রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের পেছনের কথা!
মিয়ানমারে উত্থান হওয়া আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা দাবি করছে, অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর মতোই তারা দেশটিতে স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে সংগ্রাম করছে। তাদের দাবি, অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর মতো তারা নয়। এবং সেসব সন্ত্রাসী দল এবং তাদের কর্মকাণ্ডকে তারা সমর্থন করে না।
অন্যান্য বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের সদস্যদের পোশাকে যেমন নাম কিংবা র্যাঙ্ক বোঝা যায়, আরসার ভেতরে তেমনটি দেখা যায় না।
আরসা’র মুসলিম বিদ্রোহীরা সাধারণ গ্রামবাসীদের মতোই চলাফেরা করে থাকে। তাদের পোশাক দেখেও বোঝার উপায় নেই যে তারা বিদ্রোহী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। তারা সাধারণ গ্রামবাসীদের সঙ্গেই মিশে থাকে।
মিয়ানমারের সীমান্ত পুলিশের উপর চোরাগোপ্তা হামলা চালানোর পর সাধারণত তারা আত্মগোপনে যায়। কখনও কখনও সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশেও প্রবেশ করে। বাংলাদেশিদের সঙ্গে ধর্ম বিশ্বাস এবং ভাষায় তাদের মিলও অনেক।
মিয়ানমারের অন্যান্য দলগুলোর তুলনায় আরসা’র কৌশলের সঙ্গে মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডের দক্ষিণে সক্রিয় মুসলিম বিদ্রোহীদের বেশ মিল রয়েছে।
ARSA তাদের যে যুদ্ধ কৌশল প্রকাশ করেছে তাতে নেপাল কিংবা ভারতের মাওবাদীদের মতবাদের সঙ্গে মেলে না। ভারতের নকশালপন্থীরা নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা চালানোর সময় শত শত নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতো। নেপালের মাওবাদী বিদ্রোহীরা যখন সক্রিয় ছিল তাদের মধ্যেও এমন মনোভাব দেখা গেছে। কিন্তু আরসার সদস্যদের মধ্যে তেমনটা দেখা যায় না।
মূলত সংগঠনের সদস্যরা গোপনে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা চালায় এবং অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। হামলার ধরনটি দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে মিললেও মিয়ানমারে নতুন।
রাখাইন রাজ্যে জঙ্গি হামলার জবাবে গেল ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান পরিচালনার পর জানায়, তারা প্রায় ৪শ’ বিদ্রোহীকে হত্যা করেছে। কিন্তু যাদের তারা বিদ্রোহী বলে দাবি করছে, তাদের সকলেই নিরীহ গ্রামবাসী।
যদি নিহতদের সবাই বিদ্রোহী হতো তবে পুরো সংগঠনটিই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা! নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা এমনটাই মনে করেন। তাদের বিশ্লেষণ বলছে, বিদ্রোহীদের শক্তিমত্তা সামরিক বাহিনীর তুলনায় অনেক কম। আরসা সংগঠনের সদস্য সংখ্যা কয়েকশ’ থেকে হাজার হতে পারে। তবে প্রশিক্ষিত সদস্যের সংখ্যা ৫শ’র বেশি হবে না।
আরএসএ এর সামরিক ক্ষমতা সীমিত হলেও, তাদের প্রচারণা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। টুইটার এবং অন্যান্য সামাজিকমাধ্যমে বিস্ময়করভাবে নিখুঁত ইংরেজি ব্যবহার করা হয়। যাতে তাদের বিবৃতি যুক্তিসঙ্গত বলে বিবেচিত হয়।
সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে সংগঠনটি মাসব্যাপী অস্ত্র বিরতির ঘোষণা দেয়। যাতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছে ত্রাণ সংস্থাগুলোর মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়। ত্রাণ সংস্থাগুলো বলছে, গত ২৫ আগস্ট থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর দমন অভিযানের কারণে ৪ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
আরসা’র এক তরফা অস্ত্র বিরতি ঘোষণা প্রমাণ করে যে তারা এখনও পরিপূর্ণ সংগঠিত বাহিনী হিসেবে গড়ে ওঠেনি। বেশিরভাগ হামলাতেই সংগঠনের সদস্যদের আগ্নেয়াস্ত্রের বদলে চাপাতি ব্যবহার করতে দেখা গেছে। তাছাড়া, মিয়ানমারের শক্তিশালী বাহিনীর কবল থেকে অপ্রতুল অস্ত্র এবং সামান্য প্রশিক্ষিত বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে রোহিঙ্গাদের কিভাবে রক্ষা করা সম্ভব হবে তা জানাতেও আরসা ব্যর্থ হয়েছে।
বরং এশিয়া টাইম জেনেছে, হামলার মধ্য দিয়ে নিধন অভিযান চালাতে মিয়ানমার বাহিনীকে উস্কে দেয়ার জন্য রোহিঙ্গা এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আরসা’র উপরই ক্রুদ্ধ।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর অপর এক বার্তায় আরসা জানায়, আল-কায়েদা, আইএস কিংবা লস্কর-ই-তৈয়বার মতো জঙ্গি সংগঠনের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। নিজেদের স্বাধীনতার লক্ষ্যের কথা জানিয়ে সংগঠনের নেতা জানান, তারা এসব সংগঠনের কার্যক্রমের ঘোর বিরোধী। এসব জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর প্রবেশ ঘটলে বরং মিয়ানমারের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।
তবে পাকিস্তানসহ বিদেশী কোনো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে আরসা’র যোগাযোগ নেই, এমন দাবি মানতে নারাজ নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। আরসা’র নেতা আয়াতুল্লাহ্ আবু আমর, যিনি হাফিজ তোহার নামেও পরিচিত.. তার জন্ম করাচি’তে। তিনি সৌদি আরব থেকে মাদ্রাসা শিক্ষালাভ করেন।
পাকিস্তানেও বিভিন্ন স্থানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে থাকেন। যাদের প্রায় সবাই দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসী হিসেবে সেখানে বসবাস করছেন। এরা দীর্ঘ দিন ধরে দেশ ছাড়া এবং তাদের সন্তানেরা সেখানেই জন্মগ্রহণ করেছে। এদের কারও কারও বিরুদ্ধে আবার আফগান যুদ্ধে কর্মী সংগ্রহের অভিযোগ রয়েছে।
আরসা প্রাথমিকভাবে হরকাহ আল-ইয়াকিন বা “বিশ্বাস আন্দোলন” নামে পরিচিত ছিল। মনিকারের সঙ্গে সরাসরি ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সংযোগ ছিল এবং উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে সেখানে রোহিঙ্গা বা রাখাইন শব্দটি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এটি শুধুমাত্র গত বছর থেকে উল্লেখ করা শুরু হয়। তারা জাতিগত নাম দিয়ে ARSA’র ব্যবহার শুরু করে।
গোয়েন্দাদের বিশ্লেষণ বলছে, সংস্থার পরামর্শক হচ্ছেন আবদুস কাদুস বাউমি। যিনি নিজেও রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত পাকিস্তানি। তিনি নিজেও করাচিতেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ভিডিও বার্তায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ ঘোষণা করেন।
আবদুস কাদুসের সঙ্গে লস্কর-ই-তৈয়বার যোগাযোগ থাকার তথ্য রয়েছে। যেটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম ইসলামী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর অন্যতম। এই সংগঠনটি মূলত পাকিস্তান থেকে পরিচালিত হয়।
১৯৮৭ সালে আল কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আবদুস কাদুস এমনকি লস্কর-ই-তৈয়বার শীর্ষ নেতা হাফিজ মোহাম্মদ সাঈদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন।
এশিয়া টাইমস জানায়, আরএসএ এর দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা একজন শ্বেতাঙ্গ যিনি শুধুমাত্র “শরীফ” নামে পরিচিত। যিনি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন। যদিও তাকে কোনো প্রচার ভিডিওতে দেখা যায়নি। তবে তিনি উর্দু ভাষায় কথা বলে থাকেন, যেটি পাকিস্তানের দাপ্তরিক ভাষা।
আরসা নিজেও রাখাইন রাজ্যে এবং বাংলাদেশের শরণার্থী ক্যাম্পে ক্রুদ্ধ ও হতাশাগ্রস্থ রোহিঙ্গা যুবকদের দলে অন্তর্ভূক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, দলটিতে দেড় শতাধিক বিদেশীও বিভিন্ন পদে রয়েছেন।
এদের মধ্যে বেশিরভাগই বাংলাদেশি। ৮ থেকে ১০ জন পাকিস্তান থেকে এসেছেন। সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ থাইল্যান্ডের লোকও রয়েছে। এছাড়া দু’জন উজবেকিস্তানের নাগরিকও রয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় এদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। যাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন আফগান যুদ্ধের অংশ নেয়া প্রশিক্ষিত সেনারা।
এশিয়া টাইমস জানায়, এটি এখন স্পষ্ট যে ২৫ আগস্টের হামলাগুলো পূর্ব পরিকল্পিত ছিল। হামলার মাস খানেক আগে রাখাইনে বৌদ্ধ ও মুসলিমসহ প্রায় ৫০ ব্যক্তিকে সরকারের সোর্স হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছিল। যাদের সেনা অভিযান পরিচালনার আগে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
বিষয়টি কাকতালীয় হলেও ২৪ আগস্টেই জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বে রাখাইন প্রদেশের উপদেষ্টা পরিষদ শান্তিপূর্ণ উপায়ে ওই অঞ্চলের সংঘাত বন্ধে মিয়ানমার সরকারকে রিপোর্ট প্রকাশ করে।
তবে বর্তমানে রাখাইনে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, কফি আনানের সেই পরামর্শ বাস্তবায়ন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়