হুমায়ুন আজাদের এই বক্তব্যের সবটুকুই বাস্তবে ঘটেছে এবং প্রায় ঘটছে। ধর্ষণে সেঞ্চুরি করে তা উদযাপনের নজিরও রয়েছে এদেশে। কারা কীভাবে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, সে সম্পর্কে বিশদভাবে বলার চেষ্টা করলেও শিশুদের ধর্ষণ সম্পর্কে কিছু বলেননি অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তিন বছরের শিশু থেকে সত্তর বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত।
গত ১৮ তারিখ দিনাজপুরে মাত্র পাঁচ বছরের এক শিশুকে যে আদিম বর্বরতায় ধর্ষণ করা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা একেকজনের কাছে এক এক ধরনের হতে পারে। হতে পারে তা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিচ্ছবি, মানসিক বৈকল্যের প্রতিফলন বা ন্যূনতম মূল্যবোধহীন দানবীয় মানসিকতার বিকৃত রুচি, হতে পারে হাতের মুঠোয় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে ইচ্ছে হলেই যত্রতত্র পর্নো ছবি উপভোগের বিরূপ প্রভাব এটি কিংবা হতে পারে একটা ক্ষয়িষ্ণু সমাজের নানা অনুষঙ্গ এর পেছনে কাজ করছে। কিন্তু বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে সবকিছুর মূল বললে কী বেশি বলা হবে? শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য বলছে, চলতি বছর প্রথম ছয় মাসে ধর্ষিত হয়েছে ২৩৫ জন শিশু। গণধর্ষণের শিকার ৩৩ শিশু। এর মধ্যে ২৪ জন প্রতিবন্ধী শিশুও রয়েছে। শিশুর প্রতি এ ধরনের সহিংসতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। বন্ধতো দূরের কথা, বরং তা বাড়ছে আরও নারকীয় তাণ্ডবে।
ক্রিকেটার শাহাদাৎ হোসেনের গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তার হ্যাপীকে অমানবিক নির্যাতনের পরও তাকে হতে হয় বৈরি সাক্ষী। গরম খুন্তির ছ্যাঁকার দগদগে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে শিশু হ্যাপীকে বলতে হয় ‘আসামিরা আমাকে কোনো রকম খুন্তির ছ্যাঁকা দেয়নি’। বিচারটি চলমান বিধায় এর চেয়ে বেশি মন্তব্য এখানে করতে পারলাম না। শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হবে কী-ভাবে? দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ কোথায় আমাদের সামনে? সিলেটে রাজন আর খুলনার রাকিব হত্যা মামলার বিচার খুব দ্রুত গতিতে হয়েছে, একথা সত্য। তবে সেই বিচারের রায় এসেছে নিম্ন আদালতের মাধ্যমে, উচ্চ আদালতে মামলায় দুটি এখনো বিচারাধীন। আর যেটুকু হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার, প্রতিবাদের পরই। প্রচার আর প্রতিবাদের বিষয়ে বিপরীত দৃষ্টান্তও রয়েছে। প্রতিবাদে রাজপথ কেঁপে উঠলেও তনু ধর্ষণ ও হত্যার বিচারের কিছু হয়নি। চলতি বছরের মার্চ মাসে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় তাকে ধর্ষণ ও হত্যার পর আসামিরা খুব সহজে পালিয়ে যেতে পারে। তারপর তাদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায় না কিংবা খোঁজার চেষ্টা করা হয় না। কেনো হয় না, অনুমান করা খুব কষ্টের কিছু নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সব স্তরের মানুষের তীব্র প্রতিবাদের পরও ওই ঘটনার মামলার কোনো অগ্রগতি আমাদের চোখে পড়ে না। গত বছর চলন্ত মাইক্রোবাসে রাজধানীতে গারো উপজাতীয় এক মেয়েকে গণধর্ষণের বিচারের কী হল? আশ্বস্ত হওয়ার মতো জানা যায়নি কিছুই। এগুলো দু-একটি উদাহরণ মাত্র। এরকম অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে চোখের সামনে। আবার সব ঘটনা আলোচনায়ও আসে না। এ মাসে পঞ্চগড়েও তিন বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা, গাজীপুর, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, কোনটার উদাহরণ দেব? সব বিষয়ে এক কলমে লেখা সম্ভব নয়।
ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধ কেবল বাংলাদেশে নয়, অন্যান্য দেশেও কম-বেশি ঘটছে। কিন্তু সেখানে অপরাধীর বিচার হয়। কেবল বিচার কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতকরণ নয়, অভিশপ্ত এই অপরাধ থেকে প্রতিকারের পথ খোঁজার চেষ্টা করা হয়। ধর্ষণ স্বাভাবিক কোনো অপরাধ নয়। এটি সমাজে আরো নানা রকম অপরাধের জন্ম দেয়, ভুক্তভোগী পরিবারকে যেমন নানা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে চলতে হয়, পুরো সমাজকেও অস্থিরতার মধ্যে ফেলে। বিষয়টি অনুধাবন করেই ইন্দোনেশিয়ায় যৌন নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের রাসায়নিক উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে নপুংসক করা হবে বলে একটি অধ্যাদেশ জারি হয়েছে। মাত্র কদিন আগে গেলো ১৯ অক্টোবর দেশটির প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো এই অধ্যাদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন। এতে বলা হয়েছে শিশুদের যৌন হয়রানি করলে এখন থেকে যৌন নির্যাতনকারীকে রাসায়নিক উপাদান দিয়ে নপুংসক করে দেওয়া হবে। শুধু তা-ই নয়, ওই নির্যাতনকারী যখন জেল থেকে মুক্তি পাবেন, তখনো তার শরীরে ইলেক্ট্রনিক তদারকি যন্ত্র লাগানো থাকবে, যাতে একই কাজ তিনি আর করতে না পারেন। পোল্যান্ড, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যসহ আরো বেশ কয়েকটি দেশে এ ধরনের শান্তির ব্যবস্থা রয়েছে।
দুই দশক আগে ১৯৯৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার গণতান্ত্রিক সরকার ‘প্রমোশন অব ন্যাশনাল ইউনিট এন্ড রিকনসিলিয়েশন অ্যাক্ট-৩৪/১৯৯৫’ নামে পার্লামেন্টে একটি আইন পাশ করে। সংক্ষেপে ‘টিআরসি’ নামে ট্রুথ এন্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ এর কাজের পদ্ধতি ছিল একটি আদালতের মতো। কমিশনের ঘোষণায় এমনটাই বলা হয়েছে যে, খুনের ক্ষমা আছে, ধর্ষণের নেই। অপরাধ স্বীকার করলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে খুনিকেও ক্ষমা করা যেতে পারে। তাকে সংশোধনেরও সুযোগ দেওয়া যেতে পারে কিন্তু ধর্ষণকারীর ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়। কঠিন শাস্তি তাকে পেতেই হবে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি বিচার বহির্ভূত যে কোনো হত্যাকাণ্ডেরই পক্ষে নই। কিন্তু আমার নিজ সন্তান পাঁচ বছরের ‘সত্তা’র সমবয়সী আর এক সত্তাকে যে নারকীয় তাণ্ডবে ধর্ষণ করা হল, ফুলের মতো সুগন্ধি নরম শরীর ক্ষত বিক্ষত করলো যে নরপিশাচ, তার শাস্তিও কি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হবে? না, স্বাভাবিক/ অস্বাভাবিক কোনোটাই চাই না আমি। যাকে আটক করা হয়েছে, তাকে নিয়ে সরাসরি হাজির করা হোক হতভাগা শিশুটির কাছে। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জিজ্ঞেস করা হোক, ওই ব্যক্তিই তাকে ব্যথা দিয়েছে কি-না? যদি উত্তর হয় ‘হ্যাঁ’, সঙ্গে সঙ্গেই ফায়ার…। এদেশে ক্ষমতাসীনদের প্রয়োজনে কত জটিল আইনইতো রাতারাতি প্রণয়ন করা হয়েছে, কার্যকর করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কেন এমন একটি সময়োপযোগী আইন করা যাবে না? আমি আইনের ছাত্র নই, আইন ভালো না বুঝলেও কোনো কোনো প্রশ্নের যৌক্তিক ব্যাখ্যা বোধ হয় আইন বিশেষজ্ঞরাও দিতে পারবেন না। একটি শিশুকে ধর্ষণের আসামি সাইফুলকে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার কি প্রয়োজন রয়েছে। নিষ্পাপ শিশুটির ইশারাতে কিংবা কোনো প্রকার ইঙ্গিতেও যদি বেরিয়ে আসে সে ধর্ষক, তারপর আর কী প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে অতিরিক্ত কোনো জিজ্ঞাসাবাদের। কি বের করা হবে রিমান্ডে? সরকারবিরোধী কোনো রাজনৈতিক বা চরমপন্থি কোনো সংগঠন এই ঘটনার পেছনে কাজ করেছে কি-না? এর পেছনে কী কী উদ্দেশ্য কাজ করেছে? কতবার ধর্ষণ করা হয়েছে? কী প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে?!! শুধু কার্যকর কোনো আইন কিংবা আইনের প্রয়োগের দুর্বলতার কথাই বা কেন বলছি? ধর্ষণের বিরুদ্ধে তেমন কোন সাংগঠনিক প্রতিবাদ বা রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো কর্মসূচিও চোখে পড়ে না। যেটুকু হয়, নেহায়েতই আনুষ্ঠানিকতা।
খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও আর একটি বিষয় এই লেখায় উল্লেখ করতে হচ্ছে। নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন দিনাজপুরে ধর্ষিতা ওই শিশুটিকে নিয়ে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তার একটি লেখায় বলেছেন, “মেয়েটি হিন্দু পরিবারের মেয়ে। তার জীবনে যা ঘটলো, তা দেখে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, অনেক হিন্দু পরিবার তাদের কন্যার নিরাপত্তার কথা ভেবে দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেবে”। অনেকে ফেসবুকেও এ ধরনের মন্তব্য করছেন। ভেবে হোক আর না ভেবে হোক, এ ধরনের কথা সাম্প্রদায়িক উস্কানি হিসেবে কাজ করে বলে আমার মনে হয়। এদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক নির্যাতন যে বিভিন্ন সময়ে হয়েছে এবং হচ্ছে, এ কথা সত্য। কিন্তু সব বিষয়কে অতি সরলীকরণ করাটা অবশ্যই ঠিক নয়। অসংখ্য মুসলিম শিশুও এ ধরনের বর্বরতার শিকার হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যে জঙ্গি হামলাগুলো সংঘটিত হয়েছে, সে সময়ও অনেকে বিশেষ উদ্দেশ্যে বলার চেষ্টা করেছেন, শুধু হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে। সেটিও মোটেই সত্য নয়। সত্য এই যে, পুরো বাংলাদেশই তখন আক্রমণের লক্ষ ছিল বা এখনো হয়তো রয়েছে।
শিশু ধর্ষণ, হত্যা নির্যাতনের কোনো খবর সামনে এলেই, আমার নিজ সন্তানের নিষ্পাপ মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে অনবরত। হয়তো সব বাবা ও মার চোখেই তা ভেসে ওঠে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে নিরাপত্তার কথা ভেবে। ভয়ে আঁতকে উঠি, শিউরে উঠি। এসব বাবা-মায়েরা নিশ্চয় খুব সাধারণ মানের। কিন্তু যারা অসাধারণ, বিচারের দণ্ড যাদের হাতে, আইন প্রণয়নের ক্ষমতা যাদের হাতের মুঠোয়, সেই অসাধারণ বাবা-মায়েদের মনে কি নিজ সন্তানের মুখ ভেসে উঠে না কখনও, না-কি তাদের প্রতি হৃদয়ের গভীরে মমত্ববোধের যথেষ্ট অভাব রয়েছে? নইলে কেন এমন হবে?
লেখক : সাংবাদিক