সু চি কি ট্রাম্প? : মেহেদি রাসেল

 In খোলা কলাম

পৃথিবী এখন অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক সংকটের মধ্য দিয়ে কাল অতিবাহিত করছে। উগ্র ডানপন্থীরা কয়েকটি দেশে গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকার গঠন করেছে। এর মধ্যে বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত যেমন আছে, তেমনি আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ক্ষমতাবান রাষ্ট্রও। জনগণই ভোট দিয়ে এসব ডানপন্থী এবং উগ্র ভাবমূর্তিসম্পন্ন নেতাদের ক্ষমতায় বসাচ্ছে।

তাহলে, বলাই যায় পৃথিবীব্যাপী সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটছে সমস্ত নিয়মকানুন মেনেই। এসব নির্বাচনের পর অবশ্য এটা প্রমাণ হয় না যে, ওই সব দেশের বেশির ভাগ মানুষই সাম্প্রদায়িক। কেননা ভোটের হিসেব বরাবরই জটিল। এ ছাড়া, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনমানুষের সামনে যখন খারাপ ও অতি খারাপ এ রকম মাত্র দুটো বিষয়মাত্র থাকে বেছে নেওয়ার জন্য, তখন তাদেরই বা কী করার থাকে।যেসব দেশ সাম্প্রদায়িক নেতাকে বেছে নিয়েছে তাদের সরকারপ্রধান হিসেবে সেগুলোকে আমরা আগেভাগেই চিহ্নিত করে অনুমান করতে পারি যে সেখানে সাম্প্রদায়িক সমস্যা বেড়ে যাবে। তবে যেসব দেশে সেরকম সাম্প্রদায়িক নেতারা ক্ষমতায় নেই তাদের বেলায় আমাদের অনুমান কী হবে? আমরা কি ধরে নেব সেখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা ভালো থাকবে?

যদিও হিসেব তেমনটিই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মৌলবাদী এবং অসাম্প্রদায়িক দুই ধরনের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বেলায় তেমন একটা ফারাক আমাদের চোখে পড়ছে না। তাহলে ওই যে আপ্তবাক্য, ‘যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ’ -এটি সবার বেলাতেই সত্য?

বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার দুটি দেশেই প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক বলে পরিচিত দল বর্তমানে ক্ষমতায়। এ দুই দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন কি বন্ধ হয়েছে? নাকি সেটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে? যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং সংবাদমাধ্যমের কারণে বর্তমান সময়ে যেকোনো তথ্যই খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের ঘটনাটি এখন আর কারোরই অজানা নয়। দুটো ঘটনাতেই ক্ষমতাসীন দলের লোকদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসনের গাফিলতির কথাও বলা হয়েছে। নাসিরনগরে তো রীতিমতো প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে করা সমাবেশ থেকে হামলার উসকানি দেওয়া হয়। তড়িঘড়ি করে সেখানকার কিছু কর্মকর্তার রদবদলও এসব অভিযোগের সত্যতার দিকেই ইঙ্গিত করে। উপরন্তু একবার দুবার নয় সেখানে সাতবার হামলা হয়েছে। সমাবেশ যারা করেছিল প্রশাসন তাদের চেনে। প্রশাসন কিন্তু সেই লোকদের আটক করেনি। তাদের আইনের আওতায় নেয়নি। ফলে, সুবিচারের আশা দূর-অস্ত।

সম্প্রতি সরকার সেখানে সিসি ক্যামেরা বসাচ্ছে। উদ্যোগটি ভাল। তবে ক্যামেরা আসলে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর অপরাধীকে শনাক্ত করতে সাহায্য করবে। এ ধরনের অপরাধ যেন আবার না ঘটে তার জন্য সরকার কি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে? সেখানকার মানুষের মধ্যে যে চাপা আতঙ্ক সেটা কাটাতে কি সরকার কোনো কিছু করছে? প্রকৃত অপরাধীদের আটক করছে? ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর যা হয় তাতে আক্রান্তের ক্ষত নিরাময় হয় না। তাই আগে থাকতেই এসব ঘটনা যাতে না ঘটে তার ব্যবস্থা করা উচিত।

নাসিরনগরের ঘটনার মূল কারণ স্থানীয় আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব। বিবিসি-র এক রিপোর্টে পুলিশের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানানো হয়েছে। (বিবিসি অনলাইন, ১৪ নভেম্বর, ২০১৬) অর্থাৎ, সংখ্যালঘু জনগণ কতটা অরক্ষিত হলে তাদের দাবার গুঁটির মত ব্যবহার করা যায়। নিজেদের গণ্ডগোলের বলি তাদের করা যায়। এ যেন ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’।

আবার, গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ওপর হামলায় উল্টো সাঁওতালদের নামেই মামলা হয়েছে। ক্ষমতাবান লোকেরা তাদের হত্যা করল, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে উচ্ছেদ করল, পরে মামলা করে হয়রানি করল। তারা কার কাছে বিচার চাইবে। নাসিরনগরে হিন্দুদের ওপর হামলায় আমরা প্রতিবেশী দেশের অনেকের কাছ থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করতে শুনেছি, কিন্তু সাঁওতালদের ওপর হামলায় কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করেননি।

বাস্তবিকভাবে সাঁওতালদের ওপর নির্যাতনের মাত্রাটি বেশি এবং তাদের পাশে দাঁড়াবারও কেউ নেই। তারা এতটা অসহায় যে, যারা তাদের হামলা করেছে, তাদের কাছ থেকেই সাহায্য নিতে বাধ্য হচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য। গোবিন্দগঞ্জে চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা মোট জমির পরিমাণ ১ হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর। সেখানকার মাত্র ১০০ একর জমিতে বসতি নির্মাণ করে সাঁওতালরা থাকতেন। সেটুকুও তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে হলো। ক্ষমতাবানদের এ নিষ্ঠুরতা যদিও নতুন কিছু নয় তবু মানুষের সভ্যতায় এত অগ্রগতির পরও এসব ঘটনা যেন আমাদের নিজেদের অসভ্যতাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।

আরেক অসাম্প্রদায়িক নেতার দেশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা জলের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে । সহিংসতা থেকে বাঁচতে তারা ছোট ছোট নৌকায় নাফ নদীতে ভেসে আছে দিনের পর দিন। দেশে ফিরলে সেনাবাহিনী তাদের হত্যা করবে। আর বাংলাদেশে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তারা তাদের ফেরত পাঠাবে সেই বধ্যভূমিতে, যেখানে তাদের অভ্যর্থনার জন্য অপেক্ষা করে আছে সেনাবাহিনীর বুলেট।

এসব আশ্রয়প্রার্থীর বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এদের মধ্যে অনেকেই আহত। রাষ্ট্রীয় সহিংসতার দগদগে চিহ্ন তারা বয়ে বেড়াচ্ছে তাদের শরীরে। ‘আরেক রোহিঙ্গা নারী বলেন, এখানে পুলিশ কিংবা বিজিবির হাতে ধরা পড়লে তারা মিয়ানমারে ফেরত পাঠাবে। তখন রাখাইন সেনারা তাদের গুলি করে মারবে। তার চেয়ে বাংলাদেশে মরলে অন্তত জানাজা পাওয়া যাবে।’ (সূত্র: প্রথম আলো, ২৩ নভেম্বর, ২০১৬) এই জনগোষ্ঠীর জীবন যেমন অনিশ্চিত, মৃত্যুও তেমনি নিশ্চিত নয়।

কী এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে তারা! সেনাবাহিনীর স্থল অভিযানের পর রোহিঙ্গাদের ওপর এখন আক্রমণ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে হেলিকপ্টার ও গানশিপ। যেসব এলাকায় আক্রমণ করা হচ্ছে সেখানে মানবাধিকার কর্মী, ত্রাণ বা চিকিৎসা সহায়তা দেওয়ার জন্যও কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। পালিয়ে আসা লোকজনের কাছ থেকে কেবল ঘটনার ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে অসহায় শরণার্থীরা ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারত সরকার তাদের আশ্রয় দিয়েছিল। সেসময় সেই অসহায় মানুষের যে অবস্থা ছিল, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্ব তার চেয়ে কম নয়। আর, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে তাদের বাংলাদেশে আগমন ঠেকানো পুরোপুরি সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ আশ্রয় না দিলে হয়তো নাফ নদীতে এদের সলিলসমাধি হবে, নয়তো নিজ দেশে সেনাবাহিনীর হাতে এরা মারা যাবে। যেহেতু চোরাপথে, সীমান্তরক্ষীদের নজর এড়িয়ে এদের আসাটা রোধ করা পুরোপুরি সম্ভব নয় (স্থানীয়রা এদের অসহায়ত্ব দেখে অনুপ্রবেশে বাধা দিচ্ছে না, ক্ষেত্রবিশেষে সাহায্যও করছে), তাই এদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আশ্রয়ণের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। সে ক্ষেত্রে শরণার্থীদের প্রকৃত হিসেব অন্তত সরকারের কাছে থাকবে।

শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া নেত্রী অং সান সু চি তাদের জন্য কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছেন না। শান্তির সপক্ষ শক্তি হিসেবে বিশ্বে যিনি এক পরিচিত নাম, তার কোনো ভূমিকাই আমরা দেখি না তার নিজের দেশের বিপন্ন মানবতাকে বাঁচাতে। কী ভীষণ নির্বিকার তিনি। তাঁর এ নীরবতা বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হচ্ছে।

এ রকম নীরবতা শান্তিতে নোবেল পাওয়া একজন নেতার ভাবমূর্তির সঙ্গে বেমানান। ট্রাম্পসহ অন্যান্য মৌলবাদী কট্টরপন্থী নেতাদের কাছ থেকে এগুলো প্রত্যাশিত হতে পারে কিন্তু সু চির কাছ থেকে নয়। আমরা কি শুধু ট্রাম্পের সমালোচনা করব নাকি অসাম্প্রদায়িকতার মুখোশ পরে থাকা অন্যদের ভেতরে বসবাসকারী ট্রাম্পের মুখোমুখি দাঁড়াব?

মেহেদি রাসেল : সাংবাদিক, গল্পকার ও কলামিস্ট।
mehedirasel32@gmail.com

সূত্র : পরিবর্তন.কম।

Recent Posts

Leave a Comment