নির্বাচন কমিশনের নিকট কিছু প্রস্তাবনা

 In খোলা কলাম
গ ণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সত্যিকারার্থে কার্যকর করতে হলে শুধু সত্, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিদের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়। এর জন্য আরো প্রয়োজন নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংস্কার। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সুসংহত ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে মোটাদাগে বর্তমানে নিম্নোক্ত বিষয়ে সংস্কার অপরিহার্য বলে আমরা মনে করি:
ভোটার তালিকা : ২০০৮ সালে সেনাবাহিনীর সহায়তায় একটি ছবিযুক্ত সঠিক ভোটার তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যে তালিকায় পুরুষের তুলনায় ১৪ লাখের বেশি নারী ভোটার অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে ভোটার তালিকায় হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় ‘জেন্ডার-গ্যাপ’ দেখা দেয়, অর্থাত্ পুরুষ ভোটারের তুলনায় নারী ভোটারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, সর্বশেষ খসড়া হালনাগাদের তথ্য অনুযায়ী, মোট ১৪ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭২ জন ভোটার ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, যার মধ্যে নারী ভোটার সংখ্যা মাত্র পাঁচ লাখ ৯৪ হাজার ৮৬০ জন, অর্থাত্ নারী-পুরুষের অনুপাত ৪০:৬০ এবং জেন্ডার-গ্যাপ ২০ শতাংশ (বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ৩ জানুয়ারি ২০১৭), যদিও হালনাগাদের মাধ্যমে মোট কত ভোটার তালিকায় সংযুক্ত হয়েছে তা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে।
সীমানা পুনঃনির্ধারণ : নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কয়েকটি সুস্পষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে তা করা হয়, যার একটি হলো সংসদীয় আসনগুলোতে ভোটার সংখ্যায় যতদূর সম্ভব সমতা আনা। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ৮৭টি নির্বাচনী এলাকায় সীমানা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে এবং এর ফলে ভোটার সংখ্যায় অসমতা আরো বেড়েছে, যা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড উভয়েরই লঙ্ঘন (যুগান্তর ২১ মে, ২০১৩)।
আইনি কাঠামো : সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হলে আইনি কাঠামোতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। যথা—(১) ‘না-ভোটে’র বিধানের পুনঃপ্রবর্তন; (২) মনোনয়নপত্র অনলাইনে দাখিলের বিধান; (৩) জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচনের ক্ষেত্রে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা ও আয়কর বিবরণী দাখিলের বিধান; (৪) সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে প্রদান; এবং (৫) রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক সদস্যদের নাম ওয়েবসাইটে প্রকাশ ও নিয়মিত আপডেট করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি। ইত্যাদি ইত্যাদি।
মনোনয়নের লক্ষ্যে তৃণমূল থেকে প্যানেল তৈরির বিধানের প্রয়োগ :
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে প্রত্যেক সংসদীয় আসনের জন্য একটি প্যানেল তৈরি করার এবং সেটি থেকে কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড মনোনয়ন দেওয়ার বিধান অধ্যাদেশ আকারে জারি করা আরপিওতে  অন্তর্ভুক্ত ছিল (ধারা ৯০খ)। পরবর্তীকালে অধ্যাদেশটি সংসদে অনুমোদনের সময়ে এ বিধানের পরিবর্তন আনা হয়। সংশোধিত বিধান অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডকে আর তৃণমূলে তৈরি প্যানেল থেকে মনোনয়ন দিতে হবে না, বোর্ডকে তা শুধু বিবেচনায় নিতে হবে। এতে তৃণমূলের মতামত উপেক্ষিত হচ্ছে এবং মনোনয়ন বাণিজ্য দিন দিন বেড়ে চলেছে।
দলের কমিটিতে নারী প্রতিনিধিত্ব : রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সকল পর্যায়ের কমিটিতে ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব রাখারও বিধান রয়েছে (আরপিও ৯০খ)। আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশনের এটি মনিটর করা প্রয়োজন।
নির্বাচনী বিরোধ : সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে নির্বাচনী বিরোধের দ্রুত মীমাংসা হওয়া আবশ্যক। কিন্তু আমাদের দেশে নির্বাচনী বিরোধ সংক্রান্ত মামলাগুলো নিষ্পত্তির ব্যাপারে ব্যাপক দীর্ঘসূত্রিতা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচনী মামলা সংসদের মেয়াদ শেষ হবার আগেও নিষ্পত্তি হয় না। নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী ফলাফল বাতিলের ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের উচ্চ আদালতের অনেকগুলো সুস্পষ্ট রায় রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নূর হোসেন বনাম মো. নজরুল ইসলাম মামলার [৪৫বিএলসি (এডি)(২০০০)] রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিগণ বলেন: ‘আমরা একথা পুনঃব্যক্ত না করে পারি না যে, নির্বাচন চলাকালে গোলযোগের, ব্যালট পেপার কারচুপির বা নির্বাচন সঠিক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়নি বলে রিপোর্ট বা অভিযোগ উত্থাপিত হলে, উক্ত রিপোর্ট বা অভিযোগের সত্যতা যাচাইপূর্বক কমিশনের ফলাফল বাতিল ও পুনঃনির্বাচনের নির্দেশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক। কিন্তু নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচন পরবর্তী অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্বাচনী ফলাফল বাতিল করার কমিশনের সিদ্ধান্ত সঠিক হবে না।’
হলফনামা যাচাই/বাছাই ও ছকে পরিবর্তন : ভোটারদের অবগতির জন্য নির্বাচনে প্রত্যেক ব্যক্তিকে মনোনয়নপত্রের সাথে একটি হলফনামা দাখিল করতে হয়। এটি প্রায় সর্বজনবিদিত যে, অনেক প্রার্থী তাদের হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেন বা তথ্য গোপন করেন, যে কারণে তাদের মনোনয়নপত্র এবং নির্বাচিত হলে নির্বাচন বাতিল হবার কথা। তাই আমরা মনে করি যে, হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই করে অসমাপ্ত হলফনামা প্রদানকারী, তথ্য গোপনকারী ও ভুল তথ্য প্রদানকারীর প্রার্থিতা বাতিল কিংবা তাদের নির্বাচন বাতিল করা আবশ্যক। এ কাজটি করা হলে অনেক অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের নির্বাচনী অঙ্গন থেকে দূরে রাখা এবং আমাদের রাজনীতি বহুলাংশে কলুষমুক্ত করা সম্ভব হবে বলে আমরা মনেকরি। এছাড়া হলফনামার ছকটিও অসম্পূর্ণ এবং এতে গুরুতর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন, এতে স্থাবর সম্পদের হিসাব ক্রয় মূল্যে প্রদর্শনের বিধান রাখা হয়েছে, যাতে প্রার্থীর ও প্রার্থীর নির্ভরশীলদের প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হয় না। এ লক্ষ্যে নবগঠিত কমিশনকে হলফনামার ছকটিতে পরিবর্তন আনার জন্য আমরা অনুরোধ করছি।
ইউনিয়ন পর্যায়ে হলফনামা : বর্তমানে স্থানীয় সরকারের অন্যান্য স্তরে হলফনামা প্রদানের বিধান থাকলেও ইউনিয়ন পরিষদে এরকম আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। আমরা মনেকরি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও প্রার্থী কর্তৃক হলফনামা প্রদানের বিধান যুক্ত হওয়া উচিত। কমিশন তার বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা ব্যবহার করেই এটি করতে পারে।
কমিশনে নিয়োগ আইন : নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন বিষয়ে একটি আইন প্রণয়ন অতি জরুরি, তাই নতুন কমিশনকে এব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে। আমরা মনে করি, ভবিষ্যতে কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিতর্ক এড়াতে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সংবিধানের আলোকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের জন্য একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন জরুরি।
নির্বাচনী সহিংসতা রোধ :শামসুল হুদা কমিশনের সময়ে নির্বাচনী সহিংসতা ছিল না বললেই চলে। উদাহরণস্বরূপ, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। সেই কমিশনের সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের মনোনীত প্রার্থীরাও আইন-কানুন মানা শুরু করেছিল। বিগত রকিব উদ্দিন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমূহে ব্যাপক সহিংসতা ঘটেছে। যেমন, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১৫০ জন নিহত হয়েছেন, বহু ব্যক্তি আহত হয়েছেন এবং ব্যাপক জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। তাই আমরা মনেকরি, নতুন নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনী সহিংসতা রোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
নির্বাচনী ব্যয়সীমা : নির্বাচনী ব্যয়ের বৈধ সীমা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বিগত কমিশন এ ব্যয়সীমা ১৫ লক্ষ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা করেছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার থাকলেও তারা প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আর আমাদের জাতীয় সংসদ পরিণত হয়েছে কোটিপতিদের ক্লাবে। বস্তুত আমাদের বর্তমান ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে ‘বেস্ট ডেমোক্রেসি মানি ক্যান বাই’। তাই কমিশনকে নির্বাচনী ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে হবে এবং একইসঙ্গে নির্বাচনী ব্যয়ের বৈধ সীমা কমাতে হবে।  নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রার্থীদের পোস্টার ছাপানো ও প্রচার এবং সকল প্রার্থীকে এক মঞ্চে এনে প্রজেকশন মিটিং আয়োজনের মধ্য দিয়েও নির্বাচনী ব্যয় হ্রাস করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন ও বৈদেশিক শাখা : আরপিও’র ৯০(গ) ধারা অনুযায়ী, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের বিদেশি শাখা থাকা বেআইনি, যা রাজনৈতিক দলগুলো অমান্য করেই চলছে। এছাড়াও নিবন্ধনের শর্ত হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন বিলুপ্ত করার বিধান আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যার প্রতি রাজনৈতিক দলগুলো ভ্রুক্ষেপও করছে না।
দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন : আমরা মনে করি যে, স্থানীয় নির্বাচন নির্দলীয় হওয়া উচিত। কেননা স্থানীয় পর্যায়ে এমন অনেক ভালো মানুষ আছে যারা দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন কিন্তু তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং জনসেবা করতে চান। দলীয়ভিত্তিতে স্থানীয় নির্বাচন হলে এ-সকল ব্যক্তিদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ অনেক কমে আসে এবং প্রভাবশালী, বিত্তশালী ও রাজনৈতিক দাপট থাকা বিতর্কিত লোক নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ প্রশস্ত হয়। এছাড়া দলভিত্তিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রার্থী সংখ্যা কমে আসে, তাদের মানে অবনতি ঘটে এবং তৃণমূল পর্যায়ে দ্বন্দ্ব, হানাহানিরও বিস্তৃিত ঘটে। উপরন্তু দলভিত্তিক নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে দলবাজি বিস্তৃত হয়।
সোসাল মিডিয়ার জন্য আচরণবিধি প্রণয়ন : আমরা মনে করি যে, সোসাল মিডিয়ার জন্য আচরণবিধি প্রণয়ন জরুরি, যাতে ভুয়া এবং অসত্য সংবাদ প্রকাশ বন্ধ করা যায়। কারণ অসত্য সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে নির্বাচন প্রভাবিত হতে পারে।
n লেখক :সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
Recent Posts

Leave a Comment