এখন দেশে ফিরে বেগম জিয়া কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন সেটা দেখেই বোঝা যাবে তাদের মধ্যে কোন বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, আগামী কিছুদিন দল গোছানোর কাজটাই প্রাধান্য দেবেন বেগম জিয়া। তারপর সুবিধাজনক সময়ে সরকারবিরোধী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবেন। আগামী ২২ সেপ্টেম্বর বেগম জিয়া দেশে ফিরবেন বলে জানা গেছে। সৌদি আরব থেকে তিনি লন্ডন যেতে পারেন বলে শোনা গেলেও তিনি সেখানে যাচ্ছেন না। দেশে ফেরার পর বেগম জিয়াকে ‘যথোপযুক্ত সংবর্ধনা’ দেওয়া হবে বলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন।
বিএনপিকে নিয়ে বাজারে এখন নানা কথা। দেশের একটি অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল হলেও গত কয়েক বছর ধরে বিএনপি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে নাজুক পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। ২০০৮-এর নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর বিএনপি সেই পরাজয়কে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। ফলে দলগতভাবে তখন থেকেই বিএনপি অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে। একটি নির্বাচিত সরকারকে ৫ বছরের মেয়াদকাল পূরণ করার সুযোগ না দিয়ে তাকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর এক অবাস্তব আকাঙ্ক্ষা বিএনপিকে ক্রমাগত ভুলের দিকেই ঠেলে দিয়েছে।
সরকার পতনের আন্দোলনের নামে সহিংস-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে দলের কর্মীদের। সরকারও বিএনপির অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারিতা মোকবিলা করার জন্য কঠোর অবস্থান নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। রাষ্ট্রশক্তিকে মোকাবেলা করার মতো রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক শক্তি বিএনপির না থাকায় সরকারের মুখোমুখি হয়ে তাকে বারবার পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। বিএনপির একটি বিপুল সমর্থক গোষ্ঠি দেশের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু এই সমর্থকরা বেগম জিয়াকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য জীবন বাজি রেখে আন্দোলনে নামতে যে অনাগ্রহী এটা দলের নীতি নির্ধারকরা বুঝতে না পেরেই বারবার হঠকারী ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়ে দলকে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়েছেন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি এখন এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে দেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করার সক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছে। সরকারের প্রচণ্ড চাপের মুখে বিএনপি এখন দিশেহারা দশা। জামায়াতে ইসলামীর দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে আন্দোলনের নামে বিএনপি দেশের মানুষকে এতটাই ত্যক্ত-বিরক্ত করেছেন যে তাদের আন্দোলনের কথা শুনলে কেউ আর উৎসাহ বোধ করে না বরং আতংকিত হয়ে পড়ে। ফলে ২০১৫ সালের শুরুতে তিন মাস ব্যর্থ অবরোধ আন্দোলন চালিয়ে বিএনপি সেই যে ঘরে ঢুকেছে কোনো ভাবেই আর বের হতে পারছেনা।
জাতীয় কাউন্সিল সম্পন্ন হওয়ার পর বিএনপি আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে বলে আশা করা হলেও তা বাস্তবে হয়নি। কাউন্সিলের দীর্ঘ সাড়ে চার মাস পর বিএনপির যে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে সেটাও দলের ঐক্যকে সংহত না করে আরো বিভ্রান্তি বাড়িয়েছে। দলের গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে প্রায় ছয়শ জনের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করেও অনেকটাই খুশি করা যায়নি। যারা কোনো পদ পায়নি তারা যেমন ক্ষুব্ধ তেমনি পদ পেয়েও অনেকে গোস্বা করেছেন কাঙ্ক্ষিত পদ না পেয়ে। দলের মধ্যে কার্যত বিরাজ করছে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা।
এই অবস্থা কাটিয়ে উঠে কিভাবে নতুন করে যাত্রা শুরু করা হবে সেটা অনেকের কাছেই অজানা। বিএনপির কোনো কোনো নেতা বক্তৃতা বিবৃতিতে এখনও সরকারের বিরুদ্ধে হুমকি ধমকি দিয়ে চলেছেন। কিন্তু সরকার এগুলো একেবারেই গায়ে মাখছে বলে মনে হয় না। সরকার বিএনপির দুর্বলতা বুঝে গিয়েছে। দলের নেতারা যত তর্জন গর্জনই করুন না কেন কর্মীদের মাঠে নামানোর মতো কারিশমা তাদের যে নেই এটা নানা সময়েই প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপির পক্ষে এখনই যে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব না সেটা বুঝেই সরকার বিএনপিকে আরো চাপের মধ্যে ফেলার জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।
এরমধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত। গত ২৪ আগস্ট জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রীসভা কমিটি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গেই জাতীয় জাদুঘর থেকে এই পুরস্কারের মেডেল ও সম্মাননাপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বলা হয়েছে- ইতিহাস বিকৃতি ঠেকাতে এবং উচ্চ আদালতের রায় কার্যকর করতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সরকারের এই সিদ্ধান্তে বিএনপি উদ্বেগ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছে। জিয়ার স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহার করে সরকার রাজনৈতিক সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছে বলে উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকার ঐক্যের রাজনীতিতে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে গোটা জাতিকে বিভাজনের রাজনীতিতে নিয়ে এসে বিভক্ত করে দিয়েছে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে পতাকা তুলে দিয়েছিল, মানবতাবিরোধীদের রক্ষা করেছিল। দলটির নেতারা পদে পদে প্রমাণ করেছেন যে তারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি নন।
জিয়ার স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন যতটা উত্তপ্ত হয়ে উঠবে বলে কেউ কেউ আশংকা করেছিলেন বাস্তবে তা হয়নি। বিএনপি যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সেটাও খুবই মৃদুস্বরে। জিয়া বিএনপির প্রাণ পুরুষ। তার স্বাধীনতার পদক প্রত্যাহার করে নেওয়া বিএনপির হৃদপিণ্ডে হাত দেওয়ার শামিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেছিলেন, এই ঘটনার প্রতিবাদে বিএনপি গর্জে উঠবে। আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবে। কিন্তু কার্যত দেখা গেল, মামুলি বিক্ষোভ কর্মসূচি ছাড়া বিএনপি আর কিছুই করল না।
ঢাকায় যে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে সেখানেও জমায়েত খুব বেশি ছিল না। এমনকি কেন্দ্রীয় কমিটির সবাই উপস্থিত থাকলেও জমায়েত অনেক বড় হতো। বিএনপি দরদিরা ভেবে পাচ্ছেন না, দলটির হলো কি? বিএনপির সমর্থকরাও যেন দলের কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন না? এটা কি শুধুই সরকারের নির্যাতন নিপীড়নের ভয়? জেল জুলুমের আশংকা? নাকি অন্য কিছু? বিএনপির রাজনীতিতে বড় কোনো গলদ দেখা দিয়েছে কিনা সেটা খুঁজে দেখা দরকার।
শোনা যাচ্ছে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা থেকে জিয়ার কবর সরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ্যেই এধরনের মনোভাবের কথা জানিয়েছেন। তিনি চ্যালেঞ্জ দিয়ে এটাও বলেছেন যে, জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় জিয়ার যে কবর রয়েছে সেখানে আসলে জিয়ার লাশ নেই। জিয়ার কবর সরানোর উদ্যোগ গ্রহণ করলে সেটা বিএনপি কিভাবে প্রতিহত করবে সেটা বলা মুশকিল।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, জাতীয় সংসদ ভবন সংলগ্ন চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে জিয়াউর রহমানের কবর সরালে সরকারকে ‘অনেক মূল্য দিতে হবে’। জিয়ার মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহার সরকারের ‘নিকৃষ্টতম’ সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার পদক কেড়ে নেওয়ার অর্থ তাকে অপমান করাই নয়, এই পদক কেড়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে গোটা জাতির স্বাধীনতার পদক কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বিএনপি নেতার এসব বক্তব্যকে কেউই তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বরং এসব কথা বলার মধ্য দিয়ে দলটির চরম অসহায়ত্বই প্রকাশ পাচ্ছে।
বিএনপি ভিতরে ভিতরে জ্বলছে ঠিকই কিন্তু বাইরে তার প্রকাশ ঘটাতে পারছে না। জিয়ার কবর সরিয়ে নিলেও সরকারকে চাপে ফেলার মতো কোনো কর্মসূচি বিএনপি দিতে পারবে বলে অনেকেই মনে করেন না। বিএনপি দু’একদিনের হরতাল ডাকতে পারে, ভাংচুর, জ্বালাও পোড়াও করতে পারে, কিন্তু তাতে সরকারকে টলানোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে হয় না।
অবশ্য জিয়াকে নিয়ে সরকারের এরকম টানা-হেঁচড়া করাটাও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ ভালো চোখে দেখছেন না। তারা মনে করেন, এসব করে জিয়ার প্রতি মানুষের এক ধরনের সহানুভূতি তৈরি করে দেওয়া হবে। আমাদের দেশের মানুষ সব সময় দুর্বলের পক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকে। জিয়া এখন কোনো ভাবেই রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নেই। তার একটি বড় সমর্থক গোষ্ঠি দেশে আছেন।
জিয়া বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি একজন সেক্টর কমান্ডার। তাকে বীরউত্তম উপাধি বঙ্গবন্ধু সরকারই দিয়েছিল। কাজেই তার রাষ্ট্রপতি পদ বা রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহণের বিষয়টি হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করলেও মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক তোলা অহেতুক অস্বত্বিকর পরিবেশ তৈরি করা ছাড়া আর কোনো উপকারে আসবে বলে মনে হয় না। আবার এমন কথাও বলা হয় যে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও জিয়া পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত ফসলগুলো ধ্বংস করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন। তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রদানই ছিল একটি অযৌক্তিক ব্যাপার।
লন্ডন প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী জিয়ার স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহারের সমর্থনে যুক্তি দিতে গিয়ে লিখেছেন : ‘ফ্রান্সে মার্শাল পেঁতা ছিলেন একজন নন্দিত জাতীয় বীর। ভার্দুন যুদ্ধে ফ্রান্সকে জয়ী করে তিনি ভার্দুন-বিজয়ী আখ্যা পেয়েছিলেন। ভার্দুন যুদ্ধ স্মরণে প্যারিসে একটি ভার্দুন ওয়ার মিউজিয়াম আছে সেখানে মার্শাল পেঁতার আবক্ষ মূর্তি ছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলারের কলাবরেটর হিসেবে ফ্রান্সে তাবেদার সরকারের নেতৃত্ব করায় পেঁতা পরবর্তীকালে যাবজ্জীবন জেল খেটেছেন এবং ফ্রান্সের জনগণের কাছে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। ভার্দুন ওয়ার মিউজিয়াম থেকে তার মূর্তি এবং তার সকল পরিচয়চিহ্ন ও সম্মাননাপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশে আদালতের রায়ে জিয়াউর রহমান অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর তার ভাগ্যেও পেঁতার পরিণতি ঘটা ছাড়া আর কি ঘটতে পারে? ভবিষ্যতের ইতিহাসে জিয়াউর রহমান কখনও নন্দিত পুরুষ হবেন না, হবেন নিন্দিত পুরুষ।’
জিয়াউর রহমানকে নিয়ে যে বিতর্ক রাজনীতিতে নতুন করে শুরু হয়েছে তা কোনো পরিণতির দিকে অগ্রসর হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়। পেঁতা ফ্রান্সের জনগণের কাছে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হলেও জিয়া বাংলাদেশে জনগণের কাছে সত্যি দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন কিনা তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ অবশ্যই আছে।
বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
bibhu54@yahoo. com