চ্যাম্পিয়ন রংপুর!
মাশরাফির হাতে জাদু। গেইলের হাতে ধ্বংসের গদা। দুইয়ের মিলনে উদ্দীপ্ত বোলাররা। আর এর মাঝে শুধু পাড় সমর্থক ছাড়া কেইবা মনে রাখে ঢাকা ডায়নামাইটসকে! খেলল যে শুধু রংপুর রাইডার্সই! মাশরাফির সমার্থ বিপিএল চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক। গেইলের সমার্থক বিপিএল সেঞ্চুরির ধ্বংসাত্মক ইতিহাস। আর টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট মানে বিনোদনের প্যান্ডোরার বাক্স। সেই বাক্স নক আউটে খুলে যেতেই একের পর এক নক আউট পাঞ্চ। গ্রুপপর্বের সাদামাটা রংপুর রাইডার্স যেন বনের রাজা সিংহ! আর তাতেই বিপিএলের পঞ্চম আসরের ফাইনালটা বড্ড একপেশে হয়ে যায়। শোচনীয় হারে সাকিব আল হাসানের ঢাকা হারিয়ে ফেলে গেলবার জেতা শিরোপাটা। তার আগের তিন আসরের চ্যাম্পিয়ন দলের নেতা মাশরাফি এবার রংপুরে যোগ দিয়েই বাজিমাত। প্রথমবার ফাইনালে উঠেই দলটি চ্যাম্পিয়ন! খেলাটা যদি বিনোদনের হয়ে থাকে তাহলে তার ষোল আনার বেশি তো আগে ব্যাট হাতে দর্শকদের সুদে আসলে আগেই বুঝিয়ে দিয়েছেন গেইল নামের এক মহাদানব। মাশরাফির হাতে তাই চতুর্থবারের মতো উঠে যায় বিপিএল নামের বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের চতুর্থ শিরোপাটি!
তারপরও প্রশ্ন, শিরোপাটা ঢাকার হাত থেকে গলে পড়লো নাকি অধিনায়ক সাকিবের মুঠো গলে? তিনিই তো ২২ রানে নতুন জীবন দিয়েছিলেন গেইলকে। তাতেই পুড়ে ছাই হয়ে বর্তমানরা সাবেক চ্যাম্পিয়ন। বিপিএল পায় শিরোপার নতুন মালিক।
২০৭ রানের লক্ষ্য। টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে এই রান তাড়া বেশ কঠিনই। তবে এমন না যে হয় না। তবে মিরপুরের উইকেটে তা হয়নি কখনো। সেই দুঃসাধ্য লক্ষ্য তাড়া করতেই নেমেছিল ঢাকা। কিন্তু ২৯ রানেই নেই ৪ উইকেট। এই তালিকায় দলের দুই প্রধান ভরসা ইভিন লুইস ও কাইরন পোলার্ডও। ব্যাকফুটে শুরু থেকেই। এরপর পঞ্চম উইকেটে জহুরুল ইসলামকে নিয়ে ৪২ রানের জুটি গড়েন সাকিব। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি কিছুই। দলীয় ৭১ রানে সাকিব আউট হতেই আবার ভেঙে পড়ে ঢাকার ইনিংস। ১৬ রান যোগ করতেই হারায় আরও ৩ উইকেট।
৮৭ রানে ৭ উইকেট হারানোর পর অষ্টম উইকেটে সুনিল নারিন-জহুরুল চেষ্টা চালান। কিন্তু তখন গন্তব্যে পৌঁছানো রীতিমতো অসম্ভব। সেই পথে পাড়ি জমাতে অলৌকিকতাই ভরসা। কিন্তু ওটাও এই পরিস্থিতিতে কোটি ক্রোশ দুরে। ৪২ রানের জুটিটি কেবল হারের ব্যবধানই কমিয়েছে। অন্যভাবে বললে, এই জুটি ঢাকাকে আরো বড় লজ্জা থেকে বাঁচিয়েছে। ঢাকার ব্যাটসম্যানদের আসা যাওয়ার মিছিলে এদিন ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল জহুরুল। ৩৭ বলে ৫০ রানের ইনিংস খেলেছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৬ সাকিবের। রংপুরের পক্ষে ২টি করে উইকেট শিকার করেছেন সোহাগ গাজী, ইসুরু উদানা ও নাজমুল ইসলাম অপু। ১টি করে উইকেট মাশরাফি, রুবেল হোসেন ও রবি বোপারার। শেষটাও বিনোদন দিয়ে করতে ২০তম ওভারে বল হাতে নেন গেইল। মাত্র ১ রান দিলেও অল আউট করতে পারেননি প্রতিপক্ষকে।
এর আগে গেইল যা করেছেন তা তো আসলে টর্নেডোর চেয়েও বেশি কিছু! একই দিনে বদলে দিয়েছেন বিপিএলের রেকর্ড বইয়ের অনেক পাতার হিসেব নিকেশ। কি ছিলো না এই ইনিংসে? সর্বোচ্চ রানের ইনিংস (১৪৬*) খেলেছেন, সর্বাধিক ছক্কা মেরেছেন (১৮টি), বিপিএলে সবচেয়ে দ্রুত ঢুকেছেন (২৬ ইনিংসে) হাজারী ক্লাবে, ম্যাককালামকে নিয়ে গড়েছেন বিপিএলের সর্বোচ্চ জুটিও (২০১*)।
অথচ এই রেকর্ডটা থামিয়ে দলকে ফ্রন্ট ফুটে নিতে পারতেন ঢাকার অধিনায়ক সাকিব। ব্যক্তিগত ২২ রানে যে তার হাতে ক্যাচ দিয়েছিলেন গেইল। হাতে নিয়েও ফেলে দিয়েছেন সাকিব। আসলে ফেলে দিয়েছেন শিরোপাটাই। সুযোগ আরও ছিল। বল একবার মাঠের বাইরে নয়, ভেতরেই আকাশেই তুলে দিয়েছিলেন গেইল। সেটি ধরতে তিনজনের দৌড়। উইকেটরক্ষক জহুরুল ইসলাম অমিও ছিলেন। কিন্তু হাতের ইশারায় বোলার আবু হায়দার রনি জানালেন, তিনি পারবেন। বাস্তবে বোলিং প্রান্ত থেকে দৌড়ে এসে বলের নাগালই পেলেন না! অথচ ক্যাচটি সহজভাবেই ধরতে পারতেন উইকেটরক্ষক। গেইল তখন ৭৮ রানে। এরপর ৬৮ রান করেছেন তিনি।
গ্রুপপর্বে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি রংপুর। ধুঁকতে ধুঁকতেই শেষ চারে উঠেছে। বাদ পড়ার শঙ্কাও ছিল। কিন্তু সেই দলটাই আমূল বদলে গেল শেষ চারে এসে। স্বপ্নের শিরোপাটা জিততে টানা তিন ম্যাচেই জিততে হতো, আর একের পর এক নক আউট পাঞ্চে মাশরাফির প্রবল উদ্যমী দল তাই করে দেখালো। আর শেষ তিন ম্যাচেই দলের দুই ক্যারিবিয়ান করলেন তিনটি সেঞ্চুরি। শুধু তাই নয়, পুরো আসর জুড়ে রানখরায় থাকা ব্রেন্ডন ম্যাককালামও তোপ দাগালেন। এরপর আর কি করার থাকে প্রতিপক্ষের। শুধু দেখে যাওয়া ছাড়া। বিনোদনে উন্মাতাল দর্শকদের সাথে তারাও দেখলেন। আর তাতেই প্রথমবার ফাইনালে উঠেই ঢাকার হাত থেকে শিরোপাটাও ছিনিয়ে নেয় রংপুর।
টস হারার পর দলীয় ৫ রানেই আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান জনসন চার্লসকে হারায় রংপুর। পাঁচ ওভারে রান মাত্র ২৯। স্কোরটা খুব বেশি ছিলো না ইনিংসের আধেকে এসেও। ১০ ওভারে ৬৩। কিন্তু সেই স্কোর ইনিংস শেষে ২০৬! আর এ সবই সম্ভব হয়েছে গেইলের দানবীয় ব্যাটিংয়ে। ইনিংসের অর্ধেক শেষ হতেই যেন ভেতরের দানবটা জেগে ওঠে গেইলের। ঢাকার বোলারদের গলির বোলারদের মতো পেটালেন। ছাতু বানালেন। খালেদ আহমেদের ১১তম ওভারের শেষ তিন বলে ২টি ছক্কা ও ১টি চারের মার। বাদ দেননি টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটের সেরা বোলার শহিদ আফ্রিদিকেও। ১৪তম ওভারের শেষ দুই বলে টানা দুটি ছক্কা তাকে। টর্নেডোর শুরু দেখে শেরে বাংলার গ্যালারিতে সব সমর্থককে তখন শুধু রংপুরেরই মনে হয়! বিনোদনই তো পেতে এসেছেন তারা। আর গেইল তো বিনোদন দেওয়ার দুনিয়া সেরা ব্যাটিং কারিগর।
১৫তম ওভারে বোলার রনির হাতে জীবন পেয়েই টানা দুটি ছক্কা। ফলে বিপিএলে গেইলের পঞ্চম সেঞ্চুরিটা ছিল তখন সময়ের ব্যাপার। আর তা তুলেও নেন তিনি চোখের পলকে। সুনিল নারিনের করা ১৭তম ওভারের প্রথম বলে লং অনে ঠেলে দিয়ে করে ফেলেন টি-টুয়েন্টি ক্যারিয়ারের ২০তম সেঞ্চুরি। বিপিএলে এটি তার পঞ্চম। আর ১০০ করতে যে ছক্কাটি মেরেছেন সেটি ইনিংসে তার ১১তম! তবে সেঞ্চুরি করেও থামেননি গেইল। নিজেকে আরো ছাড়িয়ে যাওয়ার নেশা তখন পেয়ে বসেছে তাকে। পরে খেলেছেন আরও ১২ বল। তাতে রান করেছেন ৪৬। শেষ পর্যন্ত ৬৯ বলে ৫টি চার ও ১৮টি ছক্কায় খেলেন হার না মানা ১৪৬ রানের ইনিংস।
শেষ ওভারে সাকিবকেও ৩টি ছক্কা মেরেছেন গেইল। কিন্তু যে সাকিবের কারণে এই গেইল ঝড়ের শুরু সেই বোলারই শেষে তাকে শিকার করেন। বিপিএলে এটা এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ছক্কার নতুন রেকর্ড এক ম্যাচ আগের সেঞ্চুরিতে করেছিলেন। ১৪টি। এবার ছাড়িয়ে গেলেন এখানেও নিজেকে। ১৮টি!সঙ্গে চারও আছে ৫টি। বিপিএলের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস নিজেরই অপরাজিত ১২৬ কেও ছাড়িয়ে গেলেন গেইল। দারুণ এক হাফসেঞ্চুরি তুলে নেন ম্যাককালামও। ৪৩ বলে ৪টি চার ও ৩টি ছক্কায় করেন অপরাজিত ৫১ রান।
২৬ রানের খরচায় রংপুরের একমাত্র উইকেটটি নেন সাকিব। কিন্তু দিনের শেষে সবচেয়ে দুঃখী মানুষটি বোধহয় সদ্যই বাংলাদেশের টেস্ট নেতৃত্ব পাওয়া এই মানুষটি! সবাই যে বলছে, তার হাত গলেই শিরোপাটা হারিয়ে গেল। তবে এই মতের সাথে মাশরাফি জাদু ও গেইল ধ্বংসযজ্ঞকে ভুলবেন কিভাবে!