এই পঙ্গপালের প্রথম কাজ হচ্ছে সুন্দরবনকে নিয়ে সেন্টিমেন্ট তৈরি করা। আর রামপালের পক্ষে যারা বলে তাদের চরিত্র হনন করা। গালি দেওয়া। এদের রাজনৈতিক পরিচয় কি—এই নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। এদের কিছু অংশকে বলা হচ্ছে ‘বামাতি’ বা জামাত এবং বামের মিশ্রণ। সাধারণত উগ্র বামদের বুঝাতে এই টার্মটি চালু হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতে।
আমার পরিচিত বাম পার্টির সমর্থক বন্ধুরা রামপাল নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসছিলেন। শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদকালের শেষ দিক থেকেই দেখে আসছিলাম এটা। আমি তাদেরকে সমর্থন দেইনি তবে বিরোধিতাও করিনি কখনও। কারণ বিষয়টিতে ওদের ব্যাক্তি স্বার্থ খুবই কম- এটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছি এবং এখনও করি। কিন্তু লক্ষ করলাম হঠাৎ করে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া রামপালের বিরোধিতা করায় রামপাল বিরোধী এবং সুন্দরবন প্রেমীর আবির্ভাব ঘটেছে ফেইসবুকে এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায়। পঙ্গপালের মতো।
আমি দীর্ঘ সময় নিয়ে ওদের ফেসবুক পর্যবেক্ষণ করেছি। এই পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে রাজকারমার্কা বিএনপি, নিরপেক্ষতার ভাণ ধরা চুপা বিএনপি-জামাতি, চরম বাম বা বামাতি, শিবির সমর্থক এবং ফরহাদ মজহার-মাহমুদুরকে মহাজ্ঞানী বুদ্ধিজীবী ভাবা গোষ্ঠি নতুন করে রামপাল বিরোধী এবং সুন্দরবন প্রেমী সেজেছে। বামেরা যে রামপাল বিরোধী আন্দোলন করছিল বছরের পর বছর, ওরা কিন্তু তখন ছিল না পাশে। কারণ তারা জানে বামদের দিয়ে হবে না। তাদের আসল উদ্দেশ্য সরকারকে অস্থির করা, সেটা খালেদা জিয়ার পেট্রোল বোমায় সম্ভব না হলেও খালেদাকে সঙ্গে নিয়ে চেষ্টা চালালে ‘সুন্দরবন বটিকা’ খাইয়ে এখন হয়তো সম্ভব। কারণ এই বটিকায় লোকজনকে বিভ্রান্ত করা খুবই সহজ। এটা একটা সুগারকোটেড মিশন। আফটারঅল সুন্দরবন বলে কথা। ভারত এলার্জিতো লোকের আগে থেকেই আছে।
এইসব কথিত সুন্দরবন প্রেমীদের প্রধান কাজ ভূয়া, কল্পিত, ধ্বংসপ্রাপ্ত সুন্দরবনের ছবি বানিয়ে প্রচারণা চালানো। ফেসবুকে সুন্দরবন বাঁচান নামে পেইজ খোলা অথবা তার সদস্য হওয়া। সেখানে নানা রকম পোস্ট করা যার সঙ্গে সুন্দরবনের সম্পর্ক বা রামপালের সম্পর্ক না থাকলেও হয়। তবে রামপালের পক্ষের লোকদের চরিত্রহরণমূলক পোস্ট দিলে সমস্যা নেই। কারণ ওইসব পেইজ-এর বেশিরভাগ এডমিন আগে বাঁশের কেল্লার টাইপ পাতার এডমিন ছিল। এইসব পেইজে সত্যিকারের সুন্দরবন প্রেমী নেই সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে তারা যে বিভ্রান্তির শিকার, সেটা হয়তো তারা এখনও উপলব্ধি করছেন না। যেমন হেফাজতিরা লাখ লাখ মানুষ মারার প্রচারণা চালিয়ে অনেক সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল, এটা সেই স্টাইলের আরেকটি প্রচারণা, হতে পারে লোকগুলো বিপরীত রাজনৈতিক বিশ্বাসের।
আরেকটা জিনিস দেখলাম, এদের সিংগভাগ নিজের ফেসবুক, টুইটারে প্রোফাইলের ছবি হিসেবে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে আছে এমন কাল্পনিক ছবি দিয়ে রেখেছে। কেউ কেউ হারিকেন। কাভার ফটো হিসেবেও সুন্দরবন একটা মোক্ষম হাতিয়ার ওদের। আবার অনেকের প্রোফাইলে আগেও নিজস্ব কোনও ছবি নেই। থাকলেও এমনভাবে আছে যাতে বুঝা যায় না তার ছবি না সুন্দরবনের কোনও জানোয়ারের ছবি। নিজেকে মহা তাত্ত্বিক, বুদ্ধিজীবী, ভাবুক সম্প্রদায় বোঝানোর জন্য শেয়ার করা কিছু পোস্টও আপনি তাদের টাইমলাইনে দেখবেন- যেগুলো সার্বিক বিবেচনায় আবর্জনা। এরা দারুণভাবে ‘লাইক’ কাতর সম্প্রদায়। আপনি ওদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ না করেন বা আনফ্রেন্ড করেন, ব্লক মারেন- তাহলে আপনি বিপদ আরও বাড়ালেন।
এদের বেশিরভাগ শেখ হাসিনাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেওয়া পার্টি, বঙ্গবন্ধুকে শেখ মুজিব বলে তৃপ্ত থাকা পার্টি, এরা কেউ কেউ জঙ্গিবাদের সমর্থক আবার কেউ কেউ জঙ্গিবাদ ধ্বংস হোক চান কিন্তু জঙ্গি হিসেবে যারা মরছেন তাদেরকে জঙ্গি ভাবতে সন্দিহান। এরা অনেকে কিন্তু লাগিয়ে ‘আমিও যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই’ বলা পার্টি। এরা যুদ্ধাপরাধের বিচারে খুশী কিন্তু শেখ হাসিনা না থাকলে এই বিচার সম্ভব হতো না বলতে লজ্জা পান।
মূলত বামদের উপর ভর করে বা জাতীয় কমিটির আড়ালে রামপাল বিরোধিতায় যোগ দেওয়া এই পার্টিগুলো যত না সুন্দরবনপ্রেমি তার চেয়ে বেশি শেখ হাসিনা বিদ্বেষী, সরকার বিদ্বেষী। সে কারণে আনু মুহাম্মদ যখন বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় অনাগ্রহ প্রকাশ করেন তখন অসুস্থ আনু মুহাম্মদকে হাসপাতালে খালেদা জিয়ার দেখতে যাওয়া ছবি প্রকাশ করে উনাকে অকৃতজ্ঞ বলে গালি দেয় ওরা।
বামদের সঙ্গে বা জাতীয় কমিটির সঙ্গে সুন্দরবনের এইসব ভূয়া প্রেমিকদের যে আবির্ভাব ঘটেছে জাতীয় কমিটি কি এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছ? কথা হচ্ছিল একজন বাম নেতার সঙ্গে এটা নিয়ে। তিনি বললেন, ‘আমরা জানি বিষয়টা। এটাও জানি ওদের বিপ্লব ল্যাপটপ আর মোবাইলে। আর সুন্দরবন নিয়ে প্রোফাইল সাজানোতে। ওরা যদি আমাদের আন্দোলনে আসতো—সরকারের টনক অনেক আগেই নড়তো। দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হওয়ার আগেই আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতো।’ সর্বশেষ সাইকেল র্যা লিতে উপস্থিতিও প্রমাণ করে এরা সবাই ‘কিউট বিপ্লবী’।
সর্বশেষ বলবো, রামপাল প্রকল্প বিরোধিরা যুক্তি শুনতে নারাজ। উনারা যুক্তি খণ্ডনের চেয়ে সুন্দরবন নামে বাংলাদেশের একটি প্রাকৃতিক সম্পদকে সেন্টিমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করতে আগ্রহী। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, ওরা এতই বিকলাঙ্গ চিন্তা করে যে, ওরা ভাবে দেশপ্রেমের খনি ওদের হাতে। যারা রামপালের পক্ষে তাদের কোনও দেশপ্রেম নেই। যারা তাদের কথা শুনছেন না তারা ‘দালাল’। কিসের দালাল সেটা আবার বলেন না। কারণ এতে যদি আবার তার রামপাল বিরোধিতার আড়ালে সরকার বিরোধিতা এবং জামাতি, বামাতি পরিচয় প্রকাশ পায়, অথবা ভারত বিরোধিতার কারণে তিনি যে দীর্ঘদিন ধরে মাননিক অসুস্থতায় ভুগছেন- সেটা যদি প্রকাশ পেয়ে যায়, এই ভয়ে।
আনিস আলমগীর : সাংবাদিক ও শিক্ষক
anisalamgir@gmail.com