পাহাড় ধসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৪৯

 In প্রধান খবর
চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনায় বুধবার আরও ২৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (এনডিআরসিসি) জানিয়েছে, এদিন বিকাল পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ১৪৯ জনে পৌঁছেছে। শুধু পাহাড় ধসে মারা গেছেন ১৪২ জন। এর মধ্যে রাঙ্গামাটিতে ১০৪, চট্টগ্রামে ২৯, বান্দরবানে ৬, কক্সবাজারে ২ ও খাগড়াছড়িতে একজন নিহত হয়েছেন। এছাড়া অন্যান্য কারণে বাকি ৭ জন মারা গেছেন। এর আগে মঙ্গলবার ১২৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

বুধবার ক্ষতিগ্রস্ত রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান পরিদর্শনে যান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, ত্রাণ সচিব ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারা পাহাড় ধসে নিহতদের স্বজন ও দুর্গতদের পাশে থেকে সরকারের তরফ থেকে সব ধরনের সাহায্য প্রদানের আশ্বাস দেন।

পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনায় শোক জানিয়েছে জাতীয় সংসদ। বুধবার সংসদ অধিবেশনের শুরুতে সংসদের পক্ষ থেকে শোক জানান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এ সময় তিনি বলেন, যারা নিহত হয়েছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা। আর যারা আহত হয়েছেন তাদের দ্রুত আরোগ্য ও সুস্থতা কামনা করছি। যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

রাঙ্গামাটি : বুধবার আরও ৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জেলা শহরের ভেদভেদি ও জুড়াছড়ি উপজেলা থেকে এসব লাশ উদ্ধার করেন। সকালে ভেদভেদিছড়া থেকে উদ্ধার করা হয় মাটিচাপা পড়া কুনতিসোন চাকমা (৩৮), তার মেয়ে সান্ত্বনা চাকমার (৯) লাশ। একই সময়ে উদ্ধার করা হয় রূপালী চাকমা (৩২), তার মেয়ে জুঁই চাকমা (১২) ও ঝুমঝুমি চাকমার (৬) লাশ। আলমগীর (৩৮) ও রুবী (৯) নামে ৯ বছর বয়সী এক শিশুর লাশও উদ্ধার করা হয় ভেদভেদি থেকে। বিকাল ৫টার দিকে জুড়াছড়ি উপজেলা থেকে উদ্ধার করা হয় সতীশ চন্দ্র চাকমা (৫০) ও হ্যাপি তঞ্চঙ্গ্যার (৫) লাশ। বিভিন্ন স্থানে আরও অন্তত ১৫-২০ জন নিখোঁজ রয়েছেন। মাটিচাপায় আটকে পড়াদের উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত আছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ বিপর্যস্ত রয়েছে। পাহাড়ের বাসিন্দারা এক প্রকার অবরুদ্ধ হয়ে আছেন।

দুপুরে রাঙ্গামাটির ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তারা জেলা প্রশাসন চত্বরে পৃথকভাবে নিহতদের পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করেন। ত্রাণমন্ত্রী এর আগে রাঙ্গুনিয়ায়ও ত্রাণ প্রদান করেন ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে। তিনি ত্রাণ নিয়ে কোনো ধরনের অবহেলা সহ্য করা হবে না বলে জানিয়ে দেন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের। একইভাবে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দুপুরে ত্রাণ সহায়তা প্রদানকালে বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য এরই মধ্যে ২৫ লাখ টাকা ও ১০০ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আরও ২৫ লাখ টাকা ও ১০০ টন চাল বরাদ্দ আসবে।

বান্দরবান : বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে শহরের লেমুঝিরি আগাপাড়া এলাকা থেকে শ্রমিক আলমের স্ত্রী কামরুন্নাহার ও  তার মেয়ে সুফিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়। সোমবার ভোররাতে মা-মেয়ে পাহাড় ধসের ঘটনায় মাটিচাপা পড়েছিল। এদিকে জেলা সদরের সঙ্গে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বুধবার পুনরায় চালু হয়েছে। তবে সদর থেকে রুমা ও রোয়াংছড়ি এবং রাঙ্গামাটি জেলার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এসব এলাকার সড়কপথ পাহাড় ধসের মাটিতে তলিয়ে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলীরা। যানবাহন চলাচল উপযোগী করতে কাজ করছে সওজ।

বুধবার দুপুরে বান্দরবানে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন ওবায়দুল কাদের, মাহবুবউল আলম হানিফ ও পার্বত্যবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর। এ সময় তারা  দুর্গতদের মাঝে কিছু ত্রাণ বিতরণ করেন। এর আগে তারা জেলা শহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সভায়  দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়। তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে ত্রাণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেন।

বাবার বুকে মেয়ের জড়িয়ে ধরা লাশ : মঙ্গলবার সকালে রাঙ্গুনিয়ার হোছনাবাদ ইউনিয়নের কানুরখীল গ্রামে ডুবো সড়ক পার হতে গিয়ে একই গ্রামের আশিষ কুমার মজুমদার, তার স্ত্রী অঞ্জনা মজুমদার (৩০), মেয়ে শ্রেয়া মজুমদার (১১) ও একই গ্রামের ডা. দিলীপ কান্তি দে (৪৭) ও ইয়াসমিন আকতার (১৫) পানির ঢলে তলিয়ে যায়। বুধবার সকালে কানুরখীল ব্রিজের পাশে আশিষ মজুমদার ও তার কন্যা শ্রেয়ার লাশ বুকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় পাওয়া যায়। লাশ হওয়া বাবার বুকে মেয়ের লাশের দৃশ্য দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন উদ্ধারকারীরা। একই এলাকার একটি বিলের দু’পাশ থেকে ডা. দিলীপ কান্তি দে ও ইয়াসমিন আকতারের লাশ উদ্ধার করা হয়।

চট্টগ্রাম : জেলা  প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য অনুযায়ী, পাহাড় ধসে এবং পাহাড়ি ঢলে নদীতে ভেসে গিয়ে চট্টগ্রামে ২৮ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া টর্নেডোতে দেয়াল ও গাছচাপা পড়ে, নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে এবং পাহাড়ি ঢলে নদীতে ভেসে গিয়ে আরও ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে মাথাপিছু ২০ হাজার টাকা ও ৩০ কেজি চাল এবং আহতদের পরিবারকে নগদ ৫ হাজার টাকা আর্থিক সাহায্য দেয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের হাইওয়ে পুলিশ জানায়, মহাসড়কের সাতকানিয়া উপজেলার কেরানীহাটের পূর্বপাশে নতুন ব্রিজ এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাতে পানি নেমে গেলে চলাচল আবার স্বাভাবিক হয়।

হাইওয়ে পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ জানান, চন্দনাইশের পানি সরে গেছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক পুরোপুরি স্বাভাবিক আছে। রাউজানেও পানি সরে গেছে। তবে সমস্যা আছে রাঙ্গামাটিতে। সেজন্য এই মহাসড়কটি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।

কক্সবাজার ও টেকনাফ : বুধবার রাত আড়াইটার দিকে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পশ্চিম সাতঘরিয়াপাড়া পাহাড় ধসে বাবা-মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন আমির হোসেনের ছেলে মো. সেলিম (৪০) ও তার শিশুকন্যা টিপু মনি (৩)। স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিনের মতো পরিবারের সবাই ঘুমিয়েছিল। সেলিম মেয়ে টিসু মনিকে নিয়ে ঘরের বারান্দায় ঘুমায়। সেহরির সময় পরিবারের অন্য সদস্যরা সেলিমকে ডাকতে গিয়ে দেখে বারান্দায় বাপ-মেয়ে মাটিচাপা পড়ে আছে।

হোয়াইক্যং মডেল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, রাতে ভারি বর্ষণ ও বজ পাতে হঠাৎ করে একটি গাছসহ পাহাড়ের অংশবিশেষ ধসে পড়ে। এতে মাটির ঘরের অংশবিশেষে মাটি ও গাছচাপা পড়ে। ওই অংশে সেলিম তার মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়েছিলেন।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক বলেন, কয়েকদিন ধরে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে মাইকিং করা হলেও তারা শুনছে না। নিহত দু’জনের দাফন সম্পন্ন করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৪০ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে।

জিআর চাল ও নগদ অর্থ বরাদ্দ : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (এনডিআরসিসি) জানিয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও চট্টগ্রামের জন্য ৬১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা জিআর ক্যাশ এবং ৮৫১ টন জিআর চাল বরাদ্দ প্রদান করেছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। আহতরা পাবেন ১০ হাজার টাকা করে। প্রত্যেক পরিবারকে ৩০ কেজি করে চাল দেয়া হবে। প্রত্যেক আহত পরিবারকে ৫ হাজার টাকা করে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এসব জেলার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে মোট ৬ হাজার লোক আশ্রয় নিয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করা হচ্ছে।

‘ভূমিকম্প আসছে’ গুজব : ‘ভূমিকম্প আসছে’ বলে চট্টগ্রামে রাতভর গুজব ছড়িয়েছে একটি পক্ষ। নগরী ও জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রায় এলাকায় মাইকিং করে বলা হয়, রাত একটা থেকে তিনটার মধ্যে ভূমিকম্প হবে, আপনারা ঘর থেকে বের হয়ে যান। রাত দেড়টা পর্যন্ত এভাবে মাইকিং চলতে থাকে। অথচ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়ার মতো তেমন কোনো প্রযুক্তিই এখনও আবিষ্কার হয়নি। গুজবের কারণে রাতভর আতঙ্কে কাটে মানুষের। পাশাপাশি কেউ কেউ মানুষজনকে এমন খবরে আতঙ্কিত না হয়ে ঘরে অবস্থান করার পরামর্শ দিয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন লেখা পোস্ট করেন। পটিয়া থানার ওসি নেয়ামত উল্লাহও ফেসবুকে এ বিষয়ে লিখে জনসাধারণকে গুজবে কান না দিতে অনুরোধ করেন।

বাবুগঞ্জ (বরিশাল) : রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসে নিহতদের মধ্যে তিনজন বরিশালের বাবুগঞ্জের। তারা হলেন- মো. জিয়াউর রহমান খান, তার স্ত্রী কাজল বেগম ও মেয়ে বৃষ্টি (৫)। এ সময় তাদের ছেলে জিহাদ (১০) আহত হয়। তাকে রাঙ্গামাটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়নের পূর্ব রহমতপুর গ্রামে তাদের বাড়ি। এ ঘটনায় তাদের স্বজনদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

Recent Posts

Leave a Comment