ক্ষুধার্ত ধানের নামতা : অনুভবে অনুধ্যানে

 In শিল্প-সাহিত্য

শঙ্খচূড় ইমাম

কবিতার প্রধান বিষয়—চিন্তা। প্রকৃতপক্ষে কবি কী চিন্তা করেছেন, সেটাই মুখ্য। চিন্তার জায়গা থেকে যে ডেলিভারিটা হয়, এরপর তা নানা কৌশলে ও স্বকীয়তায় রূপদান করা হয়। বলা বহুল্য, বাংলা কবিতার আজ যে ব্যপ্তি তার গতি ক্রম-উন্মোচনশীল। নতুন দিশা। কেউ কেউ বলে থাকেন প্রজন্মের কবিরা যা লিখছেন তা বিমূর্ত। শেষমেশ কবিতাই থাকছে না। তবে তা হাতেগোনা দু-একজন হতে পারেন। বেশিরভাগ সাধারণ সারিতেই আছেন। যে প্রসঙ্গে বলা, আমি মনে করি শিল্প কেবল মানুষের জন্যই। যে কাঠামোটি দাঁড় করাব সেটি মানুষের জন্যই হওয়া উচিত। সেটি বিমূর্ত কিংবা দুর্বোধ্য নয়। তবে শিল্পের খাতিরে এমনটা হতে পারে। তার পূর্বশর্ত জীবনসংঘাত নয়। কাব্যশিল্প নান্দনিক, সেখানে দুর্বোধ্যতার নামে বিকৃতির কোনো আশ্রয় থাকতে পারে না। গিরীশ গৈরিক বলেছে :

‘আমি একদিন মানুষের পৃথিবীতে এসেছিলাম

মানুষ—কেন যে মানুষ তা জানতে এসেছিলাম

আমি জানতে পারি নাই

কেননা আমি জন্মান্ধ ছিলাম’ (মা, পৃষ্ঠা : ৫৮)

এই যে মানুষ হয়ে মানুষের জন্য কথা বলা, মানুষকে জানতে চাওয়া—এই জিজ্ঞাসাটুকু যদি দুর্বোধ্য হয়, তা কতটুকু মানুষের দ্বারে পৌঁছবে? যাক সে কথা। গিরীশ গৈরিক এ প্রজন্মের কবি। ২০১৬ সালের একুশে বইমেলায় তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘ক্ষুধার্ত ধানের নামতা’ প্রকাশ হয়েছে। বইটি প্রকাশ করেছে বেহুলাবাংলা প্রকাশনী। ক্ষুধার্ত ধানের নামতা আমি বেশ কয়েকবার পাঠ করেছি। ছিটেফোঁটা ত্রুটি থাকলেও তা গৌণ। কেননা, তার চিন্তার জায়গায়টাই প্রবলরৈখিক, প্রাণময়। দীর্ঘ জার্নি শেষে একটা ঘোড়ার ডাক। যতবারই পাঠ করেছি ততবারই একটা বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। লেখার মধ্যে কোনো ধরনের ‘চিন্তার সংযোগ দূরত্ব’ নেই। চিন্তার সংযোগ দূরত্ব বলতে বোঝাতে চেয়েছি—কবি তাঁর কবিতার শুরুতে যে চিন্তাটি করেছে, টেক্সেটে তার সমন্বয় কতটুকু রয়েছে। একটি লাইন থেকে অপর লাইনে যে কথাগুলো বলা হলো, তার মধ্যে কোনো আন্তসংযোগ আছে কি না, যা সাধারণত প্যারালাল বলা হয়। কিন্তু গিরীশের কবিতায় এমন কোনো দূরত্ব নজরে আসেনি। যতবারই তাঁর কবিতা পড়েছি, ততবারই মনে হয়েছে সে আগে থেকেই ভেতরে ভেতরে মূল বিষয়বস্তু কম্পোজ করে নিয়েছে। সেই আঙ্গিকেই প্রতিটি লেখা সাজানো হয়েছে।

গিরীশের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য—জীবনযন্ত্রণা, প্রফুল্ল বেদনাবোধ। তবে প্রথাগত কোনো রোমান্টিকতায় সে মাখামাখি করেনি। সম্ভবত সে সজাগ থেকেই এটি এড়িয়ে গেছে। না খাওয়া মানুষের খুটে খাওয়া গল্পে সাজিয়েছে পুরো কবিতার বইয়ে। সেইসব মানুষের দুঃখ-কষ্ট-ধৈর্যের বন্ধন তুলে ধরেছে :

‘গতরাতে পশুর নদী গোটা গ্রাম গিলে ফেলেছে

কোনো বিষধর সাপের মতো ব্যাঙ গিলে ফেলার গল্প এটা নয়

গল্পটি হল পাখির মতো খুঁটে খাওয়া মানুষের

যাদের প্রেমের ভগ্নাংশ জমা থাকে মৌচাকে

আর সেখানে তোমরা দাবানল লাগিয়ে মধু শিকার করো’ (বানিয়াশান্তা, পৃষ্ঠা : ৩১)

সমাজের ক্ষতগুলো দেখে আমাদের ভেতরে দ্বৈরথ শুরু হয়। আবার কেউ কেউ দেখে-শুনে না দেখার ভানে অন্ধের মতো এড়িয়ে যাই। কেউ কেউ কুকড়ে গিয়ে ভেতরে মজ্জিত করি। প্রকৃতপক্ষে সঠিক মানুষগুলো প্রজ্জ্বলিত আগুনের থেকেও অধিক আগুনে নিজেকে জ্বালায় এবং এইসব জ্বরের গতিবিধি ভেদ করে ভূমিকা রাখে হৃৎপিণ্ডের মতো উজ্জ্বল রঙে। গিরীশও তার ব্যতিক্রম করেনি। আন্তদ্বৈরথে বর্ণ গেঁথেছে সেইসব দগ্ধময় কথা :

‘আমি নিমেষে বুঝতে পারি ঘায়ের যন্ত্রণা থেকে

পেটের যন্ত্রণা অনেক বড়

কিন্তু তার বেলুন পেটের ভেতরে যে সন্তান ঘুমিয়ে আছে

সে কী করে জানবে জারজ চাঁদের মলিন হাসি কতটা জ্বালাময়’ (ময়মনসিংহ জং, পৃষ্ঠা : ২৭)

কিংবা—

‘চতুর্দিক ক্ষুধার্ত মূর্তিগুলো হাহাকার করছে

তুমি শুধু চুলায় রান্না করে যাচ্ছ

হৃদয় ভাঙা চলচ্চিত্রে তোমার একমাত্র সুড়ঙ্গ আগস্তযাত্রার দধিচিবন

কারণ এখানেই মৃত মানুষের ছাই

পাখিদের সাথে উড়িয়ে দেওয়া হয়’ (ইরেজার, পৃষ্ঠা : ৪০)

গিরীশের কবিতার চলনশৈলী বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই শুরু হয়। একটা গল্পের প্লট ধরে এগুতে থাকে। পড়লে মনে হয় শেষের আগের পঙক্তিগুলো কেমন যেন নিষ্ক্রিয়, অথচ শেষ হলেই যেন হুট করে টোটাল টেক্সের গতি উচ্চগামী সূচকে পরিণত হয়। যেখানে দৃশ্যমান হয় সুষম বণ্টনের নৃত্য। টেক্সেটের শরীরজুড়ে ঝুলতে থাকে বোধের বহুরৈখিক বক্তব্য। আমরা পাঠ করতে পরি ‘দুধের সর’ কবিতাটি :

‘তুমি বিষধর গোখরার মতো সুন্দর

অথচ সুন্দরবনের সুন্দরী বৃক্ষের মতো মমতাময়ী

তোমার ছোবল কিংবা শীতল ছায়া

কোনটা পেতে কোনটা হারাই

সে ভাবনায় তোমায় নিরাপদ দূরত্বে ভালোবাসি

যতটা দূরত্বে কোন ফল—ফুলকে ভালোবেসে

বড় হয়ে ওঠে’ (দুধের সর, পৃষ্ঠা : ৬৩)

এই কবিতাটি পাঠ করুন এবং ভেতরে ভেতরে উপলব্ধি করুন এর শরীরকে। কবিতাটি কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়েছে। কিন্তু যখন ‘সে ভাবনায় তোমায় নিরাপদ দূরত্বে ভালোবাসি’ লাইনটিতে এসে পৌঁছলাম, তখন কেমন যেন পাঠের গতি নিম্নগামী হয়ে গেল। অথচ শেষ দুই লাইনে সেই গতি পুনরায় বৃদ্ধি পেয়ে পৃথক চিন্তার উৎস তৈরি করে। ‘গোখরার মতো সুন্দর, বৃক্ষের মতো মমতাময়ী কিংবা শীতল ছায়া’ এই যে নান্দনিক সংঘাতের দৃশ্য তা সত্যিই ভাবনার খোরাক জোগায়। আরেকটি কবিতা পাঠ করি :

‘গর্ভবতী রিভলবারের সন্তান গর্ভেই থাক

বোমারু বিমানের ডিম বিমানেই থাক

এসকল ছানা আমাদের পুকুরের হাঁসের সাথে খেলা করে না

বৃষ্টি শেষে বাড়ির উঠোনে এসে প্যাঁক প্যাঁক করে ডাকে না

বৃক্ষ কখনো মলত্যাগ করে না তার জন্মকালে

এসকল বিষয় অধ্যয়নে আরো জানা যায়

সাপলুডুর সাপ ও মই কোনো সমার্থক শব্দ নয়

নার্সের কাছে আর যাব না

আর দেখাবো না গোপন ব্যথা

সব ব্যথাই চেটে খাবে প্রসবকালীন গাইয়ের মতো’ (তেজপাতা, পৃষ্ঠা : ৪৮)

এটি একটি আশ্চর্য সুন্দর কবিতা। পাঠ করার পর মনে হয়, বলার ভঙ্গি বেশ সহজ অথচ এর ব্যপ্তিজুড়ে কী ভয়ংকর বেদনা, মনে হয় পৃথিবীটা কুকুরের আর্তচিৎকারে ভরে গেছে। যেন পৃথিবী একটা গভীর খাদ! কবি তার ব্যথাকে আয়নার মতো ভেঙে খানখান করে ছড়িয়ে দিয়েছে। নিবিড় সেই ব্যথা অন্তহীন প্রক্রিয়ায় জানিয়েছে তাঁর অভিমান। ‘নার্সের কাছে আর যাবে না, দেখাবে না গোপন ব্যথা’ অথচ সব ব্যথাই প্রসবকালীন গাইয়ের মতো চেটে খাবে। এ এক আশ্চর্য নান্দনিক ব্যথাহ্রদ!

বেশ কিছু শব্দের ওপর গিরীশের দুর্বলতা রয়েছে। লিখতে গিয়ে এসব শব্দ একাধিকবার ব্যবহার করেছেন। কিছু শব্দ আছে সাধরণত সবাই একাধিকবার ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু গিরীশ এসব শব্দ যেভাবে ব্যবহার করেছে তাতে মনে হয় এসব শব্দের প্রতি তার দুর্বলতা বা মায়ার জায়গা থেকেই ব্যবহার করেছে। যেমন— জন্ম, যৌনতা, আগুন, ব্যাঙ, জল, স্তন, মা, ঈশ্বর, মানুষ, চোখ, সন্তান, দুঃখ, রক্ত, দাঁত, পাখি, ক্ষুধা, গণতন্ত্র, নদী, মৃত্যু প্রভৃতি। এসব শব্দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছে জন্ম এবং মা। এ ছাড়া গিরীশ লিখতে গিয়ে অতিরিক্ত কিছু শব্দ ব্যবহার করেছে, যা প্রয়োজনভিত্তিক নয়। কবিতার ক্ষেত্রে একই শব্দ বারবার ব্যবহার এড়িয়ে গেলেই ভালো। তবে সে ক্ষেত্রে যদি শব্দটি প্রয়োজনভিত্তিক আসে কিংবা একেবারেই এড়িয়ে যাওয়া না যায়, তবে তা ব্যবহার দোষের নয়। কিন্তু গিরীশের কিছু কিছু লেখায় লক্ষ করলে দেখা যায়, যা সে চাইলে এসব শব্দ এড়িয়ে যেতে পারত। যেমন— আমি অভিজিৎ রায় বলছি কবিতায় : ‘নিমগাছের সমস্ত শরীরজুড়ে তিক্ততারই ব্যাকরণ’—এখানে ‘সমস্ত’ শব্দটি অতিরিক্ত। কেননা ‘শরীরজুড়ে’ বললে ‘সমস্ত’ শব্দটি নিষ্প্রয়োজন। কিংবা ‘অথচ নিমফুল মধু ডেকে আনে নীল প্রজাপতি’—এখানে ‘নীল’ শব্দটি অতিরিক্ত। ‘এভাবে বেজিদের রক্তে কোবরা হত্যার এক প্রকার নেশা জন্মে’—এখানে ‘এক’ ‘প্রকার’ শব্দ দুটি অতিরিক্ত। কেননা, বেজিদের রক্তে কোবরা হত্যা নেশা চিরন্তন। কিন্তু সেখানে প্রকারভেদ উল্লেখ না করলেও অর্থ একই থেকে যায়। এভাবে গিরীশ অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহার করেছে। তবে ছোটখাটো প্রতিবন্ধকতা থাকলেও তা গৌণ। কিন্তু একজন সচেতন কবির এসব ভুল এড়িয়ে যাওয়া উচিত।

‘ক্ষুধার্ত ধানের নামতা’ গ্রন্থটি মোট ৫৩টি কবিতা বহন করেছে। এর মধ্যে ‘আমি অভিজিৎ রায় বলছি’ কবিতায় মুক্তমনাদের হত্যার প্রতিবাদ, ‘অ্যান্টিবায়েটিক’ কবিতায় নষ্ট পিতার দুর্বোধ্য নোংরামি এবং একজন নিরাপরাধ মায়ের লাঞ্ছিত জীবন তুলে ধরা হয়েছে। যা সমকালীন সমাজের অন্যতম জ্বর। ‘বানিয়াশান্তা’ কবিতায় মানুষের জীবনবোধ ও করুণ যন্ত্রণার কথা উঠে এসেছে, যা এখানকার গণতন্ত্রের আড়ালে সৃষ্ট কুৎসিত। ‘খুন্তি’ কবিতায় ‘সুতরাং জলের হৃদয় প্রসঙ্গ আসলেই/সমকামী বেদের এপিটাফে ভেসে যায় ময়ূরপক্ষী’—এই পঙক্তিতে মধ্যবিত্তের ন্যাকামি তুলে ধরা হয়েছে। বিলাসী ঢঙে নিজস্ব সূত্র হারিয়ে এসব মানুষ এখন পশুর মতো হয়ে যাচ্ছে। তাদের বিলাসিতার রেখা এঁকে দিচ্ছে একজন না খাওয়া গৃহকর্মীর ওপর, যা জারজের জন্মের মতোই!

গিরীশ গৈরিকের কবিতায় ইতিহাস, মিথ, সমকালীন চিন্তা, ঘৃণা, বৈষম্যের প্রতিবাদসহ নানা অনুষঙ্গ উঠে এসেছে। গিরীশ তাঁর চর্চায় অব্যাহত থাকলে কাব্যজগতে বয়ে নিয়ে আসবে আলোকের ঝর্ণাধারা। আমরা কেবল সেই মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করব।

কবিতাগ্রন্থ : ক্ষুধার্ত ধানের নামতা

প্রকাশনী : বেহুলাবাংলা

প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর

মূল্য : ১৩৫

Recent Posts

Leave a Comment