স্কুলে নিয়মিত হাজিরা না দেওয়া, বাড়িতে ঠিকমতো পড়তে না বসা, এসবই ছিল সেদিনের ফয়সালের নিত্য কাজের তালিকায়। সকাল-দুপুর-বিকেল কাটত কেবল দুরন্তপনায়। ফুটবলের পাশাপাশি খানিকটা ক্রিকেট খেলার জন্য সুযোগ পেলেই বাড়ির বাইরে থাকা কেশবমোড়ের সেই ছেলেটি এখন বিশ্ব ক্রিকেটের এক ঝড়ের নাম। এমন কোনো প্রতিপক্ষ নেই যারা তাকে সমীহের চোখে দেখেন না।
সাকিবের স্কুল জীবনের বন্ধু নয়ন খান জানান, মাগুরা শহরের কেশবমোড় এলাকায় বাড়ির পাশে পতিত জমিতেই চলত সাকিবের ফুটবল আর ক্রিকেটের মহড়া। তবে ক্রিকেটটাই বেশি টানত তাকে। পাড়ার ছেলেদের সাথে দল বেধে খেলার মাঝে ডুবে থাকতে যেন তার ভাল লাগত। পথে-ঘাটে, রাস্তায় যেখানেই থাকত, হঠাৎ বোলারদের মতো একটু হাত ঘুরিয়ে নেওয়া বা স্ট্রেইট-ড্রাইভের মত করে কয়েকবার ব্যাট চালানোর ভঙ্গি! যেজন্য বন্ধুরা সেই সময় সাকিবকে ‘বাগানে খেলোয়াড়’ বলে ডাকতাম।
সেদিনের ছোট্ট ফয়সালের খেলোয়াড়ি পথচলার বাঁকে একদিন দৃষ্টি পড়ে মাগুরার একমাত্র ক্রিকেট একাডেমির পরিচালক ও প্রশিক্ষক সাদ্দাম হোসেন গোর্কির। পরে ঐ একাডেমিতে তিন বছর প্রশিক্ষণ নেন সাকিব। এরপর ব্যক্তিগত নৈপুণ্য আর ধারাবাহিক সাফল্যে কেবলই এগিয়ে চলার পালা।
মাগুরা ক্রিকেট একাডেমির ক্রিকেট প্রশিক্ষক সাদ্দাম হোসেন জানান, ১৯৯৮ সালে যখন সাকিব মাগুরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র, এমন সময় সে তার একাডেমিতে আসে প্রশিক্ষণ নিতে। শৈশবেই মেধাবী তকমা পাওয়া ক্রিকেটার সাকিব সেখানে তিন বছর প্রশিক্ষণ নেয়। তার ক্রীড়া নৈপুণ্যের প্রথম প্রকাশ ঘটে বাগেরহাটে অনূর্ধ্ব-১৫ ক্রিকেট দলের হয়ে খেলতে নেমে। সেখানে ২২ রানে ৪ উইকেট নিয়ে আগমনী জানান দেয় সে। এরপর ২০০২ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের খেলোয়াড় হয়ে ঝিনাইদহে মাগুরা জেলা দলের একাদশে খেলার সুযোগ পায়। সেখানে সাকিব ১০৮ রানে নটআউট থেকে ভবিষ্যতের পথে আরেকধাপ এগিয়ে যান। সেই খেলায় কুষ্টিয়া দলকে পরাজিত করে মাগুরা জেলা দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। তাতে অনন্য অবদান ছিল সাকিবের।
এর মাঝেই ২০০১ সালে বিকেএসপি’র ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রামের বাছাইপর্বে নির্বাচিত হন সাকিব। পরবর্তীতে নড়াইলে এক মাসের বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্স চলাকালীন সময়েই নির্বাচকদের দৃষ্টিতে কাড়েন সাকিব আল হাসান ফয়সাল। যার ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালের ৬ আগস্ট জাতীয় দলে অভিষেক। এরপর কেবলই ঊর্ধ্বগামী যাত্রা।
সাকিবের ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মা শিরিন রেজা বলেন, ‘একদিন পড়তে না বসায় রেগে গিয়ে তার প্রিয় ব্যাটটি ভেঙে ফেলি। সেদিন ভীষণ কান্না করেছিল ফয়সাল! খুব কষ্ট পেয়েছিল। রাতে অভিমানী কণ্ঠে নিজের ক্রিকেট ব্যাটের প্রিয়তার কথা বোঝালো আমাকে। খুব মনে আছে সেদিনের কথা।’
মাগুরার এক সময়ের কৃতি ফুটবলার সাকিবের বাবা ব্যাংক কর্মকর্তা মাশরুর রেজা কুটিলও শোনালেন অন্যরকম এক গল্প। তিনি বলেন, ‘ছেলেকে ফুটবলার হিসেবে গড়ে তুলব এমন ইচ্ছেতেই প্রতিদিন স্টেডিয়ামে নিয়ে যেতাম। অথচ সে হয়ে গেছে ক্রিকেটার। তবে আমি যা-ই চাই না কেন, ছেলের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছি সব সময়। এখনও সেভাবেই চলছে সব।’
সব সাকিবের মত চললেও বাবার সমালোচনার মুখে পড়তে হয় বিশ্ব-নন্দিত এই ক্রিকেটারকে! মাশরুর রেজা ছেলের খেলার সমালোচনা করে থাকেন অন্যদের মতোই! সমালোচনা করেন প্রতিটি বিষয়ের। তবে মাঠে বা টিভিতে খেলা দেখেন না। জানালেন, ‘মাঠে বসে বা টিভিতে সরাসরি খেলা দেখার প্রতি আমার প্রচণ্ড অনাগ্রহ। ক্রিকেটে প্রতি বলেই থাকে অনিশ্চয়তা-উত্তেজনা। ছেলে ব্যর্থ হলে সেই উত্তেজনা অন্য সবার থেকে আমাকে বেশি আঘাত করে। যে কারণে সেই উত্তেজনা থেকে দূরে থাকতে পরে ধারণকৃত খেলা দেখে নেই।’
একটু একটু করে বেড়ে ওঠা মায়ের আদুরে সেই ফয়সাল আজকের সাকিব হয়ে উঠে ধারাবাহিক নৈপুণ্যে ক্রিকেট দুনিয়ার আলোচিত ব্যক্তিত্ব। দেশ-বিদেশের ক্রিকেট বিশ্লেষকদের আলোচনায় নিয়মিতই উঠে আসে তার নাম। লাল-সবুজদের গৌরবের চরিত্র। ব্যাট-প্যাড তুলে রাখার আগে নিশ্চিতভাবেই পৌঁছে যাবেন আরো অনেক অজানা শিখরে।