নীরব মানুষ সরব মানুষ

 In খোলা কলাম

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

মানুষ কত প্রকার? এই প্রশ্ন রাজা মিয়াকে করলে তিনি আমার দিকে এমনভাবে তাকান, যেন আমি মঙ্গলগ্রহ থেকে নেমে এইমাত্র পৃথিবীতে চরণধূলি দিলাম। তার পরও যেহেতু তিনি সর্বদিকে প-িতÑ তাই করুণাবশত আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন হয়তো। বললেন, মানুষ তো দুই প্রকার। নীরব মানুষ, সরব মানুষ। আমি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালে তিনি বললেন, বুঝলে না সহজ ব্যাপারটা? আমি বললাম, নাহ, বুঝিনি! তিনি বললেন, ধরো এই যে প্রতিদিন দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষ মরছেÑ এটি তো খুব দুঃখজনক, তাই না? আমি বললাম, জি, খুব দুঃখজনক। রাজা মিয়া এবার হেসে বললেন, কিন্তু তুমি কি সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে কখনো কথা বলেছ? আমি চুপ করে রইলাম। না, কথা বলিনি কখনো। এ নিয়ে আমার মাথাব্যথা কেন বাপু? আমার কি কাজের অভাব আছে! মনে মনে এ কথাগুলো বললেও রাজা মিয়া যেন আমার কথাগুলো ঠিক শুনতে পেলেন। বললেন, সড়ক দুর্ঘটনার মতো বিষয় নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর ফুরসত কই। তা ছাড়া যেখানে মন্ত্রী-এমপিরা মাথা ঘামান না, সেখানে তুমিই বা মাথা ঘামাকে কেন? আমি তার এমন কথায় খুশি হয়ে বললাম, আপনি আসলেই প-িত মানুষ। আমি এ কথাটিই আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম। আমার প্রশংসা শুনে রাজা মিয়া পটলেন কিনা বুঝতে পারলাম না। তিনি বললেন, তুমি হচ্ছ নীরব মানুষ। এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। নিজেকে সামলিয়ে বললাম, আমি তো কথা বলতে পারি। আমি নীরব মানুষ হলাম কীভাবে? রাজা মিয়া বললেন, কথা বলতে পারলে বলো তো, ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় কতজন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে? অথবা বলো কতজন আহত হয়েছে? আমি মন খারাপ গলায় বললাম, জানি না। রাজা মিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, জানতাম, তুমি জানবে না। কারণ তুমি নীরব মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনা কেন, কোনো সমস্যা সমাধানের জন্যই তুমি কথা বলো না। কথা বলা তো দূরে থাক, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় কতজন মরল, কতজন পঙ্গু হলোÑ তার খবরও তুমি জানবে না। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে ধরা গলায় আবার বললেন, তোমাকে আর দোষ দেব কী, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই এসব খোঁজ রাখে না। তারা খোঁজ রাখত, যদি তাদের কেউ গাড়ির নিচে পড়ে অকালে মারা যেত। আমি চুপ করা ছাড়া অন্য কোনো পথ দেখলাম না। রাজা মিয়া বললেন, ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে প্রাণ হারিয়েছেন ৬ হাজার ৫৫ জন মানুষ। আহত হয়েছেন প্রায় ১৬ হাজার। ভাবা যায়? আমি নিহত-আহতের সংখ্যাটা শুনে অবাকই হলাম। সত্যিই ভাবা যায় না। রাজা মিয়া বললেন, পত্রিকা উল্টালেই দেখিÑ বাসের ধাক্কায় মেডিক্যাল ছাত্রী নিহত, সড়ক দুর্ঘটনায় বর-কনে নিহত, কখনো দেখিÑ দুই সিএনজির মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের পাঁচজন নিহত। এ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে কত মানুষ যে পঙ্গু হয়েছে তার সংখ্যা তোমাকে বলে শেষ করা যাবে না। একটি পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি যদি সড়কে প্রাণ হারান, তাহলে সে পরিবারটির কী করুণ দশা হয়Ñ ভেবে দেখেছ একবার? কতটা খারাপ লাগে। রাজা মিয়ার কথা শুনে আমার সত্যিই খারাপ লাগছে। রাজা মিয়া বললেন, দেখো মেজাজটা কেমন তেতে ওঠে। সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের জাতীয় সমস্যা। অথচ এ সমস্যা সমাধানে জোরালো উদ্যোগ নেই। সাধারণ মানুষের নেই তীব্র প্রতিক্রিয়া। প্রতিদিন রাস্তায় পাঁচ-দশটা লাশ পড়ছেÑ অথচ এটা যেন আমাদের দৈনন্দিনতার ডাল-ভাত। কোনো ব্যাপারই নয়! এই ব্যাপার না-অলা মানুষগুলোই হচ্ছে নীরব মানুষ। আমি রাজা মিয়ার দিকে গভীর চোখ মেলে তাকাই। তার চোখ রাগে রাগে-ক্ষোভে জ্বলজ্বল করছে। আমি তবু ভয়ে ভয়ে জানতে চাইÑ আপনি তো বলেছেন মানুষ দুই প্রকার। তাহলে সরব মানুষ কারা? যারা প্রতিবাদী? রাজা মিয়া আমার চিন্তার গভীরতা দেখে অবাক হলেন যেন। বললেন, একদম ঠিক কথা। যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসচেতনতার বিরুদ্ধে কথা বলে, তারাই সরব মানুষ। কিন্তু আমাদের প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা খুব কম। আমাদের বেশি বেশি সরব মানুষ চাই। অনেকে ইতোমধ্যে সরবও হয়েছেনÑ যেমন নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ দাবি নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন কাজ করছেন। আমি বললাম, আমি তো চিনি তাকে। রাজা মিয়া আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন। বললেন, তাকে জানো তাহলে। ইলিয়াস কাঞ্চন যেমন উদ্যোগী হয়েছেন, সরব মানুষ হয়েছেন, আমাদেরও তেমন সরব মানুষ হতে হবে। তার মতো সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমাদেরও সরব হওয়া উচিত, তাই না? আমি বললাম, জি, সরব মানুষ হবো। রাজা মিয়া খুশি হয়ে বললেন, আমাদের প্রতিবাদের কারণে, গণসচেতনতার কারণে বছরে হাজার হাজার মানুষ বেঁচে যেতে পারে। আমাদের স্বজনরা, আত্মীয়রা, এমনকি আমিও অপমৃত্যু থেকে বেঁচে যেতে পারি। রাজা মিয়া বিমর্ষ চোখে বললেন, আমার অপমৃত্যুর কথা বললাম কারণ, দেশে যা দিনকাল পড়ছে, চালক, যাত্রী, রাস্তাঘাটসহ সবাই বেপরোয়াÑ কখন যে বাসের চাপা পড়ি তার ঠিক নেই। এখনো যে পিতৃপ্রদত্ত প্রাণটা সড়কে হারাইনিÑ এটাই আমার কাছে এখন অবাক লাগে। রাজা মিয়ার কথা শুনে আমার কিছুটা রাগ লাগে। বললাম, আমাদের মন্ত্রী-এমপিরা তো এ ব্যাপারে জোরালো কিছু করতে পারেনÑ হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারেন। রাজা মিয়া বললেন, তারা তো দেশ ও জাতি নিয়ে ভাবেন। কত কত অনুষ্ঠান, কেক কাটা, ফিতা কাটা, বক্তব্য দেওয়াÑ আরও কত কী! তাদের সময় কই! আমি বললাম, তাদের সময় হবে কবে? কখনো হবে না? রাজা মিয়া বললেন, হবে হবে। একদিন তারা ঠিকই বুঝবেন। সে জন্য আমাদেরও সরব মানুষ হতে হবে। নীরব থাকা চলবে না। আমাদের প্রতিবাদ, সচেতনতা তাদের ঘুম ভাঙাবেই। তখন তারা নিশ্চয়ই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর, ফলপ্রসূ ব্যবস্থা নেবেন। নেওয়া তাদের কর্তব্যও।

আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, আমাকে থামিয়ে দিয়ে রাজা মিয়া বললেন, এখন যাই, বাজার করতে হবে। বলেই তিনি রাস্তা পার হচ্ছিলেন। পরেক্ষণেই আমি আঁতকে উঠি। অল্পের জন্য বেপরোয়া একটা মোটরসাইকেলের নিচে পড়া থেকে রাজা মিয়া বেঁচে গেলেন। আমি দৌড়ে কাছে যেতেই রাজা মিয়া বললেন, একটু আগে তোমাকে বলছিলাম না, কখন গাড়ির নিচে পড়ি ঠিক নেই!

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান, কবি

Recent Posts

Leave a Comment