যোগ্যতার ছাপ মুখশ্রীতেই

 In খোলা কলাম

আমরা প্রায় অনেকেই ভাবি লেখালেখি করলে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মধুসূদন, জীবনানন্দ পড়লে লেখক লেখক একটা ভাব দরকার। চশমা পড়া, গাম্ভীর্যপূর্ণ ছবিগুলো প্রোফাইল ছবি করলে লেখকের একটা ইমেজ তৈরি হবে।

আমরা যা নই তার ভাব নেয়া খুব কঠিন কিছু নয়, আজকাল প্রায় সকলেই এ কাজই করছেন। তাই কালক্রমে যোগ্যতার অভাবে একটা মেকি ভাবের পরিবার থেকে একটা মেকি সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র তথা সম্পূর্ণ মেকি একটা পৃথিবী গড়ে উঠছে। কালের এই থাবানো দুর্দশা আমাদের শিক্ষার্থীর শিক্ষা, শিল্পীর শৈল্পিকতা, শীল্প-সংস্কৃতি, ও সাহিত্যাঙ্গনকেও গ্রাস করে ফেলছে।

যোগ্যতা থাকলে মুখশ্রীতে সেই যোগ্যতার ছাপ, ভাব, অবয়ব সব অনায়াসেই ফুটে ওঠে। এই ফেসবুকের যুগে আমরা কতো সহজে নিজেই নিজেকে কবি, লেখক উপাধিতে ভূষিত করে ফেলি। কয়টা লাইক পড়লো, কয়টা কমেন্ট পড়লো, কয়টা শেয়ার হলো তা দিয়েই যাচাই করে ফেলি লেখক আর লেখকের লেখার নৈপুণ্য, সাফল্য, জনপ্রিয়তা সবই। অথচ জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর প্রায় ষাট বছর পর তিনি পরিপূর্ণ কবি হিসেবে বাংলা, ইংরেজি তথা বিশ্ব সাহিত্যে স্বীকৃতি পান।

জীবনানন্দ দাশের জীবদ্দশায় তাঁর ‘কবি’ খ্যাতি সাহিত্যদর্পণে প্রকাশ পেলেও ততোটা খ্যাতি অর্জিত হয় নি, যা বর্তমান তাঁকে এনে দিয়েছে। কেননা তৎকালের সমগ্র বাংলা সাহিত্য ছিল একমুখী, রবীন্দ্র নির্ভর। জীবনানন্দের মৃত্যুর পর ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থের সবগুলো কবিতাই তাঁর জীবৎকালে অপ্রকাশিত ছিল। এবং মৃত্যুর পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে কবির গভীর স্বদেশপ্রীতি এবং ব্যক্তিগত প্রেমময় স্মৃতি প্রকটে প্রকাশ পায়। এমনকি রবীন্দ্রনাথ নিজেও জীবনানন্দ দাসকে কবির স্বীকৃতি দেননি।

জীবনানন্দের দাশের সবচেয়ে পরিচিত কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’-এর সংস্করণ দুটি। প্রথমটি ১৯৪২ সালে কবিতাভবন সংস্করণ এবং এর দশ বছর পর সিগনেট প্রেস-সংস্করণ প্রকাশিত হয়। জীবনানন্দ দাশ, শুদ্ধতম-মহত্তম কবি, যাঁর কবিতা সৃষ্টিতে সকলে প্রবেশ করতে পারে না। তিনি নিজেই বলেছিলেন- “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।” সম্ভবত এজন্য, জীবনানন্দ দাশ; সকলের কবি নন, কারো কারো কবি।

অন্যদিকে ইংরেজি কবিতার আধুনিকতার সূচনা করেছিলেন ভিক্টোরীয় যুগের কবি হপকিনস। বাক্যের গঠনশৈলী ও কাব্যের বিষয়বস্তুকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্ঠা ছিল তাঁর। এমনকি হপকিনস ও তাঁর জীবদ্দশায় কবি হিসেবে স্বীকৃত হননি। তাঁর কাব্যগ্রন্থ “The Poems of Gerard Manley Hopkins”, যা ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয়। এর অনেক পূর্বেই ১৮৮৯ সালে হপকিনস মারা গিয়েছিলেন। ফলে এই দীর্ঘসময় তাঁর আবিষ্কৃত নতুন তত্ত্ব অজানা বা অপ্রকাশিত ছিল। কিন্তু এই কাব্যসংগ্রহটি প্রকাশের পর ইংরেজি সাহিত্যের কাব্য প্রেমীরা স্বাদ পেলেন এক নতুন জগতের।

হিসাব অনুযায়ী এ থেকেই ইংরেজি সাহিত্যে ‘মডার্ন’ যুগের সূত্রপাত হয়। এবং প্রায় বিশ শতকের আরম্ভ থেকে পরবর্তী ত্রিশ দশক পর্যন্ত ইংরেজি সাহিত্যে চলতে থাকে নানা নতুন আন্দোলন। আর আমরা একালে দুএকটা ফেসবুক স্ট্যাটাস লিখেই কবি, লেখক, সাহিত্যিক হয়ে উঠি। ইমেজের কথা ভাবি। কিসের ইমেজ? কেন ইমেজ? প্রতিনিয়ত ইমেজের চাপে ক্লিষ্ট হয়ে প্রতিটা শাশ্বত হৃদয় আজ তাঁর নিরুপম বৈভবকে সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলছে। তৈরি হচ্ছেনা প্রকৃত লেখক, প্রকৃত শাসক, প্রকৃত মানুষ। এক ইমেজকে রক্ষা করতে, টিকিয়ে রাখতে আরো কতো ইমেজ ধারণ করতে হয়। এভাবে এই দ্বৈবিধ্য মুখোশের অন্তরালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে সৃজনশীল মনুষ্য প্রতিভার স্বর্গীয়, বিশুদ্ধ, অবিনশ্বর স্থিতি।

লেখক : ডাবলিন ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।

Recent Posts

Leave a Comment