মধুমাস যেন বিফলে না যায়

 In খোলা কলাম
লিয়াকত হোসেন খোকন
জ্যৈষ্ঠ হল মধুমাস। এ মাসে বাজার সয়লাব হয়ে যায় আম, কাঁঠাল, লিচু, জামসহ কত না ফলে। একসময় এ জ্যৈষ্ঠেই হতো জামাইষষ্ঠী, যার আরেক নাম আরণ্যষষ্ঠী। কত না ফুল ফোটে জ্যৈষ্ঠে। বনপথে চলতে গিয়ে কখনও বা বকুলতলে দাঁড়িয়ে মনে পড়ত- ‘পথে পথে ওই বকুল পড়িছে ঝরিয়া/ চাঁদের স্বপনে নভোনীল গেছে ভরিয়া’ গানের এই কথাগুলো। মধুমাসের প্রধান ফল আম নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘বন্ধু, আজো মনে পড়ে আম কুড়ানোর খেলা/ আম কুড়াইতে যাইতাম দু’জন নিশি ভোরের বেলা।’ ১৯৪০ সালে রেকর্ডে এই গানে কণ্ঠ দিয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন আব্বাস উদ্দিন আহমেদ।
বাংলাদেশে আমের প্রধান এলাকা হল চাঁপাইনবাবগঞ্জ। জ্যৈষ্ঠে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের ছড়াছড়ি। ৫৮ জাতের আম ফলে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। ফজলি, ল্যাংড়া, হিমসাগর, গোপালভোগ, আম্রপালি, গোগলা গুটি, মোহনভোগ, বালুসার ইত্যাদি আমের উল্লেখযোগ্য জাত। মূলত মহানন্দার ওপারে শিবগঞ্জ, কানসাট, সোনা মসজিদ এলাকাতেই বেশি আম হয়।
লিচুর জন্য বিখ্যাত দিনাজপুর ও রাজশাহী এলাকা। লিচুর উল্লেখযোগ্য জাত হল চায়না, বোম্বে, বারি। পাবনার সন্তান গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার প্রিয়তমার সঙ্গে মধুমাসে দেখা হবে কী হবে না এই আক্ষেপ নিয়ে গান বেঁধেছিলেন- ‘বধূ গো এই মধু মাস বুঝিবা বিফল হল/ ভুলে গেছ তুমি সেই মধু নামে ডাকা/ মিলন ছায়া মধুমাস আজিকে ঢাকা বধূ গো- বধূ গো…।’ এ গানে কণ্ঠ দিয়ে শচীনদেব বর্মন বহু আগেই কিংবদন্তী হয়েছেন। এছাড়া ৫২ বছর আগে কণ্ঠশিল্পী মাহাবুবা রহমান (নিভা রানী রায়) গেয়েছিলেন, ‘জ্যৈষ্ঠ মাসে মিঠা ফল গাছে পাকা আম/ আম পাকে কাঁঠাল পাকে আরও পাকে জাম/ দেশের বন্ধু থাকলে দেশে তারে খাওয়াইতাম।’
গানের এসব কথা আজ যেন মিথ্যে হয়ে গেছে। অনেকেই এখন আক্ষেপ করে বলেন, বাঙালির জীবন থেকে হারিয়ে গেছে মধুমাস। একদা জামাইকে মধুমাসের মধু ফল খাওয়াতে বড্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ত শ্বশুর-শাশুড়ি। ফরমালিনের ভয়ে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু খেতে চায় না নতুন জামাই। তাই এখন আর জামাইরা শ্বশুরবাড়িও যায় না জ্যৈষ্ঠে। শুধু জামাই নয়, দেশের সাধারণ মানুষও এখন আম, লিচু, জাম খেতে ভয় পায়। ফরমালিন/কার্বাইড দেয়া ফল খেলে ক্যান্সার হবে, কিডনি হয়ে যাবে নষ্ট এই ভয়ে বিশেষ করে আম এখন অনেকেই খেতে চায় না। আর এজন্যই অনেকে আর জ্যৈষ্ঠ মাসকে বলতে চায় না মধুমাস।
মধুমাস নামটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে অসৎ ফল ব্যবসায়ীদের কারণে। তবে এ জ্যৈষ্ঠে মনে পড়বেই ছেলেবেলায় আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু খাওয়ার সেই দিনগুলোর স্মৃতি। আমাদের শৈশবে জ্যৈষ্ঠে আম, কাঁঠাল, জাম, লিচুসহ নানা ধরনের ফল খাওয়ার ধুম পড়ে যেত ঘরে ঘরে। মধুমাসের মধু ফল খাওয়ার জন্য ১৫-২০ দিন স্কুল ছুটি থাকত। তখন নানা বাড়ি, দাদা বাড়ি গিয়ে সবাই মধুমাসের ফল খেত। সেই যুগে ক্ষতিকর কীটনাশক দেয়ার কথা ভাবতেই পারত না কেউ।
লিয়াকত হোসেন খোকন : লেখক
Recent Posts

Leave a Comment