হিলারি ফার্স্ট লেডী ছিলেন আবার ওবামার কিছুদিন সেক্রেটারী অব স্টেটও ছিলেন। যদিওবা প্রতিভার কোনও স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। সেই বিবেচনায় তার ন্যুন্যতম যোগ্যতা রয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায় কিন্তু তার বিশ্বস্ততার মাত্রা শূন্যের ঘরে যা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য মৌলিক গুণ।
সেপ্টেম্বর মাসে হিলারি সেক্রেটারী অব ষ্টেট থাকার সময় ব্যক্তিগত ই-মেইল ব্যবহারের বিষয়ে এফবিআই তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছে – সে রিপোর্টে এফবিআই বলেছে, গোপনীয় তথ্য কিভাবে সামলাতে হয় সে বিষয়ে সর্বোচ্চ জ্ঞান প্রদর্শন করতে পারেনি হিলারি। এ কারণে এফবিআই হিলারি ও তার কর্মীদেরকে গোপনীয় তথ্য সংরক্ষনের ব্যাপারে অত্যন্ত অসতর্ক বলে মন্তব্য করেছেন।
এফবিআই-এর রিপোর্টে হিলারির জয়যাত্রার পথকে ব্যাহত করেছে নিশ্চয়ই। এ উছিলায় ট্রাম্প বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মতো বিশ্বাসযোগ্য ও সৎপ্রার্থী হিলারি নন। হিলারি বলছেন, ট্যাক্স রিটার্ন দিতে ট্রাম্প ব্যর্থ হয়েছেন আর ব্যবসায়ী হিসাবে ট্রাম্পের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ নয়। হিলারির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ আর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সমগুরুত্বের নয়।
হিলারির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ গুরুতর। আমেরিকার ভোটাররা ট্রাম্প সম্পর্কে যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন হিলারি, তার চেয়ে হিলারির বিরুদ্ধে ট্রাম্পের উত্থাপিত অভিযোগকেই বেশী বিবেচনায় নিবেন।
বারাক ওবামা ও তার স্ত্রী মাঝে মাঝে হিলারির পক্ষে প্রচার অভিযানে অংশ নিচ্ছেন। কালো মানুষদের ভোট ওবামা ও তার স্ত্রীর প্রচারের ফলে প্রভাবিত হবে নিঃসন্দেহে। সুতরাং আমরা একথাটা বলতে পারি যে, হিলারি কালোদের ভোট একচেটিয়াভাবে পাবেন।
আবার ট্রাম্পের যে এরূপ ভোট নেই তা নয়। ট্রাম্পের সমর্থকেরা শেতাঙ্গ ও কম শিক্ষিত। তারা কৃষ্ণাঙ্গদের চেয়ে সংখ্যা ভারী। অর্থনৈতিক মন্দার ফলে শ্বেতাঙ্গদের বিরাট এক জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে গেছে। তারা খনিতে কাজ করতো, এখন কয়লা খনিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ছোট কারখানায় কাজ করতো তা বন্ধ হয়ে। মেক্সিকো বা চীনে স্থানান্তর হয়ে গেছে। অনেকে ছোট-খাট ব্যবসা করতো, এখন বন্ধ হয়ে গেছে। সম্মিলিতভাবে এ বেকার শ্রেণীটা একাট্টা হয়ে ট্রাম্পকে সমর্থন করেছে।
ট্রাম্প অভিবাসনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। আমেরিকান জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে কথা বলছেন। তারা মনে করছে এসব তাদের দুঃখ ঘোচাবে। তাদের বিশ্বাস, সরকারের লাগামহীনতার কারণেই তারা দুঃখ-কষ্টের মাঝে পড়েছে। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি আমেরিকার বাইরে কোনও কিছুতে জড়িত হবেন না। আর তার এসব প্রতিশ্রুতিতে শ্বেতাঙ্গরা উল্লসিত হয়েছে। শ্বেতাঙ্গদের মাঝে এমন এক ভয় কাজ করছে যে, তারা আগামী ২০/২৫ বছরের মাঝে আমেরিকায় সংখ্যালঘু হয়ে যাবে – ট্রাম্প যদি অভিবাসন বন্ধ করেন তবে সে সম্ভাবনা আর থাকে না।
ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য নিঃশেষ হওয়া সম্পর্কে শ্বেতাঙ্গদের সচেতন করেছেন। সুতরাং শ্বেতাঙ্গরা যে ট্রাম্পবাদে আস্থাশীল সে ব্যাপারে শতাংশে নিশ্চিত। ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গদের মাঝে যে আত্ম-সচেতনতা জাগিয়ে দিয়েছেন তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত না হলেও তার পরিসমাপ্তি সহজে হবে না। তা ভবিষ্যতে হয়তো বা কোনও অঘটনও ঘটাতে পারে। কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিদের এখনও শ্বেতাঙ্গরা মানুষ হিসাবে গণ্য করে না।
আমেরিকানরা দুই বার বারাক ওবামাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছেন। অনেকে এখন মনে করছেন, ওবামা বিশুদ্ধ আমেরিকান নহেন। শুধু রিপাবলিকনরা দেশের অর্থনীতিকে বহিঃবিশ্বে মাতব্বরি করতে গিয়ে বিধ্বস্ত করে ফেলেছে। তার হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির বারাক ওবামাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছিলেন এবং বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের জন্য দ্বিতীয়বারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে সময় প্রদান করেছিলেন।
বারাক ওবামা অর্থনীতি পুনর্গঠনে অনেক কাজ করেছেন। মন্দার তীব্রতা এতো বেশী ছিল যে তা সামাল দিয়ে অর্থনীতিকে বলবান করতে না পারলেও একটা স্তরে পৌঁছাতে ওবামা সক্ষম হয়েছেন। ওবামা যখন প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তখন কিন্তু আমেরিকার বহু ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। মোটর কোম্পানী ফোর্ডও নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণার অনুমতি প্রদানের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছিল। ওবামা মোটর কোম্পানীগুলোকে সরকারি ভর্তুকি প্রদান করে পুনর্গঠণের সুযোগ প্রদান করেছিলেন এবং দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিগ্যান ছাড়া কয়েক দশকের মাঝে কোনও বয়স্ক লোক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। কিন্তু এবারের নির্বাচনে উভয় প্রর্থী বয়স্ক। ট্রাম্পের বর্তমান বয়স ৭০ বছর আর হিলারির বর্তমান বয়স ৬৮ বছর। হিলারিকে গত ৩০ বছরব্যাপী আমেরিকার জনগণ জানার সুযোগ পেয়েছে কারণ তার স্বামী বিল ক্লিনটন দু’বার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি নিউইয়র্ক এর সিনেটরও ছিলেন আবার বারাক ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন এক মেয়াদে। এরপরও হিলারির প্রতি মানুষের খুব বেশী আস্থা নেই।
আবার লিঙ্গ বৈষম্যটাও প্রকট হয়ে উঠেছে। ট্রাম্প ব্যবসায়ী, রাজনীতিতে নবাগত। কিন্তু প্রাইমারিতে কেউই তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকতে পারেননি। এমনকি বুশ পরিবারের জেব বুশও নন। রিপাবলিকান পার্টির কোনও বড় নেতা তার নির্বাচনী প্রচারনায় শরীক হচ্ছেন না। বরঞ্চ বড় নেতারা রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফান্ডও আটকিয়ে রেখেছেন। এরপরও ট্রাম্প ধীরে ধীরে পথ চলতে চলতে পার্টির মনোনয়নও পেলেন, আবার এখন জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও এসেছেন।
হিলারিকে পরাজিত করাও বিচিত্র কিছু নয়। সাদাদের সমর্থন তার প্রতি জোরালো। তিনি মেক্সিকো সফর করে মেক্সিকোর অধিবাসী যারা আমেরিকার নাগরিকত্ব পেয়ে আমেরিকায় বসবাস করছেন তাদেরকে নিরপেক্ষ করেছেন আবার হিম্পানীদের সমর্থনও কিছু আদায় করতে পেরেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস্ হিলারির সমর্থক পত্রিকা। নিউইয়ক টাইমস এবং সিবিএস নিউজ এর সর্বশেষ জরীপে দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে উভয় প্রার্থীর মাঝে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইহুদী লবি একটা কার্যকর ভূমিকা রাখে।
হিলারি তার মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন এক বর্ণাঢ্য ইহুদী পরিবারে। আবার ট্রাম্প তার ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন আর এক ইহুদী বর্ণাঢ্য পরিবার থেকে। ইহুদীরা সাধারনতঃ রিপাবলিকানদের প্রতিই বেশী সহানুভূতিশীল। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কার জয় হয়। ৮ই নভেম্বর সব জল্পনা-কল্পনার অবসান হবে।
আমেরিকান সোসাইটি যতই অগ্রসর মনে করা হোক না কেন, উদ্যোক্তরা ম্যানেজারিয়াল পোষ্টে নারী নিয়োগ দিতে উৎসাহী দেখা যায় না। আমেরিকার মানুষ কখনও কোনও নারীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেননি। তাই তারা কখনই কোনও নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেখেননি। আমেরিকার ভোটারেরা কোনও নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেখতে কতটা প্রস্তুত ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। সুতরাং হিলারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন এ রবি এখন যতই জোরালো হোক না কেন, ফিকে হয়ে যাওয়াও অসম্ভব না।
আনিস আলমগীর : সাংবাদিক ও শিক্ষক।
anisalamgir@gmail.com