‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংবিধান পরিপন্থী’

 In আইন আদালত, প্রধান খবর

‘আর্মি রুলস ভঙ্গকারী অবৈধ দখলদার রাষ্ট্রপতি’ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বেয়নেটের খোঁচায় আনা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংবিধানের মূল কাঠামো পরিপন্থী বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা রিট শুনানির জন্যে গঠিত তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের এই রায় বৃহস্পতিবার প্রকাশ হয়েছে।

এর আগে, বেঞ্চের দুই জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের অংশ গত ১১ অগাস্ট প্রকাশ হয়। ওইদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে এই দুই বিচারকের দেওয়া ১৬৫ পৃষ্ঠার রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে তোলা হয়। তৃতীয় বিচারকের রায় মিলিয়ে পৃষ্ঠার সংখ্যা ২৯০। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে দেওয়া রায়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়।

দুই বিচারপতির মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল বলেন, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বেয়নেটের খোঁচায় আর্মি রুলস ভঙ্গকারী অবৈধ দখলদার রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের একক ইচ্ছায় প্রণীত ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ সংবলিত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদটি সংবিধান পরিপন্থী এবং আপিল বিভাগের রায়ের পরিপন্থী।

‘জাতির জনকের নেতৃত্বে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির বিজ্ঞ সদস্যবৃন্দ এবং গণপরিষদের ৪০৩ জন সদস্যবৃন্দের কর্ম, আদর্শকে অবমূল্যায়নের শামিল। তথা সংবিধানের প্রস্তাবনার পরিপন্থী, সংবিধানের পরিপন্থী তথা বাতিল আইন।’

‘সংসদ কর্তৃক বিচারক অপসারণ ব্যবস্থা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারতসহ উন্নত দেশগুলোতে বিরাজমান। অপরদিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কেবল পাকিস্তানে বিদ্যমান।’ ‘জিয়া তার বেয়নেটের খোঁচায় এটা এনেছেন।

অন্যদিকে সংসদ কর্তৃক অপসারণ ব্যবস্থা সংবলিত ৯৬ অনুচ্ছেদের মূল সংবিধানে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির সদস্যরা এবং গণপরিষদের ৪০৩ জন সদস্য।’

‘সামরিক জান্তা কর্তৃক বেয়নেটের খোঁচায় আনা’ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিচার বিভাগের স্বাধীনতারও পরিপন্থী উল্লেখ করে বিচারক বলেন, সংবিধানের প্রস্তাবনায় বর্ণিত মহান আদর্শ সমূহের পরিপন্থি তথা অসাংবিধানিক এবং সংবিধানের মূল কাঠামোর পরিপন্থি।’

‘দখলদার রাষ্ট্রপতি জিয়ার একক খেয়াল খুশিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক বিচারক অপসারণ প্রক্রিয়া সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অন্তর্ভূক্তকরণের সামরিক ফরমান উপড়ে ফেলা তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের আইনগত দায়িত্ব ছিল। যা আমাদের তৎকালীন সুপ্রিম কোর্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে।’ ‘আমাদের সুপ্রিম কোর্টকে সেই লজ্জা থেকে তথা কলঙ্ক থেকে মুক্ত করেছেন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, ২০০৫ সালে তার পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের মাধ্যমে।’

‘পরে প্রধান বিচারপতি মো. তফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে আমাদের আপিল বিভাগ রায়ে কফিনের শেষ পেরেকটি ঠুকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংবলিত ৯৬ অনুচ্ছেদ কবরস্থ করেন।’ ‘আমাদের মহান জাতীয় সংসদ সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) আইন-২০১৪ প্রণয়ন করে আমাদের সংবিধানকে কলঙ্কমুক্ত করেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।’

বিচারক বলেন, ত্রিশ লাখ বাঙালির আত্মত্যাগের বিনিময়ে এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের অর্জিত সংবিধানকে আমরা ফেরত পেলাম। সে কারণে আমি বর্তমান মহান জাতীয় সংসদকে বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ‘রিট পিটিশনটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে দেখলাম, দরখাস্তকারী প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, এই আইনটি সংবিধানের বিধানাবলীর সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ তথা অসাংবিধানিক।’

‘আমাদের সংবিধান লিখিত এবং প্রায় অপরিবর্তনীয়। কেবল একান্তভাবে অপরিহার্য হলে সংবিধানের প্রস্তাবনা, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে এবং এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এবং মৌলিক অধিকারসমূহকে ন্যুনতম বা বিন্দুমাত্র ক্ষতিগ্রস্থ না করে সংবিধান সংশোধন করা যেতে পারে।’

‘আমার মতামত হলো, জাতীয় সংসদ সংবিধানসম্মতভাবে সংবিধান আইন-২০১৪ প্রণয়ন করেছেন। সংসদ কর্তৃক বিচারপতি অপসারণ প্রক্রিয়া সম্বলিত ৯৬ অনুচ্ছেদটি বিদ্যমান থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত থাকবে। কারণ সংসদ কর্তৃক বিচারপতি অপসারণ প্রক্রিয়া সম্বলিত ৯৬ অনুচ্ছেদটি হল আমাদের মূল সংবিধানের অংশ, সংবিধানের মূল কাঠামো।’

‘যেহেতু অভিজ্ঞ বিচারকের সংকট দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে, সেহেতু আমি মনে করি, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের বয়স ৭৫ বছরে উন্নীত করা একান্তভাবে প্রয়োজন এবং অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সেই লক্ষ্যে আমি মহান জাতীয় সংসদের নিকট সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের (১) উপ-ধারা সংশোধনপূর্বক বিচারকদের বয়স ৬৭’র স্থলে ৭৫ করার প্রস্তাব করছি।’

‘আমি বিচারক অপসারণ সংক্রান্ত ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অসদাচরণ বা অসামর্থ (তদন্ত ও প্রমাণ) আইন-২০১৬’ শীর্ষক বিলের খসড়া পর্যালোচনা করলাম।’ ‘জনগুরুত্বপূর্ণ বিধায় এ বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৬ মোতাবেক রাষ্ট্রপতি মতামতের জন্য সুপ্রিম কোর্টে পাঠাতে পারেন। আপিল বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানির পর বিলটি সম্পর্কে মতামত প্রেরণ করতে পারেন। তাহলে বিষয়টি সবচেয়ে সুন্দরভাবে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্যভাবে নিষ্পত্তি হবে বলে আমার বিশ্বাস।’

রায়ের মূল অংশে বলা হয়েছে, “বলতে দ্বিধা নেই, ষোড়শ সংশোধনী একটি কালারেবল লেজিসলেশন (কোনো কাজ সংবিধানের মধ্যে থেকে করার সুযোগ না থাকলে আইনসভা যখন ছদ্ম আবরণে ভিন্ন প্রয়োজনের যুক্তি দেখিয়ে একটি আইন তৈরি করে), যা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘন।

“এটা সংবিধানের দুটি মূল কাঠামো ৯৪(৪)ও ১৪৭(২) অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন। একইসঙ্গে সংবিধানের ৭(বি) অনুচ্ছেদকেও আঘাত করে।”

সংবিধানের ৭ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্যকোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে। ৯৪ (৪) অনুচ্ছেদে রয়েছে- এই সংবিধানের বিধানাবলী-সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।

রায়ে বলা হয়, “রুল যথাযথ (অ্যবসলিউট) ঘোষণা করা হল। ষোড়শ সংশোধনী আইন-২০১৪ কালারেবল, এটি বাতিল এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হল। সংবিধান-ব্যাখ্যার বিষয়ে আইনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত থাকায় সংবিধানের ১০৩(২)(ক) অনুসারে সনদ দেওয়া হচ্ছে।”

Recent Posts

Leave a Comment