আষাঢ়ে গল্প

 In শিল্প-সাহিত্য

|| তাপস রায় ||
বাংলায় বারো মাসই আষাঢ়। ভরা ভাদ্রে, ফাল্গুন-চৈত্রে আষাঢ়ে গল্প শোনেননি এমন লোক এ বঙ্গে মিলবে না। যিনি যেভাবে পারছেন বলছেন। বলতে বলতে গলছেন, গলিয়ে দিচ্ছেন। বিনা বৃষ্টিতেই ভিজে যাচ্ছেন কেউ কেউ।

এ মাটিতে বিনা মেঘে বজ্রপাত বারো মাস! এ আকাশ থেকে পরার মতোই ব্যাপার। জেনে বুঝে ওঠার আগেই ধরায় এসে ধারার চক্করে পড়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। সেই চক্কর থেকে বাঁচতে দু’পক্ষই মরিয়া। অথচ অভাগার দায় স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও নেন না। ভবিষ্যত পরিকল্পনা করছেন আপনি, তিনি আড়ালে বসে মুচকি হাসছেন। সেই ভাবনায় বারো মাস মাথা চুলকাচ্ছেন কেউ কেউ। আপনি ভাবছেন খুশকি- উহু তা নয়। এও এক আষাঢ়ে গল্প!

 

 

মানছি, বর্ষা আপনার প্রিয় নয়। আপনার চৈতন্যজুড়ে চৈত্রের তাপ। আপনার মন ভেজায় সাধ্য কার? তারপরও ভজন সাধন আপনাকেও করতে হয়। নইলে ঢলে আপনাকেও যে ভেসে যেতে হবে তা আর এমন কি! জানেন তো, ঢলাঢলি সব সময় কাজে আসে না।

ধরে নিচ্ছি, এই ঢলাঢলি, গলাগলিতে আপনি নেই। আপনার জ্বলজ্বলিও কম, বলা যায় জলাঞ্জলিই দিয়েছেন সব- জয় বাবা লাইনের লোক। ভেতরটা রসালো আম, বাইরেরটা আমসত্ব বানিয়ে রেখেছেন। অন্যরা ধরতে পারছে না। ধরতে পারলেই এই বর্ষায় বিনে বড়শিতে মাছ ধরার আনন্দে তারাও মেতে উঠবে। তাই বলছি, সাধু সাবধান! আমাদের বারো মাসই আষাঢ়।

 

 

আমার জীবনে প্রথম আষাঢ় আসে ঘর-বাড়ি ভাসিয়ে দিয়ে। তুমুল বৃষ্টি হয়েছিল সেবার এবং একটানা। আর তাতেই আমাদের একতলার টানা বারান্দা তলিয়ে গেল। সকালে বাবার ডাকে ঘুম ভাঙল। স্কুলে যেতে হবে ভেবে দু’চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। সে অবশ্য প্রতিদিনের জলজ্বালা। কিন্তু তাতে সরস্বতী ভিজত না।

ওদিকে মা চেঁচিয়েই যাচ্ছেন- কই গো, এবার ঘর যে জলে ডুববে!

ব্যাপার কি? চোখের জল মুছে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি- ওমা! শুধু জল আর জল। গলগল করে খুশিতে বুকটা ভরে গেল। সিক্সথ সেন্স সাঁই করে কানে কানে বলে গেল, আজ আর কেউ স্কুলে যেতে বলবে না।

আমি বিছানা থেকে সটান সেই জলে নেমে গেলাম। উল্টেপাল্টে, লম্ফেঝম্ফে নাওয়া হয়ে গেল সেই সকালবেলাতেই। মা এসে কান ধরে টেনে দোতালায় তুলে দিলেন। আমার মুখটাই শুকিয়ে গেল দোতালার বারান্দা শুকনো দেখে।

 

 

এ আষাঢ়ে গল্প নয়। এ হলো আষাঢ় মাসের গল্প। এবার তাহলে আষাঢ়ে গল্প বলি। একদিন স্যার ক্লাসে ঢুকে সবাইকে আষাঢ়ে গল্প লিখতে দিলেন।

আমি ভেবে মরি, কী লিখব? বড়দি বিকেল হলেই বান্ধবীদের নিয়ে ছাদে যায়। দূর থেকে দেখি তাদের একে অপরের ওপর ঢলে ঢলে পড়া, চুরির ক্রমাগত রিনিঝিনি শব্দ। তাদের কপাল থেকে এলো চুল সরানোর দৃশ্য দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নামে। তবুও গল্প ফুরায় না।

ঠাম্মা, ঠোঁট ওল্টান- এতো কি সারাক্ষণ ঘুসুর ঘুসুর ফুসুর ফুসুর অ্যাঁ!

তাতে তাদের গায়ে যেন বাতাস লাগে। গল্পের ঢল আরো তীব্র হয়। একদিন কি হলো, নেই কোনো ফিসফাস, করে না তো ঢুসঢাস- তিনবান্ধবী দেখি ত্রিমূর্তি হয়ে ছাদে বসে আছে। আছে তো আছেই। এই ঘটনা লিখব কিনা যে, তিনটি সমবয়সী মেয়ে একসঙ্গে চুপচাপ বসে আছে। আষাঢ়ে গল্প হিসেবে এটা ভালো হবে?

আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ অবশ্য একবার বলেছিলেন- মহিলাদের নিয়ে মুশকিল এই যে, এরা আলাপ-আলোচনায় অপটু, অথচ কথা বলার শক্তি হারান না। কিন্তু সেদিন তারা কি কারণে কথা বলার শক্তি হারালেন এ রহস্য হয়েই রইল। রহস্য ভেদের উপায়ও ছিল না। কারণ কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না।

 

 

আমার মনে আরেকটি গল্প উঁকি দেয়। এক বয়স্ক লোক অনেক দিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে গেলেন। তিনি যে রুমে থাকতেন সেই রুমের দরজায় নক করতেই এক তরুণ দরজা খুলে দিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি এই রুমে থাকতাম- ভদ্রলোক বললেন। রুমটা দেখতে পারি?

অবশ্যই। আসুন।

তরুণের অনুমতি নিয়ে ভদ্রলোক রুমটার চারপাশ দেখতে দেখতে আপন মনেই বলে উঠলেন, সেই পুরনো দরজা, পুরনো জানালা; সেই পুরনো বেড আজও আছে!

হঠাৎ ভদ্রলোক খেয়াল করলেন, রুমের কোণায় চেয়ারে এক তরুণী বসা। তরুণ অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ও আমার কাজিন। নোট নিতে এসেছে।

ভদ্রলোক মুচকি হেসে বললেন, আর সেই পুরনো আষাঢ়ে গল্প!

 

 

স্যার টেবিলে ঠাস ঠাস দু’বাড়ি মেরে পুনরায় ঘোষণা দিলেন- পুরনো গল্প হলে হবে না। বি ক্রিয়েটিভ। থিঙ্ক মোর ক্রিয়েটিভলি।

অর্থাৎ ভাবতে হবে। ভাবনা জ্ঞানীর কাজ। ও পানির মতো সহজ নয়। ভেবে ভেবে নতুন গল্প লিখতে হবে। নইলে স্যার নাম্বার দেবেন না। আমি জানি, এই কথাটি আপনার কাছে আষাঢ়ে গল্পের মতো মনে হতে পারে। কেননা আপনারা শুনেছেন, স্যারেরা আজকাল নাম্বারের ঝুরি নিয়ে বসে থাকেন। চিকিৎসক যেমন রোগের পুরোটা না শুনেই ঘ্যাচঘ্যাচ কলম চালান, শিক্ষকরাও তাই- উত্তরপত্র পুরোটা পড়ার আগেই খসখস কলম চালিয়ে দেন। দশে শূন্য দশ, হয়ে থাক বশ। মন্ত্রণালয় খুশি, ছাত্র খুশি, শিক্ষক খুশি, অভিভাবক ব্যাটা খুশি না হয়ে যাবে কোথায়?

এই তো গত বছর, আমাদের মহল্লারই ছেলে ছাইদুল জিপিএ-৫ পেল। এই খুশির খবর সে যখন দুলতে দুলতে এসে আমাদের জানাল আমরা দোটানায় পড়ে গেলাম। দুষ্টু ছেলেরাই তবে রটিয়েছিল, ছাইদুল নাকি প্রি-টেস্টে কর গুনে গুনে ঐ পাঁচ বিষয়েই ফেল করেছিল!

যাই হোক, এ কথা শুনে প্রেসার ফল করল মহল্লার অনেকের। ফাহমিদা ভাবী তো এখনও ধাতস্থ হতে পারেননি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। ঘটনা কী?

 

 

ঘটনা হলো। আমাদের হাতে মিষ্টির প্যাকেট দিয়েই ছাইদুল সেদিন দৌড়ে গিয়েছিল ফাহমিদা ভাবীর ফ্ল্যাটে। দুপুরবেলা। বাসায় কেউ নেই। ভাবী তখন শাওয়ার নিচ্ছিলেন। একবার, দুইবার, তিনবার কলিং বেল বাজতেই ভাবী বিরক্ত হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে পিপহোল দিয়ে দেখলেন, পাশের ফ্ল্যাটের ছাইদুল দাঁড়িয়ে। তিনি শরীরে টাওয়েল পেঁচিয়ে বাম হাত দিয়ে ধরে ডান হাতে দরজা খুললেন।

কী ব্যাপার ছাইদুল?

আন্টি, এই মিষ্টিগুলো রাখেন। মা পাঠিয়েছে।

কিসের মিষ্টি?

আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি।

এরপরের ঘটনা ভয়াবহ। ফাহমিদা ভাবী এ কথা শুনে এতটাই বিস্মিত হয়েছিলেন যে, টাওয়েল ছেড়ে দুই হাত মুখে চাপা দিতে বাধ্য হন। এতে তার মুখ বন্ধ হয়েছিল বটে কিন্তু তিনি মারাত্মক  মুখরোচক সংবাদে পরিণত হয়েছিলেন। সমবয়সীরা তো বটেই, বড় ভাইরাও ছাইদুলকে ডেকে জানতে চাইতেন- এই কী দেখেছিলি, বল না, বল না।

না বলে উপায় ছিল না। কারণ ওই বল। বল প্রয়োগের আগেই ছাইদুল এক টিকেটে তাদের দুই ছবি দেখিয়ে দিত। ফাহমিদা আন্টির ওই অবস্থা দেখে ড্রইং রুম থেকে ছুটে এসেছিল ফাল্গুনি আপু। আপু যেই না উবু হয়ে টাওয়েল তুলতে গেছে অমনি ওড়নাটা …।

শ্রোতারা তখন যে যার মতো কল্পনায় উড়ছে। কেউ ধরতেই পরছে না, দুপুরে বাসায় যদি কেউ না-ই থাকে তাহলে ফাল্গুনি এলো কোত্থেকে?

এই হলো আষাঢ়ে গল্প। এখানে দুয়ে দুয়ে চার না মিললেও চলে। কাহিনির যোগ, বিয়োগ ওসব মেলামেলির ব্যাপার গোয়েন্দা গল্পের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

 

 

তাই বলে যা ইচ্ছা তাই বলবে?

না, ঠিক তা নয়। আমি ভাবি কিন্তু যুৎসই আষাঢ়ে গল্প মনে পড়ে না। অথচ কি আশ্চর্য প্রতিদিন কত গল্পের মুখোমুখি হচ্ছি। কত সত্যকে গল্প ভেবে ভুলে যাচ্ছি। কত গল্পকে সত্য ভেবে কপাল চাপড়াচ্ছি। ফেইসবুকে ফ্যানা উঠে যাচ্ছে। এসএমএস করে লাইক চাচ্ছি। ইউটিউবে লাখ লাখ লাইক পড়ছে। বগল বাজাচ্ছি। সেই দৃশ্যও এক সময় ডিলিট হয়ে যাচ্ছে। আসছে নতুন গল্প, নতুন ফ্যানা, নতুন লাইক। স্পষ্টতই প্রতিনিয়ত মুখোমুখি দুই পক্ষ- লাইক, ডিজলাইক। একে অপরের দিকে আঙুল তুলে সারাক্ষণ বলে যাচ্ছে- তুই আষাঢ়ে, তুই আষাঢ়ে। আহারে কেউই আর গল্পের গভীরে যেতে রাজি নয়।

চারপাশে মশার মতো গিজগিজ করছে অঘটনঘটনপটিয়সী। এই একুশ শতকে ফিরে এসেছে সেই দিন! ত্রৈলোক্যনাথের ডমরুধর যেবার সুন্দরবন গিয়েছিল জমি কিনতে সেবার তিনি ভয়ঙ্কর এক জাতের মশার খপ্পড়ে পড়েছিলেন। মনে পড়ে? যে মশাগুলো ভাগ করে নিত- এ তোর বাবু, এ আমার বাবু।

এ কালেও তাই। খোদ রাজধানীতে। এক মশা সকালে কামড়াচ্ছে চিকুনগুনিয়া হচ্ছে। আরেক মশা বিকেলে কামড়াচ্ছে ডেঙ্গু হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, সাধারণ মশারা ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামে গেছে তাই আপাতত মা মা করে ম্যালেরিয়া থেকে মুক্তি। কিন্তু দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মিলছে না। বৃষ্টি নামলেই রাস্তায় হাঁটুপানি। পান থেকে চুন কিনলেই ভ্যাট। বছর ঘুরলেই আয়কর, পৌরসভার হোল্ডিং ট্যাক্স, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস- কত বিল যে কিলবিল করে খোঁচাচ্ছে! উল্টো গ্যাসও এখন শিখে গেছে বিদ্যুৎয়ের মতো ছলাকলা।

স্কুলে বাচ্চা রেখে একজন আরেকজনকে বলছে, ভাবী আপনাদের বাসায় সব সময় গ্যাস থাকে?

হ্যাঁ, থাকে।

শুনে হিংসায় অন্যজনের পেট ভর্তি অম্বল। শুকনো হেসে বলেন, অ। মনে মনে ভাবেন- মিথ্যুক। আমাদের সব গল্পই এভাবে আষাঢ়ে গল্প হয়ে যায়। আমাদের তাই বারো মাসই আষাঢ়।

Recent Posts

Leave a Comment