বিদ্যালয়, পাঠাগার ও বিদ্যার্থীর মুক্তি

 In খোলা কলাম

গোলাম ফারুক
০২ জুলাই ২০১৭, ০১:৩১
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রাচীন ভারতে বিদ্যাশিক্ষার জন্য বিদ্যার্থীরা গুরুর সঙ্গে তাঁর সংসারের সদস্য হিসেবেই তপোবনে বাস করত। সেই তপোবন ঠিক কেমন ছিল বোঝা মুশকিল, তবে রবীন্দ্রনাথের মতে তা কল্যাণময়, বিলাস-মোহমুক্ত, শান্ত রসে সিক্ত প্রাণবান আনন্দের মূর্তি। রবীন্দ্রনাথ সে রকমই মঙ্গলময়, শান্ত, সাধারণ জীবনের সঙ্গে অপার আনন্দ মেশাতে চেয়েছিলেন তাঁর শান্তিনিকেতনে। তিনি মনে করতেন, শিক্ষাকে দেয়াল দিয়ে ঘিরে, গেট দিয়ে আটকে, দারোয়ানের পাহারা বসিয়ে, শাস্তির ভয় দেখিয়ে, কিংবা তাড়া করে ধরা যায় না। শিক্ষার পতিত জমি শুধু নিয়মের ধারালো ফলায় চাষ করলে হয় না, উর্বর করে তোলার জন্য তাকে শান্তরসে সিক্ত করাও আবশ্যক। রবীন্দ্রনাথের মতে, এই শান্তরস পরিপূর্ণতার রস। সাতটা বর্ণরশ্মি মিলে গেলে যেমন সাদা রং পাওয়া যায়, তেমনি চিত্তের নানান প্রবাহ মিলে প্রকৃতির সঙ্গে ঐকতান তৈরি হলেই শান্তরসের উদ্ভব হয়।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আসল শিক্ষা হচ্ছে এই তপোবনীয় বিদ্যাশিক্ষা, যা শহরের কোলাহলে সম্ভব নয়। তাঁর মতে, শেখার বা বেড়ে ওঠার সময় প্রকৃতির সহায়তা চাই-ই চাই।

তাই যদি হয় তাহলে জনবহুল বাংলাদেশের শহরগুলোতে ছেলেমেয়েরা কী শিক্ষা পাচ্ছে? রবীন্দ্রনাথ যে শহর দেখেছেন, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি জনবহুল, জটিল, কঠিন, অনিশ্চিত, কৃত্রিম আজকের নাগরিক ও পারিবারিক জীবন, যা দ্রুতই দিশা হারাচ্ছে। ফলে রবীন্দ্রনাথের তাত্ত্বিক চোখ দিয়ে দেখলে বাংলাদেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষাদানের উপযোগী নয়। যতই সমালোচনা থাকুক, তুলনামূলকভাবে অনেক কম হলেও এখনো আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কিছু মেধাবী ছেলেমেয়ে বেরোচ্ছে।

বর্তমানে পৃথিবীর সব দেশেই কিছু না কিছু অস্থিরতা আছে, আছে নগরায়ণের ফলে প্রকৃতি থেকে দূরে সরে আসার প্রবণতা। অস্থিরতা ও নগরায়ণের হার যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি, বাংলাদেশ সেই দেশগুলোর একটি। আমরা দ্রুত গতিতে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে উঠে এসেছি, এখন আরও দ্রুত গতিতে মধ্যম আয়ের দেশের দিকে ধাবিত হচ্ছি। ফলে কোথাও পরিকল্পিত, কোথাও অপরিকল্পিতভাবে গজিয়ে উঠছে দালানকোঠা, ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন রাস্তাঘাট। নতুন পয়সায় কেনা অজস্র গাড়ি রাস্তায় নেমে মানুষের চলাচল অসহনীয় করে তুলছে। পুরোনো পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক ভেঙে পড়ছে।

এ রকম অস্থির ও অনিশ্চিত পরিবেশে রবীন্দ্রনাথ যে শিক্ষার কথা বলেছেন, সৃষ্টিশীল বা সত্যিকার মানুষ হয়ে ওঠার, সেই শিক্ষা দেওয়া বা নেওয়া সত্যিই কঠিন। কংক্রিটের জঙ্গলে বাস করে অস্বাভাবিক গতিতে উদ্‌ভ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে রবীন্দ্রনাথের সেই ‘বিলাস-মোহমুক্ত প্রাণবান আনন্দ’, ‘সত্য’, ‘সুন্দর’ বা ‘কল্যাণ’ ধারণ করা তো প্রায় অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথ যে শহরকে বিদ্যাশিক্ষার জন্য বৈরী বলে মনে করতেন, সেই শহর এখনকার বড় বড় নগরের তুলনায় গ্রাম না হলেও মফস্বল তো বটেই।

আমাদের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য শান্তিনিকেতনীয় তপোবন তৈরি করা সম্ভব নয়। কিন্তু তার বিকল্প ইরেসমাসের স্বর্গ রচনা সম্ভব। মানবতাবাদী তাত্ত্বিক ইরেসমাসের মতে একটি ভালো পাঠাগারই হয়ে উঠতে পারে মর্ত্যলোকের স্বর্গ। তা-ই যদি সত্যি হয়, তো প্রাচীন ভারতের সেই তপোবন নয়, পাঠাগারেই রবীন্দ্রনাথের সেই ‘বিলাস-মোহমুক্ত প্রাণবান আনন্দ’, ‘সত্য’, ‘সুন্দর’ বা ‘কল্যাণ’-এর সাক্ষাৎ পাওয়া যেতে পারে। তবে ইরেসমাসের পাঠাগার নিশ্চয়ই ধুলোর আস্তরে ঢাকা, পোকায় কাটা বইয়ের শেলফে ভর্তি দমবন্ধ করা অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘুপচি ঘর নয়। সেটাকে অবশ্যই উজ্জ্বল আলোয় ঝলমলে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ধুলোবালিহীন খোলামেলা প্রশস্ত হলঘর হতে হবে। সেখানে ঢুকে শিক্ষার্থী বুঝবে, তার পাঠ্যবইয়ের ছোট্ট গণ্ডির বাইরেও এক বিশাল বিচিত্র জগৎ তার জন্য অপেক্ষা করছে। রবীন্দ্রনাথের সেই মুক্ত বাতাস, খোলা আকাশ বা উদার প্রকৃতি হয়তো এখানে থাকবে না। কিন্তু মুক্ত ভাবনা, খোলা মন বা উদার মানুষের জগৎ তো তৈরি করা সম্ভব।

আমরাও সে রকম পাঠাগার তৈরি করতে পারি। প্রয়োজন শুধু হাতের কাছে যা যা আছে, তা গুছিয়ে নিয়ে পাঠাগারের গুরুত্ব উপলব্ধি করে সেটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। সরকার এখন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক বড় বড় দালানকোঠা বানিয়ে দিচ্ছে, উপহার দিচ্ছে প্রয়োজনীয় উপাদানে সুসজ্জিত আইটি ল্যাব। অন্য দিকে লাইব্রেরিগুলো পাচ্ছে ব্র্যাক এবং বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের দেওয়া নতুন নতুন বই। এই সবকিছুর সঙ্গে সুপরিকল্পিতভাবে আর কিছু অর্থ বিনিয়োগ করলে তপোবনের সেই শান্তরসে সিঞ্চিত এক ভার্চু্যয়াল পরিবেশ তৈরি করা অসম্ভব হবে না।

ইদানীং একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে পাঠাগারের আর প্রয়োজন নেই। কিছু পড়তে ইচ্ছা করলে সেটা ডাউনলোড করে কোথাও বসে পড়ে নিলেই তো হয়। পাঠাগার মানে যদি কেবল বই ধার করে সেখানে কোনোরকমে বসে তা পড়ে ফেলার জায়গা হয়, তাহলে সত্যিই পাঠাগারের প্রয়োজন নেই। কিন্তু পাঠাগার মানে যদি বিশাল উদার প্রকৃতির ভার্চ্যুয়াল জগতের প্রবেশমুখ হয়, তাহলে খেলার মাঠে ছুটে বেড়ানোর সুযোগবঞ্চিত ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে আর কিছু না হোক অন্তত এই বিরাট পৃথিবীর একটা পরিচয় তো ঘটবে। পাঠাগার যদি গাছপালা, ফুল-ফল বা পশুপাখির সঙ্গে আত্মীয়তা তৈরির সূতিকাগার হয়, তাহলে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, দাদা-দাদি ছাড়া প্রায় একা গৃহকোণে কুনো ব্যাঙের মতো যে ছেলে বা মেয়েটি বড় হচ্ছে, সে বুঝবে যে এই পৃথিবীকে যতটা নির্লিপ্ত, নির্জীব বা বন্ধুহীন মনে হয়, সেটা ঠিক ততটা নয়। পাঠাগার মানে যদি শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে প্রাণবন্ত মতবিনিময়ের সুযোগ হয়, তাহলে ক্রমেই নিজের বলয়ের মধ্যে ঢুকতে থাকা আমাদের অন্তর্মুখী শিক্ষার্থীরা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে দ্রুত বিবর্তমান আত্মধ্বংসী পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করার বোধ ও ক্ষমতা অর্জন করবে।

এটা করা গেলে ছেলেমেয়েরা শুধু পরীক্ষার্থী না হয়ে শিক্ষার্থী হয়ে উঠবে। কেবল নিজের না হয়ে সবার হবে। ধীরে ধীরে অবাসযোগ্য হয়ে উঠতে থাকা আমাদের এই জন্মভূমিকে একদিন বিলাস-মোহমুক্ত প্রাণবান আনন্দের প্রতিমূর্তিতে পরিণত করবে।

গোলাম ফারুক: লেখক, ফলিত ভাষাতত্ত্ববিদ, গবেষক  শিক্ষক

Recent Posts

Leave a Comment