শরণার্থীদের ব্যাপারে ইসলাম কী বলে?
শরণার্থী শব্দটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে উপকূলে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা নিষ্পাপ আয়লানের গাঢ় নীল রঙের প্যান্ট, লাল গেঞ্জি ও কেডস পরা নিথর দেহের ছবি। ভেসে ওঠে নাফ নদীতে কচুরিপানার মতো ভেসে যাওয়া ছেঁড়াফাড়া লাশ। রাস্তায় টেনে হিঁচড়ে জীবন্ত পুতে ফেলা কোনো রোহিঙ্গার ছবি। তবে শরণার্থীদের ধারাবাহিকতা একবিংশ কিংবা বিংশ শতাব্দির নতুন কিছু নয়।
হজরত মুসা (আ.)একত্ববাদের দাওয়াত প্রদান ও মজলুমের পাশে দাঁড়াবার কারণে হিজরত করে মাদায়েনের শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকেও শরণার্থী হতে হয়েছিল। শরণার্থী হয়ে মধ্যযুগের মুসলিম পণ্ডিতরা ইউরোপে ছড়িয়ে গিয়ে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বীজ বুনেছিলেন। কানাডার অভিবাসনমন্ত্রী আহমেদ হোসেনও ১৯৯৩ সালে সোমলিয়া থেকে শরণার্থী হয়ে কানাডায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।
পৃথিবীর অনেক আলোকিত মানুষকেই শরণার্থী হতে হয়েছে। এমনকি আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মাদও (সা.) হিজরতের বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। একদিকে ঘর বাড়ি, নিজ এলাকার মায়া অন্যদিকে ঈমান। ঘর বাড়ি বাঁচাতে হলে ছাড়তে হয় ঈমান। আবার ঈমান বাঁচাতে হলে ছাড়তে হয় ঘরবাড়ি। ঈমান বিজয়ী হলো।
ঈমান নিয়ে তিনি আল্লাহ তাআলার নির্দেশে মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করলেন। কিন্তু মক্কার পবিত্র কা’বার ছবিই ছিল তার হৃদয়জুড়ে। মক্কার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল।
মক্কা ছেড়ে মদিনার পথে রওয়ানা হওয়ার এ চরম সময়েও তিনি বারবার পেছন ফিরে মক্কাকে দেখেছিলেন আর বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! হে মক্কা, নিশ্চই তুমি সবচেয়ে প্রিয় ও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থান। আমাকে যদি এখান থেকে বের করে না দেয়া হতো আমি কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’ (জামে তিরমিজি: ৫/৭২২)।
আজকের রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও একই বাস্তবতার মুখোমুখি। ঈমান এবং ইসলামের কারণেই তারা নিজেদের হাজার বছরের ভিটায় আজ ‘পরবাসী’। ভিটেমাটি, ফসলের বিস্তীর্ণ মাঠ, ব্যবসা বাণিজ্য, লাখো-কোটি টাকার সম্পদ ছেড়ে বাংলাদেশে এসে সামান্য খাবারের জন্য লাইন ধরতে হচ্ছে।
বর্তমান পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ শরণার্থী। ২০১৬ সালে প্রদত্ত জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে ৬ কোটি ৫০ লাখ শরণার্থী রয়েছে। (দৈনিক ইত্তেফাক: ২০ জুন, ২০১৬)। এর সঙ্গে প্রায় ৫ লাখ শরণার্থী যোগ হয়েছে এক বছরে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সংঘাত, মুসলমানদেরকে ভিটেমাটি ছাড়া করে তাদের দেশেগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নিতে দখলদারদের আক্রমণ এর বড় কারণ। ঈমান রক্ষার জন্য দেশত্যাগ ইসলামে বৈধ।
পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছে তাদের প্রাণ কেড়ে নেয়ার সময় ফেরেশতারা জিজ্ঞেস করবে, তোমরা সেখানে কেমন ছিলে? তারা বলবে, আমরা তো পৃথিবীতে দুর্বল ছিলাম। ফেরেশতারা বলবে, কেন, আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিল না? তোমরা হিজরত করতে।’ (সুরা নিসা: ৯৭)।
তবে মানবতার ধর্ম ইসলামের দৃষ্টিতে কাউকে শরণার্থী বানানো চরম অন্যায়। ইসলাম কাউকে বাস্তুচ্যুত করার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন আমি তোমাদের অঙ্গীকার নিলাম যে তোমরা পরস্পর খুনোখুনি করবে না এবং নিজেদের দেশ থেকে বহিস্কার করবে না, তখন তোমরা তা মেনে নিয়েছিলে এবং সাক্ষ্য দিয়েছিলে। অতপর তোমরাই পরস্পর খুনোখুনি করেছ এবং তোমাদের এক দলকে দেশে থেকে বহিস্কার করেছ। … তাদের বহিস্কার করাই তোমাদের জন্য অবৈধ ছিল।’ (সুরা বাকারা : ৮৪-৮৫)।
আবার এর বিপরীতে অত্যাচারের শিকার হয়ে কেউ শরণার্থী হয়ে গেলে তাকে আশ্রয় প্রদানের ব্যাপারে উদার মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে মাথায় রেখে সাম্প্রদায়িক সীমাবদ্ধতার উর্দ্ধে উঠে কোনো শরণার্থীকে ‘মানুষ’ হিসেবে মানবিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে তাকে আশ্রয় প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম।
তবে আশ্রয় প্রদানের নিয়মে মুসলিম ও অমুসলিমে কিছুটা ভিন্নতা আছে। কোনো মুসলিম নিজ দেশ ছাড়া অন্য কোনো ইসলামী রাষ্ট্রে আশ্রয় চাইলে তাকে আশ্রয় প্রদান করা সে রাষ্ট্রের জন্য আবশ্যক। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের কাছে ধর্মের ব্যাপারে সাহায্য চাওয়া হলে সাহায্য করা তোমাদের ওপর আবশ্যক।’ (সুরা আনফাল : ২৭)।
মুসলিম শরণার্থীকে আশ্রয় প্রদান ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য আবশ্যক। অমুসলিম শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানে ইসলামের নীতির নাম ‘আমান’। ইসলামের দৃষ্টিতে ‘আমান’ হলো মুসলিম দেশের শাসক ও নাগরিক কর্তৃক অমুসলিম দেশের কোনো অমুসলিম নাগরিককে নির্ধারিত সময়ের জন্য নিরাপত্তা প্রদান করা।’
সাধারণভাবে অমুসলিম শরণার্থীরা আশ্রয় পাবে এক বছরের জন্য। এরপর আরো বেশি সময় আশ্রয় গ্রহণ করতে চাইলে মুসলিম দেশের ‘অমুসলিম নাগরিকদের আইন ও বিধান’ মেনে সে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু যদি আশ্রিত ব্যক্তি সে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা করে বা রাষ্ট্র অথবা মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তাহলে সে আর আশ্রয় পাবে না। (ফিকহুস সুন্নাহ)।
শরণার্থী নীতিতে ইসলাম সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে নারী ও শিশুর নিরাপত্তার ক্ষেত্রে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, কোনো মুমিনা (বিশ্বাসী) নারী হিজরত করে তোমাদের কাছে এলে তোমরা তার পরীক্ষা নাও। আল্লাহ তাদের ঈমান সম্পর্কে ভালো জানেন। তাদের ঈমানদার পেলে আর তাদেরকে কাফেরদের কাছে ফিরিয়ে দিও না।’ (সুরা মুমতাহিনা: ১০)।
নারী ও শিশুকে আশ্রয় প্রদানের বৃহৎ প্রশ্নে প্রয়োজনের প্রচলিত চুক্তি ও অঙ্গীকার ভেঙ্গে হলেও তা করতে হয়। হুদায়বিয়ার সন্ধিতে মক্কা থেকে কেউ মদিনায় এলে তাকে মক্কায় ফিরিয়ে দেওয়ার শর্ত ছিল। বেশ কয়েকজন পুরুষ সাহাবি মদিনায় এলে তাদেরকে মক্কায় ফিরিয়ে দেওয়াও হয়। কিন্তু যখন একজন নারী যখন মদিনায় আশ্রয় নিতে চান তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আয়াত নাজিল করে তাকে আশ্রয় দিতে বলেন। (ইবনে কাসির: ৮/৯১)।
শুধু শরণার্থী নীতি নয়, ইসলামের যুদ্ধনীতিতেও নারী ও শিশুদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’ শ্লোগান ইসলামই মানবতাকে প্রথম শুনিয়েছে। যুদ্ধ না করে সন্ধি কিংবা বিকল্প মাধ্যমে শান্তি চেয়েছে। নবীজি (সা.) এরশাদ করেন, ‘হে লোকেরা! তোমরা শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার প্রত্যাশা করো না। বরং আল্লাহর কাছে পরিত্রাণ চাও। এর পরেও যদি শত্রুর সম্মুখীন হয়ে পড় তবে সবুর ধারণ করবে।’ (বুখারি: ৩/১১০১; মুসলিম: ৫/১৪৩)।
এতদসত্বেও প্রতিপক্ষের আক্রমণাত্মক মনোভাবের ফলে একান্তই যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়লেও বেসামরিক লোকজন, শিশু ও নারী হত্যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এক যুদ্ধে মুশরিকদের একটি শিশু নিহত হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তা শুনে খুবই মর্মাহত হন। তিনি বলেন, ‘এ শিশুরাও তোমাদের চেয়ে উত্তম। সাবধান! শিশুদের হত্যা করো না।’ (মুসতাদরাকে হাকিম: ২/১৩৩)।
নবীজি (সা.) এর এক যুদ্ধে জনৈক মহিলার লাশ পড়ে থাকতে দেখে মর্মাহত হয়ে রণাঙ্গণে নারী ও শিশুদের হত্যা সম্পূর্ন নিষেধ করে দিলেন। (বুখারি: ৩/১০৯৮; মুসলিম: ৫/১৪৪)। হত্যার ব্যাপারে কঠোর নীতি অবলম্বন করার কারণেই রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সবগুলো যুদ্ধ মিলেও শত্রু মিত্রের প্রানহানির সংখ্যা ১ হাজারের কিছু বেশি।
কোনো ঐতিহাসিকের মতেই তা দুই হাজার ছাড়ায়নি। অথচ সভ্যতার দাবিদারদের দুটি বিশ্বযুদ্ধে নিহত হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষ। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ৩৬ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা হারিয়েছি ত্রিশ লাখ মানুষ।
শরণার্থীদের ব্যাপারে ইসলাম উদার। তবে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানই শেষ সমাধান নয়। ঈমান, জীবন ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তার জন্য দেশত্যাগের অনুমতি দিলেও নিজের দেশকে শত্রুমুক্ত করে তাতে ফিরে যেতেই উৎসাহ দেয় ইসলাম। হজরত মুসা (আ.) আল্লাহ তাআলার নির্দেশে মাদায়েন হিজরত করলেও মাদায়েন থেকে নিজ দেশে ফিরে এসেছিলেন।
মহানবী হজরত মুহাম্মাদও (সা.) ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের সফল অভিযানের মাধ্যমে মক্কাকে স্বাধীনতার অধিকার হরণকারী জালেমদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে দেশত্যাগী (মুহাজিরদের) জন্য মক্কায় ফিরে যাবার মতো নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করেছিলেন।