সেক্যুলার সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে কিছু কথা, কিছু প্রশ্ন || আহমদ রফিক

 In খোলা কলাম

সম্প্রতি বাংলাদেশে রাজনৈতিক শক্তির কিছু আচরণ সমাজের সেক্যুলার ও মুক্তচিন্তাবাদী মানুষের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে হোক, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে হোক- দেশের বৃহত্তম জনতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের শাসন ব্যবস্থার পক্ষে শরিয়া-সুন্নাভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার প্রবক্তা কওমী মাদ্রাসার হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আঁতাত-সমঝোতা আধুনিক, প্রগতিবাদী সমাজের পক্ষে নিঃসন্দেহে অশনি সংকেত।

রাজধানীতে এটাই কিছুদিন থেকে বহু-আলোচিত বিষয় এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার যে সুবিধার কথা ভেবে এ পদক্ষেপ নিয়ে থাকুন না কেন প্রথমত তাতে সুবিধা কতটা হবে, আদৌ হবে কিনা- নিঃসন্দেহে বড় একটি প্রশ্ন। কিন্তু প্রশ্নটিকে আমল দিতে চাইছেন না সরকার। দলীয় স্বার্থের বিবেচনায় তাদের ও আরো অনেকের ঘোষিত রাজনৈতিক আদর্শ বিসর্জন দেবার পথ ধরেছেন সরকার। তাদের যুক্তি অসার। ভাস্কর্য বিষয়টিও একই ধারার।

আমাদের বিবেচনায় এটা আত্মঘাতী পদক্ষেপ, যেমন সরকার ও দলের পক্ষে তেমনি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিবাদী রাজনীতি ও সংস্কৃতির জন্যে। তা সরকার এবং তার দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভুবনের সমর্থকরা যাই ভাবুন না কেন। এটা দিবা স্বপ্ন যে, তাদের স্বার্থের বাইরে জামায়াতসহ ইসলামপন্থীরা, বিশেষ করে কট্টর শরিয়াপন্থীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহনকারী রাজনৈতিক দলকে সমর্থন জানাবে, নির্বাচনে ভোট দেবে।

তাদের ভোট পেতে হলে আওয়ামী লীগ সরকারকে হেফাজত ইসলামি সরকারে পরিণত হতে হবে, দেশ শাসন করতে হবে শরিয়া ও সুন্নার আদর্শে, যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা তারা হরহামেশা বলে থাকেন ও প্রচার করেন সেই চেতনাকে বুড়িগঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিতে হবে। অবশ্য হেফাজতের সঙ্গে সরকারের একান্ত চুক্তির শর্তাদি আমাদের জানা নেই, যা একেবারেই দ্বিপক্ষীয়।

তবু একথা তো সত্য যে, ওদের সমর্থন পেতে হলে আওয়ামী লীগ ও তার সরকারকে দীর্ঘকাল ধরে অনুসৃত তাদের আদর্শিক ঘোষণাপত্র ও অঙ্গীকারাদি বিসর্জন দিতে হবে। ইতিমধ্যে তার কিছু আলামত প্রকাশ পেয়েছে পাঠ্যপুস্তকে অবাঞ্ছিত পরিবর্তনে। যে পরিবর্তন অনাধুনিক, ধর্মীয় রক্ষণশীলতার প্রতীক এবং যা গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শের বিরোধী। ছোটযুদ্ধে জয়ের নেশায় সরকার ও তার দল কি তাদের দীর্ঘকালীন আদর্শ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত?

এর আপাত কু-প্রভাব এই মুহূর্তে ততটা প্রকাশ না পেলেও সমাজে, রাজনীতিতে এর অবশেষ প্রভাব সেকরলার ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন আদর্শের বিপরীত হতে বাধ্য। কয়েক দশকব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারায় অর্জিত রাজনৈতিক সুফল এভাবে ভাসিয়ে দেওয়া কতটা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক তা ভেবে দেখার মতো।

অবাক হবার মতো ঘটনা, লেখক-শিল্পী ও সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী মহলের যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি কিছুদিন আগেও সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, কঠোর ভাষায় প্রতিবাদী বক্তব্য প্রচার করেছেন তাদের কেউ কেউ সরকারের আদর্শিক পিছু হঠা পদক্ষেপের সমর্থক হয়ে উঠেছেন। এ ভোল পাল্টানোকে সুবিধাবাদ ছাড়া আর কোনো শব্দে চিহ্নিত করা যায় না।

রাজনৈতিক সুবিধাবাদ সাময়িক কিছু সুফল আনলেও প্রথমত তা আদর্শের বিপরীত ধারায়; দ্বিতীয়ত তা স্থায়ী হয় না; তৃতীয়ত তা গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদী সমাজ ও রাজনীতির শিকড় কেটে দলীয় সুবিধার পথ তৈরি করে। রাজনৈতিক স্বার্থপরতা এমনই এক ভয়ংকর মূল্যবোধ যা সত্য বিচারে অন্ধ। বাংলাদেশের কথিত আধুনিক, উন্নয়নবাদী ও গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী সরকার ও তার দল সম্প্রতি পূর্বোক্ত পথের দিশারী। সেক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আদর্শগত বিচারে তাদের পার্থক্য কতটুকু তা বিচার্য বিষয়।

দুই

এ অবিশ্বাস্য বিপরীত পথ-ধরা, ধর্মীয় রক্ষণশীলতাকে নানা মাত্রায় প্রশ্রয় দেওয়া কি তাৎক্ষণিক স্বার্থবিচারের কারণে, নাকি এটা ঐতিহাসিক সম্প্রদায়বাদী অতীত রাজনীতির উত্তরাধিকার বহনের তাৎক্ষণিক প্রকাশ? বর্তমানে নব্বই শতাংশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের মুসলমান সম্প্রদায় একদা তার আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ঘুচাতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছিল। জিন্নাহ-প্রভাবিত মুসলিম লীগের দ্বিজাতি-তত্ত্বের ধ্যানধারণায় আত্মসমর্পণ করে দেশবিভাগ ও স্বতন্ত্র ভুবন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করেছিল।

গোটা প্রক্রিয়াটিই ছিল সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতাভিত্তিক। এতে যেমন ছিল কংগ্রেস-লীগের রাজনৈতিক স্বার্থপরতার দ্বন্দ্ব, তেমনি ছিল নেপথ্যের বিদেশি শাসকশ্রেণীর চতুর নীতির চক্রান্ত- হিন্দু মুসলমান এ দুই সম্প্রদায়কে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত করা। যেমন পর্যায়ক্রমে দুই সম্প্রদায়কে সুবিধাদান ও সুবিধা হরণে তেমনি বিশেষভাবে স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রচলনে। শেষ পেরেকটি পোতা হয় ১৯৩৫ সালে ভারত শাসনের ক্ষেত্রে ‘সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ’ (কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড) প্রচলনের মাধ্যমে এবং দুই সম্প্রদায়কে পরস্পর-বিরোধিতায় লড়িয়ে দেবার শাসনতান্ত্রিক চাতুর্যে।

পরিণামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তাক্ত পথ মাড়িয়ে দেশভাগের মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা কায়েমের পরস্পর বৈরিতার ভবিষ্যত পথ ধরে। সে ট্র্যাডিশন এখনো অব্যাহত। রাজনৈতিক প্রচারণায় এভাবে দূষিত সমাজ তার সুস্থ, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চরিত্র পুরোপুরি আর অর্জন করতে পারে নি। পূর্ববঙ্গে তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরবর্তী সময়ে যে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক উদ্ভাস- তা ছিল স্বশাসন ও স্বাধিকারের তাগিদে। সেখানে ছিল তরুণ সমাজের প্রতিবাদী চিন্তা ও প্রগতিবাদী মতাদর্শের প্রভাব। সমাজ তাৎক্ষণিকভাবে তাদের অনুসরণ করেছে।

পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তান তার আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থের টানে লড়াইয়ের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত। এখন প্রশ্ন থাকে, তখন সমাজে আদর্শগত পরিবর্তন কতটা ঘটেছিল, আদৌ ঘটেছিল কিনা? আর রাজনীতির আপাত আদর্শবাদ কতটা শুদ্ধ ছিল, তাতে খাদই বা কতটা ছিল?

একাত্তরের স্বাধীনতার লড়াই যে কোনো বৈপ্লবিক মতাদর্শে, সমাজ বদলের তাড়নায় পরিচালিত হয় নি, হয়েছিল শ্রেণী বিশেষের স্বার্থ উদ্ধারে, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ ছিল না, এখনো নেই। অবশ্য ঘোষণায় ছিল সর্বজনীন স্বার্থের বাংলাদেশের কথা। বহুমতামতের অনৈক্যের প্রকাশ ছিল রণাঙ্গনের কমান্ডারদের মধ্যে। গণবাহিনী গঠন চিন্তার প্রবক্তা তাহেরের সঙ্গে জিয়ার আদর্শগত ফারাক ছিল মেরু প্রমাণ। একই কথা খাটে তাহের বনাম জলিলের সম্বন্ধে। খাটে খালেদের সঙ্গে মঞ্জুর বা অন্যদের আদর্শিক ভাবনার পার্থক্যে। কিংবা মীর শওকত আলীর সঙ্গে কাজী নুরুজ্জামান বা সমাজবদলের অন্য প্রবক্তাদের আদর্শিক ভাবনার পার্থক্যে। সর্বোপরি সেনাপতি ওসমানির সঙ্গে সবারই ছিল মত পার্থক্য। তিনি কতটা সেক্যুলার ছিলেন সেটাও প্রশ্ন।

আর এ যুদ্ধের রাজনৈতিক পরিচালক আওয়ামী লীগের সঙ্গে যেমন ছিল ছোট শরিকদের আদর্শিক পার্থক্য, তেমনি খোদ আওয়ামী লীগের অভ্যান্তরেও ছিল গভীর মতভেদ। সে মতভেদ যেমন তাজউদ্দিন বনাম মোশতাক আহমদ তেমনি তাজউদ্দিন বনাম ফজলুল হক মনি পরিচালিত মুজিব বাহিনীর এবং তা ছিল যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ চরিত্রের। আবার মুজিব বাহিনীর চার পরিচালকের মধ্যেও ছিল রাজনৈতিক ভিন্নমত।

এককথায় যুদ্ধে বা রাজনৈতিক মতাদর্শে, সেনানায়কদের ব্যক্তিগত চিন্তা ও মতাদর্শে অনৈক্য ও ভিন্নমতই ছিল প্রধান, কখনো তা গভীর তাৎপর্যবহ যেমন স্বাদেশিকতার বিচারে, তেমনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিবেচনায়। রুশ-ভারত বনাম যুক্তরাষ্ট্র-চীন এতে ভিন্নমাত্রায় প্রভাব রেখেছে। তবে এতে স্বদেশী মতভেদ সর্বাধিক প্রভাব রেখেছে ভবিষ্যত পরিণামের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে শ্রেণীস্বার্থের রাজনীতি কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বহুমাত্রিক দ্বন্দ্ব একে সুস্থ ও জনবান্ধব সর্বজনীন রাজনীতির পথে পরিচালিত করতে পারেনি।

এই না পারার অন্যতম প্রধান কারণও বাহাত্তরে ক্ষমতায় আসীন শাসক শ্রেণীর কিছুটা হলেও অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব, তাজউদ্দিন বনাম শেখ মনি ও শেখ মুজিবুর রহমান, বিশেষ করে শাসকগোষ্ঠীর শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গি।

তারচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, ঘোষিত আদর্শ ও বাস্তবায়নে ফারাক। বিজয়ী নেতা, পাতি নেতাদের অনেকের মধ্যে, বিশেষ করে দ্বিতীয় তৃতীয় স্তরে ছিল সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিত্ত-সম্পদ জবরদখলের মানসিকতা। এটা বিশেষভাবে প্রকট হয়ে ওঠে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে।

তিন

বাহাত্তর থেকে মধ্য পঁচাত্তর পর্যন্ত সময় পরিসরে জনবন্ধিত নেতার ব্যক্তিত্ব প্রভাবে সম্প্রদায়বাদী তৎপরতার বিষয়টি কিছুটা ধামাচাপা পড়লেও তার অবর্তমানে ভিন্ন মতদর্শের প্রভাবে তা যেমন তত্ত্বগতভাবে তেমনি রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতায় প্রকাশ পেতে থাকে। শুরুটা সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। তিনি সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার শিকড়ে কুঠার চালিয়ে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবাদের পত্তন করেন ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ নামে। একই আদর্শে গঠিত হলো বিএনপি নামের রাজনৈতিক দল।

এ দল জনপ্রিয়তাও পেল সমাজে সম্প্রদায়বাদী চেতনা এবং জিয়ার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার কারণে। বিভ্রান্ত একদল বামপন্থী (চীনপন্থী) তার সমর্থনে এগিয়ে গেল। অন্তর্কলহ, বিশিষ্টজনের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ও দ্বন্দ্ব এবং হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদের চতুর খেলায় জিয়াশাসনের অবসান এবং এরশাদের সংবিধানে ‘রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম’ সংযোজন। সমাজে তাতে ধর্মীয় প্রভাব বেড়েছে। এবং অমুসলমান জনগোষ্ঠীর অবস্থান পিছু হটেছে।

এরশাদের প্রায় দশকব্যাপী শাসন পাকিস্তানি শাসক আইউবের মতোই সমাজকে পিছে ঠেলেছে। উচ্চ শিক্ষিত শ্রেণীতেও ধর্মীয় প্রভুত্ববাদের বাড়বাড়ন্ত ঘটেছে। নারী স্বাধিকার চেতনা এবং সামাজিক অধিকার ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতার চাপে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। মুক্তচিন্তা ঢাকা পড়েছে ভারি আবরণের আড়ালে। সামাজিক ফতোয়া, বাল্য বিবাহ ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতার চাপে নারীর সামাজিক অধিকার ব্যাহত হয়েছে। সবকিছু বিচারে এক ধরনের অধপতিত সময়ের সূচনা ঘটে।

দুই প্রধান দল দ্বারা শাসিত বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক-সাম্প্রদায়িকতার সূচকেও বাড়বাড়ন্ত ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে। এদিক থেকে দুই দল মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হিসাবে বিবেচ্য। তাই শাসনযন্ত্রের দাপটের মধ্যেই সাম্প্রদায়িকতার ছোট-বড় ঘটনা সামাজিক বাস্তবতার রূপ ধারণ করেছে। যা পাকিস্তান আমলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

বড় ঘটনার উদাহরণ রামু, উখিয়া প্রভৃতি অঞ্চলের মূলত বৌদ্ধ, সেই সঙ্গে হিন্দু পল্লীতেও হামলা, বৌদ্ধমূর্তি ও বিহার ভাঙচুর, ভাঙচুর মন্দিরেও। এ সম্বন্ধে শাসনযন্ত্রকে খুব একটা তৎপর হতে দেখা যায় নি। এতে সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাসীন দলসহ জামায়াতের স্থানীয় নেতারা; তাদের কারো শাস্তি হয়েছে বলে জানা যায় না।

এ ঘটনা তৎকালীন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের একটি উক্তিই অবস্থার মূল্যায়নের পক্ষে যথেষ্ট। তিনি বলেছেন: ‘খবরের কাগজে যে ভাঙা মূর্তি দেখেছি, তা আসলে বুদ্ধের মূর্তি নয়, তা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের রক্তাক্ত প্রতিচ্ছবি, যা আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যে কালিমা লেপন করেছে। ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত, গোয়েন্দা সংস্থা সব জানে।’

এ অভিযোগ সত্য হলে বলতে হয়, দেশে সাম্প্রদায়িক ঘটনার পেছনে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের মদত রয়েছে, রয়েছে শর্ষের মধ্যে ভূত। তাহলে এ রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাষ্ট্রকে কি সেক্যুলার তথা অসাম্প্রদায়িক বলা যায়? কথিত গণতন্ত্রী শাসনেও যখন এ জাতীয় ঘটনা ঘটে তখন রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। এটা স্পষ্টতই সুশাসনের অভাব। সাম্প্রদায়িক চেতনার প্রভাব।

তা না হলে এই তো কিছুদিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নাসিরনগরে সংখ্যালঘু পল্লীতে অনুরূপ ঘটনা কীভাবে ঘটে, যেখানে কোনো উপলক্ষ নেই, যেসব উপলক্ষ এক সময় অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে তৈরি করা হতো। এখন সাম্প্রদায়িকতার সামাজিক রাজনৈতিক প্রকাশ এতটা নগ্ন যে কথিত উপলক্ষেরও প্রয়োজন পড়ে না সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালাতে।

উপলক্ষ নেই, তবে লক্ষ্য আছে। আর তা হলো সংখ্যালঘুর জমিজমা বা বাড়ি-ঘর বা সম্পত্তি দখল। নাসিরনগরের ঘটনায় তো প্রকাশ পেয়েছে ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব, আর ঘটনার সঙ্গে জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা (ইউএনও) ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশের সংশ্লিষ্টতা ও তৎপরতা। তাই সমাজ বিরোধীদের দুর্বৃত্তপনা বিনা বাধায় দিন কয় ধরে চলেছে। আমরা জানতে চাই তাদের বিচার ও শাস্তি হয়েছে কিনা।

প্রায় অনুরূপ ঘটনা একই সময়ে গোবিন্দগঞ্জের সাওতাল পল্লীতে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক হামলা। এর  প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এর সঙ্গে চিনির কল মালিকদের সংশ্লিষ্টতা ঘটনাকে জটিল করেছে এবং ঘটনার পেছনে যুক্তি উপস্থাপনের চেষ্টা চলেছে। দিনের পর দিন বিপুল সংখ্যক বাস্তুচ্যুত সাঁওতাল পরিবার খোলা আকাশের নিচে অসহায়, দুস্থ জীবনযাপন করেছে। দু’একটি সেবামূলক সংস্থা বাদে কেউ, বিশেষ করে সরকার পক্ষ তাদের সাহায্যে বড় একটা এগিয়ে আসেনি। পুলিশ বরং প্রতিবাদের কারণে তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।

এত বড় একটি ঘটনার নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত, সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি, অপরাধীদের চিহ্নিত করা, বিচারের আওতায় এনে শাস্তিবিধান নিশ্চিত করা হয়েছে বলে জানা যায় না। তাদের ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসনও যথাযথভাবে ঘটেছে বলে মনে হয় না। বিষয়টি ঝুলন্ত অবস্থায়, যা এসব ক্ষেত্রে বরাবর ঘটে থাকে।

চার

এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সেক্যুলার চরিত্রবিষয়ক গর্ব ও অহংকারের জায়গাটি কি অক্ষত আছে বলে দাবি করা যায়? যায় না। যেমন যায় না ভারতেরও সেক্যুলার রাষ্ট্রিক চরিত্রের দাবি। যায় না বিশেষ করে যখন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠজন ভোটে হিন্দুত্ববাদী সরকার সেখানে ক্ষমতাসীন হয়, আর গুজরাট কলঙ্কের নায়ক প্রধানমন্ত্রী পদে অভিষিক্ত হয়। এবং এরপর ঘটে একাধিক সম্প্রদায়বাদী ন্যাক্করজনক ঘটনা। এই হলো অশোক ও আকবরের সেক্যুলার ভারতবর্ষের অবশেষ পরিণতি, অত্যাধুনিক যুগে এসে।

দুর্ভাগ্য বঙ্গের ও বাংলাদেশের যে, এরাও এ কলঙ্কের অংশীদার। তাই এ দুর্নাম ঘুঁচাতে চাইলে একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্মিলিত পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে। কথাটা তাত্ত্বিক। বাস্তবে তা ঘটতে পারে গণতান্ত্রিক, প্রকৃত সেক্যুলার সুশাসনে। কথার সুন্দর ফুলঝুরিতে নয়। সামাজিক-রাজনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই এক্ষেত্রে। বাংলাদেশ এমন ধারায় কতটা এগিয়ে যেতে পারবে- আদৌ পারবে কিনা সেটাই আমাদের প্রশ্ন এবং দেখার বিষয়।

এতো গেল তাৎক্ষণিক, রাষ্ট্রিক দায়িত্ব পালন ও দায়বোধের বিষয়। কিন্তু সমাজ থেকে সাম্প্রদায়িকতার দূষণ এবং ব্যক্তিক মানসিক সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে হলে যে ব্যবস্থা নিতে হবে তা যেমন সময় সাপেক্ষ তেমনি শ্রমসাপেক্ষ। সেখানে সদিচ্ছার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে থাকবে শুধু কথা নয়, কাজ।

সে কাজের সূচনা ঘটাতে হবে পরিবারে। শিশুকে ধর্মীয় চেতনার প্রাধান্যে নয়, মানবিক ও সেক্যুলার মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হবে। এ পাঠ গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে শিশুর কঁচি মস্তিষ্ককোষে যে প্রাথমিক বোধের ছাপ পড়ে তা সহজে নষ্ট হয় না, তা গভীর হয়ে সজীব থাকে। এ ধারাবাহিকতায় রয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সেক্যুলার চেতনার পাঠ- এটাও শৈশব ও বাল্য বয়সের শিক্ষার পাট বা চেতনায় গভীর দাগ কাটে।

সমস্যা হলো, এক্ষেত্রে রয়েছে বড় ঘাটতি যেমন পাঠ্য বিষয়ে তেমনি পাঠদানে এবং শিক্ষকের জ্ঞান, বোধ ও মানসিকতায়। এ ঘাটতি পূরণের সমস্যাটি পুরোপুরি সামাজিক চরিত্রের। তাই বলতে হয়, উত্তম শিক্ষার্থী পেতে যেমন উত্তম শিক্ষকের প্রয়োজন অপরিহার্য, তেমনি প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সেক্যুলার মানস গঠনে দরকার সেক্যুলার চরিত্রের শিক্ষক। সেখানে ঘাটতি লক্ষণীয় মাত্রায়।

যে সমাজ এখনো পুরোপুরি গণতন্ত্রী ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে গড়ে উঠতে পারেনি, সে সমাজ কীভাবে যথেষ্ট সংখ্যক সেক্যুলার শিক্ষিত মন ও সেক্যুলার শিক্ষকের জন্ম দেবে? প্রকৃতপক্ষে তা দিচ্ছে না। সেখানে নজর নেই শিক্ষা ব্যবস্থার। নজর নেই রাষ্ট্রযন্ত্রের। এ সমস্যা দূর হবে কীভাবে? প্রকৃতপক্ষে তা দূর করতে পারে আদর্শিক রাজনীতি, তেমন ধারার সুশাসন। দলীয় স্বার্থ, রাজনৈতিক স্বার্থ, প্রভাবিত শাসন ব্যবস্থার পক্ষে এ অর্জন সম্ভব নয়। তাই উল্লিখিত দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থাটি রীতিমত সংকটজনক অবস্থায়। তাই সেক্যুলার সমাজ, সেক্যুলার শাসন ব্যবস্থার ঘাটতির কারণে সেক্যুলার রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করেছে বাংলাদেশে। সচেতন চেষ্টাতে এর পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। সে পরিবর্তন কি আদৌ ঘটবে?

লেখক: প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র গবেষক

Recent Posts

Leave a Comment