত্রা আরো একটু বেশি। কীভাবে আপনার ওপর দিয়ে অচল জিনিসটা চালিয়ে দেয়া যায়, দোকানদার সে চেষ্টাতেই ব্যস্ত থাকেন, তাদের কথায় মুগ্ধ হয়ে যাবেন তো গেছেন! আপনাকে এমনভাবে উপস্থাপন করবে- মনে হবে তার নিজের কারখানায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী যা বাসায় নেয়ার পর তার অবস্থা টের পাওয়া যায়।

শিক্ষার বেলায় শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বিফলে মূল্য ফেরত মার্কা শিক্ষাকে পণ্য বানানোর যে একটা প্রক্রিয়া চলছে সেখান থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা আমাদের এখন থেকে শুরু করা দরকার, কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? সবই তো ঘটে যাচ্ছে চোখের সামনে। কোচিং সেন্টার আর ইংলিশ শেখানোর এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনরত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপনের ভাষা দেখলেই চমকে উঠতে হয়। ফলাফল মোটামুটি সবার জানা আছে, তারপরও আমরা এগুলো থেকে মুক্ত হতে পারছি না।

আমাদের এমন কোনো পাবলিক পরীক্ষা কি আছে যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি এখনো? প্রাথমিক, জুনিয়র, এসএসসি, এইচএসসি এমনকি উচ্চশিক্ষার পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে হয়ে যাচ্ছে। বিসিএস ও মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার প্রশানপত্রও বাকি থাকছে না এই ফাঁসের বেড়াজাল থেকে। আমাদের নৈতিকতাকেও যেন বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি। আমাদের নৈতিকতাও এখন কথা রাখে না বা রাখার সুযোগ দেয় না। অথচ আমরা চাকরির শুরুতে দেশমাতৃকার কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত রাখব বলে যে শপথ আমরা করেছিলাম সেই কথা কি আমরা রাখতে পেরেছি। স্কুলজীবনে আমরা শহীদের রক্তে রঞ্জিত জাতীয় পতাকাকে সামনে নিয়ে শিক্ষকদের সামনে দাঁড়িয়ে দেশমাতৃকার কল্যাণে নিয়োজিত থাকার যে শপথ আমরা গ্রহণ করেছি আমরা কি সেই শপথ রেখেছি? রাখিনি! সামান্য ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য এমনই ব্যতিব্যস্ত আছি যে আমরা, একটা প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিচ্ছি সে দিকে আমাদের খেয়াল নেই। এভাবে আমরা একটি জাতির অগ্রযাত্রাকে যে থামিয়ে দিচ্ছি, তা আমরা একবার ভেবে দেখছি না।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠগুলোকে আমরা খেলার জন্য উন্মুক্ত করতে পারি না। শিশুদের খেলার জন্য মাঠগুলো দখল না করলে আমাদের যেন কোনো কিছু থেকে যেন নিজেদের বঞ্চিত মনে হয়, ফুটপাতগুলোকে আমরা এখনো উন্মুক্ত করতে পরি না, মাঝে মাঝে উন্মুক্তের একটা রেশ থাকলেও তা খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় না।

এই অস্থির সময়, অস্থির সমাজ, সব কিছুতেই যেন এক অস্থিরতা বিরাজ করছে, কেউ কারো কথা শুনি না, কারো কথার সম্মান করি না আমরা, কারো কথা বিশ্বাস করি না। এক অজানা অস্থির যাত্রায় আমরা ব্যস্ত। আমরা যা মানি, তা করি না, আর যা করি, তা বিশ্বাস করি না। এই অস্থির যাত্রা এবং সময়কে অস্থির করে তোলা আমাদের জন্য খুব একটা মঙ্গলজনক নয়। আমরা সব কিছুকেই যেন ধ্বংস করে দিচ্ছি। আমাদের পরিবেশ, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, খাদ্যদ্রব্য, ওষধপত্রসহ আমাদের সব প্রতিষ্ঠানকে আমরা নষ্ট করে দিচ্ছি। একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে যা দরকার আমরা কেউ তা করছি না। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে আজ যে অস্থিরতা বিরাজ করছে সে অস্থিরতা দূর করে একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমরা কেউ কথা রাখি না।

হীরেন পণ্ডিত : লেখক।

Recent Posts

Leave a Comment