বড় সংকটে জনতা ব্যাংক
• অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্যে জনতা ব্যাংকের অবস্থা কিছুটা ভালো ছিল
• ১০ বছরের বেশির ভাগ সময় ব্যাংকটিতে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ
• এ কারণে অনেক নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান বড় অঙ্কের ঋণ পেয়েছে
• ঋণের বড় একটি অংশই এখন ফেরত আসছে না
• কমে যাচ্ছে আমানত, বড় অঙ্কের লোকসান
নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক এখন বড় সংকটে। ব্যাংকটিকে এখন টাকা ধার করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। বড় ধরনের লোকসানেও পড়েছে।
অথচ সরকারি ব্যাংকগুলোতে বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্যে জনতা ব্যাংকের অবস্থা কিছুটা ভালো ছিল। দেশের কয়েকটি ভালো শিল্প গ্রুপকে অর্থায়নের মাধ্যমে শিল্পায়নে বড় ভূমিকা রেখেছিল ব্যাংকটি, এ কারণে সুনামও ছিল। এ ছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সংকটকালে টাকাও ধার দিয়ে আসছিল।
ব্যাংকটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, গত ১০ বছরের বেশির ভাগ সময়ই জনতা ব্যাংকে রাজনৈতিক বিবেচনায় চেয়ারম্যান, পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ হয়েছে। এ কারণে অনেক নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান বড় অঙ্কের ঋণ পেয়েছে। এর বড় একটি অংশই এখন ফেরত আসছে না। বর্তমান এমডির ভাবমূর্তি নিয়েও প্রশ্ন আছে। এসবের প্রভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আমানতের সুদহার কমানোর সরকারি সিদ্ধান্ত। এ কারণে ব্যাংকটির আমানতে টান লেগেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘জনতা তো ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিল। এর আড়ালেই অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এত দিন চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতি গোপন অসুখের মতো। একসময় প্রকাশ পাবেই।’ তিনি বলেন, তদারকির অভাবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো খারাপ হচ্ছে, যা একসঙ্গে প্রকাশ পেলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে।
জনতা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সরকারি সিদ্ধান্তে আমানতের সুদহার কমানোর কারণে আমানত তুলে নিচ্ছে গ্রাহকেরা। এ ছাড়া এননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপকে অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়া বড় অঙ্কের ঋণ আটকে গেছে।
এননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির ঋণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অনিয়মের কারণে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটি ব্যাংক খাতের একক ঋণের বৃহত্তম কেলেঙ্কারি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
এ ছাড়া ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর প্রায় পুরোটাই খেলাপি করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে ক্রিসেন্ট লেদারের ৬৩৭ কোটি টাকা, রূপালী কম্পোজিটের ৬৫০ কোটি টাকা, লেক্সকো লিমিটেডের ৪১০ কোটি টাকা, ক্রিসেন্ট ট্যানারির ১৫৮ কোটি টাকা ও রিমেক্স ফুটওয়্যারের ৮৭২ কোটি টাকা। তবে সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার সুবিধা পেয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ।
বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ায় গত জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ৯ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২২ শতাংশ। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় গত জুন শেষে বড় অঙ্কের লোকসানে পড়ে ব্যাংকটি। জানুয়ারি-জুন সময়ে ব্যাংকটির লোকসান হয় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। মূলত খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে গিয়েই লোকসানে পড়ে ব্যাংকটি। ২০১৭ সালে জনতা ব্যাংকের নিট মুনাফা ছিল ৯৭ কোটি টাকা। এর আগের বছরে ২৫১ কোটি টাকা মুনাফা করে ব্যাংকটি।
ব্যাংকটির তারল্যসংকটের কথা তুলে ধরে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি দিয়েছেন জনতা ব্যাংকের এমডি আবদুছ ছালাম আজাদ। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ১ জুলাই থেকে আমানত ও ঋণের সুদহার যথাক্রমে ৬ ও ৯ শতাংশ কার্যকর করা হয়। এ কারণে ক্রমান্বয়ে ব্যাংকের আমানত কমতে থাকে। এতে জুলাই ও আগস্ট মাসে ২ হাজার ৬১২ কোটি টাকা আমানত কমে যায়। আমানত কমে যাওয়ায় ব্যাংকটি তারল্যসংকটে পড়ে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে হচ্ছে। এসব দিয়ে নগদ জমার হার (সিআরআর) সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। গত ২৬ আগস্ট ২ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা ধার করে ব্যাংকটি।
জনতা ব্যাংক সূত্র জানায়, গত জুন শেষে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ৬৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে তা প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা কমে গেছে।
সার্বিক বিষয়ে জনতা ব্যাংকের এমডি আবদুছ ছালাম আজাদ ১৬ সেপ্টেম্বর নিজ কার্যালয়ে বলেন, ক্রিসেন্ট ও এননটেক্স গ্রুপের ঋণ ঠিক থাকলে ব্যাংক ভালো থাকবে। কারণ, তাদের হাতে অনেক টাকা। তাদের সমস্যা হলে ব্যাংকও সমস্যায় পড়বে। এর বেশি কিছু বলতে তিনি রাজি হননি।