সালমানের জন্য ন্যায়বিচার

 In প্রধান খবর, বিনোদন

বিশেষ সংবাদদাতাঃ

সালমান শাহ মারা যান ১৯৯৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, ২৫ বছর বয়সে। মৃত্যুর আগে মাত্র চার বছরে তিনি বাংলা সিনেমাকে একা এমন একটি ভাষা দিয়েছিলেন যে, কৃষক থেকে অধ্যাপক সবাই তাকে আপন করে নিয়েছিলেন, ভালোবেসেছিলেন। সালমানকে দেখার পর আপনি বলতে বাধ্য ছিলেন, “এ তো আমির বা সালমান খান নন, এমনকি শাহরুখ খানও নন, উনি তো লিওনার্দো ডি’ক্যাপ্রিও।” আরেকজন হয়তো বলতেন, ‘আরে না, তিনি ডি’ক্যাপ্রিও নন, তার চেয়েও অসাধারণ!’ সালমান আমাদের চোখে ছিলেন মেগাস্টার।

তিনি একা বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন এবং কোটি তরুণের মন থেকে বলিউডের প্রভাব দূর করেছিলেন। ১৯৯৩ সালে তার প্রথম সিনেমা কেয়ামত থেকে কেয়ামত মুক্তি পাওয়ার পর তিনি তরুণদের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন। সালমান মোট ২৫টি সিনেমায় কাজ করেছেন, যার সবগুলোই বাংলাদেশে ব্লকবাস্টার। শুধু এ সাফল্যের কারণেই তার নাম ডি’ক্যাপ্রিওর পরে উচ্চারিত হতে পারে। সালমানের সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারে একটি অবিস্মরণীয় দিক হচ্ছে, তার প্রভাব। তার প্রভাব এতটাই গভীর ছিল যে, দর্শকরা কেবল সালমানের সিনেমা দেখে আনন্দ পেতেন তা নয়, বরং প্রতিবারই সিনেমায় তার চরিত্রগুলোর ভক্ত হয়ে ঘরে ফিরতেন। এমন একটি চরিত্র ছিল রাজ, যা কিছুটা ছিল শেক্সপিয়ারের রোমিও চরিত্রটির প্রতিচ্ছবি। রেশমির মৃত্যুতে শোকে বিধ্বস্ত রাজ (সালমান) ছুরি দিয়ে আত্মহত্যা করে, ঠিক যেমনটা জুলিয়েটের মৃত্যুর পর রোমিও করেছিল।

সিনেমায় রাজের এ মৃত্যু দেখে সেদিন কেউ কল্পনাও করতে পারেননি যে, চার বছরের মাথায় সালমান মারা যাবেন। সালমানের মৃত্যু নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব ডালপালা গজিয়েছে। এসবের মধ্যে আছে, তার মৃত্যুর পেছনে স্ত্রী সামিরা, মোস্তাক (সামিরার প্রেমিক), রাবেয়া সুলতানা রুবি, আজিজ মোহাম্মদ ভাই (যিনি সালমানের স্ত্রীকে এক হোটেলে সবার সামনে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলেন), লতিফা হক লাকি, রিজভী আহমেদ ও আশরাফুল হক ডনের হাত থাকার অভিযোগ। সামিরা ও তার ঘনিষ্ঠরা যদিও সালমানের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে দাবি করেছেন। সালমানের মা-বাবা কামরুদ্দীন ও নীলা চৌধুরী, তার ভাই সাহারান ইভান দাবি করেন যে, সালমান খুন হওয়ার পর সামিরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লুকিয়েছেন এবং রুবি চৌধুরীর ছোট সন্তানকে দিয়ে প্রমাণ সরিয়ে ফেলেছেন। সালমানের মা-বাবা হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন, কিন্তু ময়নাতদন্ত ও পুলিশের প্রতিবেদনে কোনো প্রমাণ দেখানো ছাড়াই সালমান আত্মহত্যা করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। চলতি মাসের ১৩ তারিখ টাইম টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে রুবি জানিয়েছেন, সামিরা তার ভাই ও অন্যদের ব্যবহার করে সালমানকে হত্যা করেছেন।

শুধু তার অভিনয়ের কথাই বললে সালমান কেন দুনিয়ার সেরা মানুষদের একজন এবং তার অভিনয় কেন বাংলাদেশে এত প্রভাবশালী, সে বিষয়টিকে চেপে যাওয়া হবে। সালমান যা করেছেন, তা খুব কম অভিনেতাই তাদের জীবনে করতে পেরেছেন। সালমান একটি বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন: তিনি দেখতে ভিন্ন, ভিন্নভাবে কথা বলতেন এবং তার পোশাক-আশাকও ভিন্ন ছিল। এমনকি তার চুলের স্টাইলও অন্যদের চেয়ে ভিন্ন ছিল। ১৯৯৪ সালের শেষ নাগাদ, আমিসহ বাংলাদেশের তরুণরা তার মতো কথা বলার স্টাইল, পোশাক পরতে চাইতাম। সালমান এমন প্রাণশক্তি নিয়ে অভিনয় করতেন যে, তা বাংলাদেশ থেকে বলিউডের প্রভাব মুছে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। সালমানের অভিনয়ের স্টাইল, স্বর, তার সবকিছু আপনি ভালোবাসবেনই। তিনি কোটি কোটি বাঙালির মনের ডি’ক্যাপ্রিও।

সালমান তার সিনেমার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ঝড় তুললেও ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরের মানুষের কাছে অজানাই রয়ে গেছেন। অবশ্যই সিনেমা কেবল স্বীকৃতির বিষয় নয়। বাংলাদেশে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার বিষয়টি দুর্লভ। সালমান তার ওপর অর্পিত দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করেছিলেন, অর্থাত্ অভিনয় করেছিলেন। ফলে তার নাম বাংলা সিনেমার গৌরবের সমার্থক হয়ে গেছে। তার অভাব বাংলাদেশীরা বিভিন্নভাবে অনুভব করে। তিনি তরুণদের বিশেষত ভারতীয় সিনেমায় অভ্যস্ত ছাত্রদের দেখিয়েছিলেন যে, একজন বাঙালি অভিনেতা শাহরুখ, আমির বা সালমান খানের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হতে পারেন। সালমান শাহ দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতাদের একজন হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। পেশাগত জীবনে বিপুল সাফল্য পাওয়া সত্ত্বেও তিনি তার স্ত্রী সামিরার সঙ্গে সম্পর্কটি মসৃণ রাখতে পারেননি।

১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আমার বাবা আমাকে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে যেতে বললেন। আমি আপত্তি জানিয়ে বলেছিলাম, ‘আমি আমেরিকা যাব না, কারণ সেখানে সালমান শাহ নেই।’ বাবা সেদিন আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিলেন। ‘সালমান শাহ আর নেই। ঢাকার ইস্কাটনে বাসায় ফ্যান থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।’— খবরটি যেদিন প্রকাশিত হয়েছিল, সেদিন সারা রাত আমরা কেঁদেছিলাম। অনেক তরুণ সালমানের মৃত্যুর বেদনা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিল। আমিও সেই বেদনা সইতে না পেরে বাংলাদেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি বাবাকে বলেছিলাম, যে দেশ তার সবচেয়ে জনপ্রিয় সন্তানকে রক্ষা করতে পারে না এবং তার হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে আগ্রহী নয় বলে মনে হয়, সে দেশে আমি থাকতে চাই না।

২০ বছর পার হয়ে গেছে, সালমানের হত্যাকারীরা এখনো বিচারের আওতায় আসেনি। কারণ তারা অনেক ক্ষমতাবান। আমি জানতাম, একদিন সব সত্য উন্মোচিত হবে। ৯ আগস্ট আমি প্রিন্সটনে একটা ক্লাস নিচ্ছিলাম। ক্লাসের শেষ দিকে আমার স্ত্রীর কাছ থেকে একটা বার্তা পেলাম। তাতে লেখা: ‘সালমান আত্মহত্যা করেনি। তাকে হত্যা করা হয়েছিল। রুবি তার ফেসবুকে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে এটা স্বীকার করেছে।’ আমি ক্লাসের শেষে ভিডিওটি দেখে কলম ধরার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ রুবি বলেছেন, সালমান হত্যার প্রমাণ গায়েব করার জন্য তারা তার ছোট ভাইকেও হত্যা করেছে। ১৩ আগস্ট টাইম টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাত্কারে রুবি বলেছেন, ‘সালমানকে হত্যা করেছিল আমার স্বামী জ্যান লি চান, আমার ভাই রুমি ও সালমানের স্ত্রী সামিরা হক। আরো কয়েকজন সঙ্গে ছিল।’ রুবি আরো দাবি করেছেন যে, তিনি তার ছোট ছেলেকে ব্যবহার করে সালমান হত্যার প্রমাণ ধ্বংস করেছেন। তিনি আরো দাবি করেছেন, সামিরা ও তার দলবল তার ভাই রুমিকেও হত্যা করেছে সব প্রমাণ মুছে ফেলতে। আমি সবসময়ই জানতাম যে, সালমান আত্মহত্যা করেননি। সামিরা ও তার সহযোগীরা তাকে হত্যা করেছে। ১৯৯৪ সালে একবার সামিরা চট্টগ্রামে সালমানের বুকে ছুরি চালিয়েছিল। সালমান তাকে আরেকবার সুযোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু সামিরা বিশ্বাসঘাতকের মতো হোটেলে আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে চুমু খায়। সালমান রেগে গিয়ে আজিজকে চড় মারেন, কিন্তু সামিরাকে আবারো সুযোগ দেন। সামিরা সালমানকে হত্যার দ্বিতীয় চেষ্টায় সফল হয়েছেন। দড়ি, তার বা বেল্ট থেকে ঝুললে উল্টো ভি-এর মতো একটা ক্ষত থাকবে। কিন্তু সালমানের শরীরে এমন কোনো ক্ষত ছিল না। আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ জানাই, যেন তিনি বেশকিছু সন্দেহজনক বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সালমানের মৃত্যুর বিষয়ে পুলিশকে নিরপেক্ষ তদন্তের নির্দেশ দেন।

Recent Posts

Leave a Comment