স্টার ওয়ার্স ফিরিয়ে দিয়ে ভুল করেছিলাম : পাচিনো

 In শিল্প-সাহিত্য

মেহেদী নোভেল

‘নেভার হেট ইয়োর এনিমিজ। ইট এফেক্টস ইয়োর জাজমেন্ট’—যদি এই সংলাপ আপনি শুনে থাকেন, তাহলে আল পাচিনোর নাম আপনি নিশ্চিতভাবে শুনেছেন। সত্তরের দশকে পর্দাকাঁপানো সিনেমা ‘গডফাদার’ দিয়ে সবার কাছে পরিচিতি পেলেও পাচিনোর শুরুটা ১৯৬৯ সালে ‘মি. নাটালি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এরপর ‘গডফাদার’ টু, থ্রি নিয়েও পর্দায় এসেছেন তিনি। অভিনয় জীবনের শুরুতে গুরু হিসেবে পেয়ছেন চার্লি লাংটন, লি স্টারসবাগের মতো তারকাদের। তবে অনেক দিন ধরেই চলচ্চিত্র জগৎ থেকে দূরে রয়েছেন এই তারকা। সাক্ষাৎকারভিত্তিক ওয়েবপোর্টাল ‘দ্য টকস’-এ প্রকাশিত আল পাচিনোর অনেক কথাই ভক্তদের মন ছুঁয়ে যাবে। সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন মেহেদী নোভেল।

মিস্টার পাচিনো, আপনি কীভাবে আপনার অর্জনগুলোর মূল্যায়ন করবেন?

আল পাচিনো : আমি ঠিক জানি না। আপনি এটা এভাবে না ভাবলেও পারেন। আপনি জীবনের সফলতার অংশগুলোকে অর্জন বলে মনে করবেন না। আপনি যে ভূমিকায় অভিনয় করছেন বা যে ছবিটি আপনি এঁকেছেন, সেটা আপনার অর্জন নয়। আমি বলতে চাইছি, ধরুন একজন অভিনেতা বলল—আমি আর চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে চাই না, কারণ আমি সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের চেয়ে ভালো করতে পারব না। আমার এখন এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিত। এমন একজনকে নিশ্চয় কেউ জয়মাল্য পরিয়ে দেওয়ার জন্য ডাকবে না। আমি আসলে এইটাই বলতে চাইছি। আপনি যখন কাজ ছেড়ে দেবেন, তখন হয়তো একটা বড় চেক পাবেন, আরেকটা পেশায় ঢুকবেন। কিন্তু পেশার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার খাতিরে আমি চাইব, আপনি আপনার পেশায় ফিরে যান এবং সেটাই করুন, যেটা আপনি করছিলেন।

তাহলে এখন আপনি নতুন কিছু করার চেষ্টা করতে চান?

আল পাচিনো : হ্যাঁ, যদি আমি এমন কিছু পাই, যেখানে আমার মনে হয় আমি অবদান রাখতে পারব এবং আমি এর মধ্যে আছি, এর মাধ্যমে আমি কিছু বলতে পারছি, সেটার কী মানে দাঁড়ায় তা কোনো বিষয় নয়। যে মানেই দাঁড়াক না কেন, শেকসপিয়ারের বাণী, ‘প্রকৃতি যেমন আয়নাতে তেমনই ধরা পড়ে’ এই নীতিই অনুসরণ করে যাব।

যদি আমি এমন কিছু প্রকাশ করতে পারি, যে আমি মনে করছি আমার প্রতিভার চর্চা করতে পারব এবং আমার চরিত্রের সঙ্গে মানুষ হিসেবে কথা বলতে পারব চলচ্চিত্রে, আমি সেই কাজটা করার চেষ্টা করব। আমি অবসর কথাটা বলতে চাই না, কারণ একজন শিল্পীর জন্য ‘অবসর’ কথাটা শুনতে অদ্ভুত লাগে।

ক্রিস্টো বলছেন, শিল্পীরা কখনো অবসর নেয় না, তাঁরা মারা যায়।

আল পাচিনো : কিন্তু এমনও অনেক শিল্পী রয়েছেন, যাঁরা অবসর নিয়েছেন। যেমন ফিলিপ রথ। আমি তাঁর বইয়ের ওপর ভিত্তি করে বানানো ছবি ‘দ্য হাম্বলিং’-এ অভিনয় করেছিলাম। তিনি ভালোই লিখছিলেন, লেখালেখি নিয়ে তিনি খুশি ছিলেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি চলে যাবেন এবং সেটাই করেছেন যেটা তিনি বলেছেন। আমি এটা বুঝি। এটা অনেকটা রুটিনের মতো। আপনি স্ক্রিপ্ট পাবেন, আপনাকে স্ক্রিপ্টটা মুখস্থ করতে হবে এবং বারবার আপনাকে একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তাই আপনাকে অন্য কিছুর প্রতি ঝুঁকতে হবে, পরিচালক আপনাকে এভাবেই ব্যবহার করতে চান।

কিন্তু নিশ্চিতভাবে সব পরিচালক তাঁদের চলচ্চিত্রে আপনাকে চান।

আল পাচিনো : প্রথম ‘গডফাদার’ চলচ্চিত্রের আগে কেউ আমাকে চাইত না। কিন্তু ফ্রান্সিস আমাকে চাইত। তিনিই শুধু আমাকে চাইতেন। আমি তখন বুঝতাম না। স্টুডিও আমাকে তখন চাইত না, কেউ চাইত না, কেউ আমাকে নিয়ে চিন্তা করত না। আমি মনে করি, যখন একজন পরিচালক যখন কাউকে নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, তখন তাঁর মধ্যে পিছিয়ে পড়ার চেয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকা উচিত। আপনি এমন একটি ঝুঁকি বা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছেন, যা আপনাকে হয় একেবারে নিচে ফেলে দেবে বা ওপরে উঠিয়ে সামনে দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

কেন?

আল পাচিনো : যখন লম্বা সময় ধরে কাজটি করতে চান, তখন নিজেকে উন্মুক্ত রাখুন। আপনার এটা বন্ধ করা উচিত নয়, কারণ দুর্বলতারও একটি গুরুত্ব রয়েছে। আপনি আপনার চামড়াকে অধিক পুরু হতে দেবেন না। যেমনটা ব্রেখট যুবক বয়সে লেখা একটি নাটকে বলেছেন। ২২ বছর বয়সে তিনি ‘জাঙ্গল অব সিটিস’ নাটকটি লেখেন এবং সেখানে একটি চরিত্র বলে ওঠে, ‘মানুষের চামড়া এই বিশ্বের জন্য খুবই পাতলা।’ তাই তিনি দেখলেন, এটি দিন দিন পুরু হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত চামড়া পুরু হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত আর কোনো কিছু তার গায়ে লাগবে না।

আপনি কি আপনার এমন কোনো ছবির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন, যা আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে করতে হয়েছিল?

আল পাচিনো : আমি কোনো কিছুতেই দুঃখ পাই না। আমি মনে করি, আমি যা করেছি তাকে আমি ভুল মনে করি। আমি ভুল ছবি নিয়েছিলাম অথবা আমি ভুল চরিত্রের পিছু পিছু ছুটেছি, না হয় আমি সাধারণ কারো চরিত্রে অভিনয় করছি এবং কিছু নির্বাচন করেছি… কিন্তু সবকিছুই আপনার জীবনের অংশ, এবং আপনি এখান থেকে কিছু না কিছু নিতে পারবেন। এর মানে আমি বলতে চাইছি, এই অবস্থায় এবং জায়গায় থাকার ধারণা এবং উত্তেজনা, এগুলো একটি স্মৃতির চেয়ে বিশেষ কিছু, তারা আপনার জীবনকে কিছু জানাতে চায়। তাই কোনো কিছুতেই দুঃখ করা উচিত নয়।

স্টার ওয়ার্সের মতো চলচ্চিত্র ফিরিয়ে দেওয়াটাও কি ভুল নয়?

আল পাচিনো : স্টার ওয়ার্স। হ্যাঁ, সেটা আমার প্রথম বড় ভুল ছিল।

এবং টেরেন্স মালিকের স্ক্রিপ্ট?

আল পাচিনো : হ্যাঁ, অনেক দিন আগে টেরি আমাকে তাঁর ছবিতে চেয়েছিলেন এবং আমি সব সময় তাঁর ছবিতে অভিনয় করতে চাইতাম। এটা আমার জীবনের অনেকগুলো ভুলের মধ্যে আরেকটি ভুল। এটা আমার ভুলের জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। বলতে গেলে সব স্ক্রিপ্ট, যা আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। আপনার নিজেকে উন্মুক্ত করা উচিত। নিজেকে আটকে রাখতে চাওয়াটা উচিত নয়। আপনি আপনার চামড়াকে মোটা হতে দিতে পারেন না।

আপনি কি বলবেন যে আপনার বর্তমানে অভিনয়ের ধরন পূর্বের ধরনের থেকে আলাদা ছিল?

আল পাচিনো : হ্যাঁ। আমার যতদূর মনে পড়ে, আলাদা ছিল। আমি আমার আগের ধরনের ওপর ভিত্তি করে অনেক দূর যেতে পারব না। আমরা আসলে আমাদের জীবনচক্রের অনুসারে বসবাস করতে থাকি এবং আমি মনে করি, জীবন মানে এটাই। আমার মতে, আমি এই এখানে আছি, তারপর এখান থেকে হারিয়ে যাব। যেকোনো সময় চলে যেতে পারি এবং আমরা জানি না, আমরা কখন চলে যাব, কেউ জানি না। তাই বলা যায়, আমার আমাদের জীবনচক্রের অনুসারে চলি।

আপনি আপনার জীবনচক্রকে উপভোগ করছেন?

আল পাচিনো : আপনি নিজেও জানেন যে আপনি কখনো বের হতে পারবেন না—একটি গ্লাস অর্ধেক খালি, না অর্ধেক ভরা। আর জীবনটা আসলে এই নীতিতে চলে।

এমনও দিন আমি কাটিয়েছি, যেগুলো আমি উপভোগ করেছি। আবার এমনও দিন গেছে, যা আসলে উপভোগ্য হয়নি। যদি আমি একজন চিত্রশিল্পী হতাম, তাহলে কেউ আমার বয়স নিয়ে প্রশ্ন তুলত না। ‘আমি আঁকি! আমি একজন শিল্পী!’ আমি এ কথা বলতে ঘৃণাবোধ করি। আমি এ কথা বলতে পছন্দ করি না। আমি আমার জীবনের শুরুতে একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শিখেছি। যে নারীর সঙ্গে আমার বসবাস সে আমাকে বলেছে, ‘তুমি যা-ই করো না কেন, কখনো তাদের বলো না যে তুমি একজন শিল্পী।’ আমি বলেছি, ‘আমি জানি, আমি কখনো তাদের বলব না, আমি একজন শিল্পী!’ (হাসি) আমি এই বিষয়টাকে এড়িয়ে গেছি এবং আমি এই বিষয়টাকে প্রায় অনেক বছর ধরে এড়িয়ে গেছি। এর পরিবর্তে আমি বিষয়টা এই পথে চিন্তা করেছি, আমি মনে করি আমি একজন শিল্পী। আমি আশা করি, আমি একজন শিল্পী। কিন্তু যদি আমি মনে করি, আমি একজন চিত্রশিল্পী (পেইন্টার অর্থে আর্টিস্ট), তাহলে বিষয়টা আলাদা হয়ে যাবে।

কিন্তু সব অভিনেতাও একই সমস্যায় ভুগছেন।

আল পাচিনো : কারণ, তারা চাক্ষুস সবকিছু দেখছে। এটা ঘটছে, কারণ তারা ছবি দেখছে। এটা ঘটছে, কারণ তারা আমাদের ছবি নিয়ে কাজ করছে, এমনকি তারা বিভিন্ন চরিত্রে চলচ্চিত্রে অভিনয় করছে। কিন্তু আসলে সব সময় তাদের মনে একটি ছবি থাকছে… আর এটা তোমার জীবনের অংশ, আর এখানেই নিজেকে শিল্পী দাবি করার ভণ্ডামিটা, কারণ যতই তুমি নিজেকে শিল্পী দাবি করো না কেন, তুমি আসলে একজন চলচ্চিত্র তারকা এবং সেটাও এক ধরনের ভুল! সেটাও এক ধরনের ভণ্ডামি। আমি একজন চলচ্চিত্র তারকা। আর এটা ভণ্ডামি বলেই একজন চলচ্চিত্র তারকার আর কোনো পরিচয় থাকছে না।

Recent Posts

Leave a Comment