মিয়ানমার সরকারের কথায় আস্থা নেই রোহিঙ্গাদের

 In প্রধান খবর, লিড নিউজ

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখতে পারছে না। রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, মিয়ানমার সরকার বরাবরই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে আসছে।

গত ২৫ আগস্ট নতুন করে সংঘাত শুরু হওয়ার পর প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে এসেছে। জাতিসংঘ বলে আসছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনে জাতিগত নিধন চালাচ্ছে।

তবে মিয়ানমার সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে এবং তারা দাবি করছে, তারা ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা যদি মিয়ানমারের ‘বৈধ কাগজপত্র’ দেখাতে পারে তাহলে তারা রাখাইনে ফেরত যেতে পারবে। বাংলাদেশের সঙ্গে করা ১৯৯৩ সালের চুক্তি মোতাবেক এই কাজ সম্পন্ন হবে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে সোমবারের বৈঠকে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অফিসের মন্ত্রী টিন্ট সোয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের বিষয়েও একমত পোষণ করে দুদেশ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে একটি চুক্তির খসড়াও হস্তান্তর করা হয়।

ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, মিয়ানমার ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে তা স্পষ্ট নয়।

মিয়ানমারের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল নিউ লাইটকে উদ্ধৃত করে মার্কিন সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ‘বাংলাদেশে ঢুকার জন্য রাখাইনের পশ্চিমাঞ্চলের দুই গ্রামের মধ্যবর্তী সীমান্তের কাছে এখনো ১০ হাজারেও বেশি মানুষ জড়ো হয়েছে।’

গ্লোবাল নিউ লাইট তাদের প্রতিবেদনে দাবি করেছে, কর্তৃপক্ষ পালিয়ে যেতে চাওয়া রোহিঙ্গাদের বারবার আশ্বস্ত করতে চাইছে যে, ‘রাখাইনে তারা এখন নিরাপদ’। তা সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা ‘নিজেদের ইচ্ছায়’ বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

তবে ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের নিজস্ব অনুসন্ধানের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, গ্রামবাসী ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভুগছে। বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা ক্রমাগত তাদের হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।

‘নিজেদের গ্রাম থেকে রাখাইনের বৌদ্ধ অধ্যুষিত গ্রামগুলো পেরিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছে রোহিঙ্গারা’ এএফপিকে বলেছেন রোহিঙ্গা অ্যাডভোকেসি গ্রুপ আরাকান প্রজেক্টের একজন প্রতিনিধি ক্রিস হ্যারিস।

তিনি জানান, গ্রামপ্রধান যদি গ্রাম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন, সঙ্গে সঙ্গেই সমগ্র গ্রামবাসী সেই সিদ্ধান্ত মেনে গ্রামশূন্য করে পালিয়ে যায়।

টিন্ট সোয়ে বাংলাদেশকে বলেন, তারা ১৯৯৩ সালের চুক্তি অনুসারে সেই প্রক্রিয়ায় শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত। ওই চুক্তি অনুযায়ী ১৯৯০ দশক ও ২০০৫ সালে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ফিরে যায়।

কয়েকদিন আগে একই প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো নেতা স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি।

তবে শরণার্থী ও মানবাধিকার গ্রুপগুলো জানায়, এই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া যেই নথির উপর করা হবে সেগুলো বেশিরভাগ রোহিঙ্গারই নেই। যেখানে অর্ধেকেরেই বেশি রোহিঙ্গা গ্রাম সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অনেককে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, সেখানে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছে কিভাবে কাগজপত্র থাকতে পারে।

পাশাপাশি গত কয়েক দশক ধরেই নাগরিকত্বসহ মৌলিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলিমরা।

এদিকে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে গেলে যে আবারো হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হবে না এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছে না তারা। মিয়ানমার সরকারের প্রস্তাবে আস্থা নেই রোহিঙ্গাদের। কারণ নিয়মিতই প্রতিশ্রুতি ভেঙে এসেছে দেশটির সরকার।

আনোয়ারা বেগম নামে ৫৫ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা নারী সরকারের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করেন না। কারণ এ নিয়ে তিনি তৃতীয়বার রাখাইন থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন।

আনোয়ারা ১৯৭৮ সালে সামরিক অভিযান শুরু হলে সেখান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। একবছর পর আবার রাখাইনে ফিরে যান। ১৯৯১ সালে তিনি আবার সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচেন। পরে ১৯৯৪ সালে আবার ফেরত গিয়েছিলেন। পঞ্চাশ পেরিয়ে আসা এই নারী গত মাসে আবার বাংলাদেশে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসেন।

আনোয়ারা বেগমের সাফ কথা, ‘আমি ফেরত যেতে চাই না। আমি সরকারকে বিশ্বাস করি না। কারণ প্রতিবার সরকারের কথায় ফেরত গিয়ে দেখি তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে না।’

প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের জাতিগত নিধনযজ্ঞে পাঁচ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নিহত হন। জীবন নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা। আগে থেকেই বাংলাদেশে অবস্থান করছে বাস্তুচ্যুত তিন লাখ রোহিঙ্গা।

Recent Posts

Leave a Comment