অপরাধী মা!

 In খোলা কলাম

 

 

 রুখসানা মিলি

প্রায় ১৫বছর পরে বন্ধুর সাথে হঠাৎ দেখা। কলেজের দিনগুলোতে যার সাথে কাটতো আমার অনেকটা সময়। দুই বন্ধুতে গল্পের ঝাঁপি খুলে বসি। ও ৬ বছর বয়সী এক সন্তানের মা। আর আমার দুটো সন্তান ৮ আর ৫। আমি কর্মজীবী নারী, আমার বন্ধু গৃহিণী। এই গল্পে সেই গল্পে আমি যে প্রায় অফিসের প্রয়োজনে ঢাকার বাইরে এমনকি দেশের বাইরে গিয়েও থাকি তা এসে পড়ে। বন্ধু অবাক হয়ে বলে কেমন করে পারিস? তোর মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে না। এত ছোট ছোট বাচ্চা রেখে কিভাবে ঢাকার বাইরে বা দেশের বাইরে গিয়ে থাকিস?

অপরাধবোধ? হ্যাঁ আমার মত কর্মজীবী মায়েদের হরহামেশায় এই শব্দটার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় সমাজ। আর আমরা কর্মজীবী মায়েরা সেই অপরাধবোধে পুড়ে পুড়ে অনেক ক্ষেত্রেই নিজের ক্যারিয়ারকে ধিক্কার দিতেও কুণ্ঠাবোধ করিনা।

পেপসিকোর চেয়ারপারসন এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইন্দ্রা নুয়ি’র একটা সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। তার মেয়ে স্কুল থেকে এসে বলে সব মায়েরা প্রতি সপ্তাহে ‘কফি উইথ প্যারেন্টস’ মিটিং যায়, কেবল তুমি যাও না। তিনি মেয়ের এই কথায় অপরাধ বোধে ভুগতেন। আবার একজন পুরোদুস্তর কর্মজীবী নারীর পক্ষে কি করে প্রতি সপ্তাহে ওয়ার্কিং ডে তে মেয়ের স্কুলের পার্টিতে যাওয়া সম্ভব? তিনি উপায় খুঁজে বের করেন। তিনি ছাড়া আর কোন মায়েরা স্কুলে নিয়মিত যেতে পারেন না তাদের সম্পর্কে জানেন। এরপর মেয়ের প্রশ্নের জবাবে অপরাধবোধে পুড়ে না গিয়ে তাকে বাস্তবতা বোঝান। আরো যে মায়েরা যেতে পারেনা তাদের উদাহরণ দিয়ে বোঝান।

কর্মজীবী মায়েরা তাদের সন্তানদের কম ভালবাসেন না। দায়িত্বও কম পালন করেন না। তারপরও তারা অপরাধবোধে ভোগেন এবং নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান।
সন্তানরা আমার পৃথিবী। ওদের সাথে যখন থাকি সেটাই আমার সবচেয়ে আনন্দময় সময়। ওরা পৃথিবীর সবকিছুর চেয়ে আমাকে ভালবাসে। আবার আমি কাজ করতে ভালবাসি। আমার কাজের ক্ষেত্রে কোন ছাড় দিতে চাই না। এই দুয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করে কোন অপরাধবোধকে আমি সামনে আনতে চাইনা।

প্রথমবার যখন অফিসের একটা কাজে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হল তখন শুরুতে আমি রাজি হইনি। বাচ্চার কথা ভেবেছিলাম। আমার অপরাধবোধ থেকে আমাকে টেনে বের করেছে আমার মা। তিনি বলেছিলেন সুযোগ সবসময় আসে না। এটাতে ছাড় দেওয়া ঠিক না। বাচ্চারা ভাল থাকবে। মায়ের দেয়া সাহসে ভর করে আমি এগিয়ে চলেছি। কেবল তাই নয় যখন আমি থাকি না তখন বাচ্চাদের সাথে ওর বাবার অদ্ভুত কিছু সময় কাটে। মমত্বের বন্ধন বাবাদের কি কোন অংশে কম হয়? আমার আব্বা তার সবচেয়ে বেশি ভালবাসা দিয়েছেন আমাকে। তাই কর্মজীবী মা কে অপরাধের কাঠগড়ায় না দাঁড় করিয়ে বরং বাবার সাথে সন্তানদের মমত্বের বন্ধনকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারেন।

আমার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া এই সাহস আর শুভবোধের উত্তরাধিকারী আমার সন্তানদের করে যেতে চাই। যেন ওর ক্যারিয়ারে ওর বাচ্চাদের লালন পালন কোন অপরাধবোধ হয়ে কাজ না করে। অবারিত ভালবাসায় নিজের এবং সন্তানদের জন্য এক অনন্য ভুবন গড়ে তুলতে পারুক ওরা।

Recent Posts

Leave a Comment