ভারত-চীন যুদ্ধ: বাংলাদেশের ভূমিকা কী হবে?

 In দেশের ভেতর, প্রধান খবর

আর্ন্তজাতিক ডেস্ক:

বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক রজনীতিতে ভারত-চীন যুদ্ধ উত্তেজনা সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। ভারত, ভুটান ও চীনের সীমানা যেখানে মিশেছে, সেই স্থানটির নাম ডোকালাম। সংকীর্ণ পাহাড়ি এ উপত্যকাটি প্রকৃতপক্ষে একটি করিডোর। যার নিয়ন্ত্রন নিয়েই এত উত্তেজনা, সমর সজ্জা, কূটনৈতিক দৌড়ঝাপ!

যতই দিন যাচ্ছে চীন একটু একটু সুর চড়াচ্ছে। আর তত জোড়ালো হচ্ছে ভারত-চীন যুদ্ধের আশঙ্কা। ভারত যেন চীনাদের বিরুদ্ধে ১৯৬২ সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে চীনও সে যুদ্ধে ভারতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা ভারতকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। তবে দেশ দুটি সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে কেউই চূড়ান্ত বিজয় লাভ করবে না বলে সতর্ক করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা। যদিও বিশ্লেষকেরা এটাও বলছেন যে চীন-ভারত যুদ্ধ হলে তা শুধু ওই দেশটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এত জড়িয়ে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান।

তবে যুদ্ধ যদি বাস্তবেই শুরু হয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের ভূমিকা কেমন হবে, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। ভারতের সাথে রাজনৈতিকভাবে এবং চীনের সাথে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের বেশ শক্ত অবস্থান আছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধ লেগে গেলে দু’দেশের কাছ থেকেই কূটনৈতিকভাবে সমদূরত্ব বজায় রাখাটাই হবে বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক।
দোকলাম

ভারত ও চীন উভয়ই প্রতিবেশী এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। একক ভাবে চীনের হাতেই রয়েছে বিশ্ব বাণ্যিজের ২০ শতাংশের নিয়ন্ত্রন। ভারতের অবস্থানও বেশ শক্ত। ফলে এ দুই দেশের বিরোধ যুদ্ধে রূপান্তির হলে তা শুধু এশিয়ার দেশগুলোর জন্যই নয় বিশ্ব অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

কোথায় সংঘাতের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি?
ডোকালাম যুদ্ধের প্রধান সূতিকাগার হলেও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের ধারণা দুই দেশের যুদ্ধের প্রধান ময়দান হবে অরুনাচল। লাদাখে চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধ থাকলেও সেখানে চীন নতুন করে কোন এলাকা দখলের চেষ্টা থেকে বিরত থাকবে। বরং চীনের অন্যতম লক্ষ্য থাকবে ভারতের অরুনাচল বলে পরিচিত এলাকাটি চীন যাকে দক্ষিণ তিব্বত হিসেবে আখ্যায়িত করে ওই এলাকাটির দখল নেওয়া।

কিন্তু চীন কেন অরুনাচল দখল নিতে চেষ্টা করবে এমন প্রশ্নের জবাবে উত্তর-পূর্ব ভারত নিয়ে কাজ করা ভারতীয় সাংবাদিক রূপম বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি করেন, ‘অরুণাচলে মাটির নীচে ইউরেনিয়ামের বিরাট সম্ভার রয়েছে বলে শোনা যায়। ভূপ্রকৃতি এতই দুর্গম যে সেই ইউরেনিয়াম তুলে আনা বেশ খরচ সাপেক্ষ। তবে সেই খরচ করার সামর্থ ভারতের এখন যথেষ্টই রয়েছে। চীনও তা জানে। তাই বেইজিং অরুণাচল নিয়ে খুব চিন্তিত। ভারতের হাতে ইউরেনিয়ামের বিশাল সম্ভার থাকার অর্থ হল ভারতের পরমাণু প্রকল্পগুলির রমরমা। তা আটকাতেই অরুণাচলকে নিজেদের দখলে নিতে চায় বেইজিং।’

এদিকে অপর একটি আশঙ্কার খবর হলো ভারত সম্ভাব্য যুদ্ধ ক্ষেত্র হিসেবে শিলিগুড়িকেও বেছে নিয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিক খবরে জানা যাচ্ছে, ভারত শিলিগুড়িতে আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম সহ অতিরিক্ত দুই ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করেছে । ভারত যদি শিলিগুড়ির চীন সীমান্তে আক্রমণ করে তবে চীনও পাল্টা আক্রমণ করবে। শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশ কাছাকাছি দূরত্ব হওয়া বাংলাদেশের জন্যও আশঙ্কার।

বাংলাদেশ-ভারত-চীন সম্পর্কের বর্তমান গতি-প্রকৃতি
১৯৭১ সালের পর থেকে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক সরকার পরিবর্তনের সাথে সম্পৃক্ত হলেও বর্তমান সরকারের সাথে সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ট। গত এপ্রিল মাসেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে ভারতের সাথে ২২ টি চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। এর আগে ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফরে এসেও ২২টি চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা এবং ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করে। এসব চুক্তি স্বাক্ষর ও উভয় দেশের কূটনৈতক প্রচেষ্টা দুটি দেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে বলে দাবি করছেন দুটি দেশেরই কূটনৈতিকেরা।

এদিকে গত বছরের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিং পিং বাংলাদেশ সফরে এসে ২৬ টি চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে। একই সাথে বাংলাদেশকে ২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহযোগিতা প্রদানের অঙ্গীকার করেছে। তাছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশে চীনা বিপুল চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। রয়েছে অগণিত প্রকল্পে ঋণ-কারিগরি সহযোগিতা। এছাড়া চীন পরিকল্পিত সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট ও ম্যারিটাইম সিল্ক রোড নির্মাণে বাংলাদেশ চীনের নিকট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার নিয়েও দেশদুটির মধ্যে এক ধরণের স্নায়ু যুদ্ধ চলছে।

দেশটির পত্রিকা গ্লোবাল টাইমস শি জিনপিং-এর বাংলাদেশ সফরকে যুগান্তকারী এবং পিপলস ডেইলি বাংলাদেশ সফর ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলে অভিহিত করে।

এর আগে শি জিনপিং ২০১০ সালে চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। বাংলাদেশের সাথে দেশটির সম্পর্ক উন্নয়নের আগ্রহ তখন থেকেই।

এছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে নয়াদিল্লি এবং বেইজিং প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে একে অপরের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতায় নেমেছে। দুই দেশই এশিয়া মহাদেশে তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চাইছে আর এজন্য বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান আঞ্চলিক কৌশলগত ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশকে নিয়ে চীন-ভারতের এ টানাটানি নিয়ে ‘হিন্দুস্থান টাইমস’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশের উপকূল একটি বড় বিষয়। তাই দুই দেশই ‘বে অব বেঙ্গল’ এ আধিপত্য রাখতে বাংলাদেশের সঙ্গে একাত্মতা বজায় রাখার আন্তর্জাতিক খেলা খেলছে।

যুদ্ধে বাংলাদেশ কোন দেশকে সমর্থন করবে?
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়। বাংলাদেশের প্রায় সব সরকারই এই নীতি কমবেশি অনুসরণ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু চীন ও ভারত উভয়ই বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র। যুদ্ধ বেঁধে গেলে বাংলাদেশ কোন দেশকে সমর্থন করবে এ প্রশ্নের উত্তর জটিলতার গোলক ধাঁধায় মোড়ানো।
চীন-ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে অন্যান্য দেশ থেকে সব চেয়ে বেশী সংকটে পড়বে বাংলাদেশ এতে সন্দেহ নেই। কারণ একদিকে ভারতের সাথে ৪৫ বছরের বন্ধুত্ব, অন্যদিকে চীনের সাথেও বাংলাদেশের মধুর সম্পর্ক এবং বিপুল চীনা বিনিয়োগ। কোনটিকে অস্বীকার করবে বাংলাদেশ?

ভারত-চীন যুদ্ধ শুরু হলে কোন দেশকে সমর্থন করবে বাংলাদেশ? এ প্রশ্নের উত্তরে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির প্রিয়.কমকে বলেন, যুদ্ধের চেয়ে দুই দেশই এখন উত্তেজনা কমানোর জন্য মনোযোগী, এটি আশাবাদী হওয়ার মত বিষয়। যুদ্ধের বদলে দুটি দেশের সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক উভয় দেশের বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এটাই কামনা করে। তবে সত্যিই যদি দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েই যায় তবে বাংলাদেশ খুবই অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়বে।

তিনি আরও বলেন, ভারত ও চীন দুটি দেশই আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। দুটি দেশ ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্কযুক্ত। সামরিক বাহিনীর অস্ত্র বা সাধারণ বাণিজ্যে (আমদানি) চীনের অবস্থান সবার ওপরে। দেশটি ঐতিহাসিকভাবে আমাদের বন্ধুও। অপরদিকে ভারতের সাথে সম্পর্ক ও অবদানও কম নয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক হচ্ছে কূটনৈতিকভাবে উভয় দেশের সাথে সমদূরত্ব বজায় রাখা।

সাবেক এ পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেন, দেশদুটি যুদ্ধে লিপ্ত হলে তাদের অর্থনীতির ক্ষতি হবে। যেহেতু ওই দুটি দেশের সাথে আমাদের অর্থনীতিরও ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে তাই আমাদের অর্থনীতিরও ক্ষতি হবে। মারাক্তক ভাবে বাধাগ্রস্থ হবে আমাদের আমাদানি-রপ্তানি। তাছাড়া দুটি দেশের সাথে আমাদের যাতায়াত, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। সেটাও ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ্র চক্রবর্তীও মনে করেন, দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ হবার কোন সম্ভাবনা নেই। কেননা তারা উভয়েই উদীয়মান শক্তি। আর এ মূহূর্ত্বে যুদ্ধে জড়িয়ে নিয়েদের শক্তি ক্ষয় করতে চাইবে না। তবে বর্তমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে এমন কোন আচরণ বা বক্তব্য প্রদান না করা যা কোন একটি পক্ষের দিকে যায়।

তিনি বলেন, ভারত ও চীন দুটি দেশই আমাদের বাণিজ্যিক ও উন্নয়ন সহযোগি। আমরা চাই না কোন ভাবেই তারা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক। তবে সত্যিই যদি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় তবে বাংলাদেশের উচিৎ কোন ভাবেই যুদ্ধে না জড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দুটি দেশের মধ্যকার সংঘাত নিরসনের চেষ্টা করা। কেননা ভারত-চীন ক্ষতিগ্রস্থ হলে আমরাও বিভিন্ন ক্ষতির মুখে পড়ব।

Recent Posts

Leave a Comment