চাঁদপুরে অনুমোদনহীন শতাধিক আবাসিক মহিলা মাদ্রাসা! শিক্ষার্থী নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
রিয়াজ শাওন :
চাঁদপুর জেলার অলিতে-গলিতে, পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য আবাসিক মহিলা মাদ্রাসা। বর্তমানে শিক্ষা যেখানে ব্যাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। সেখানে আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানে টাকার পাহাড়। এসব আবাসিক মহিলা মাদ্রাসায় নূরাণী হিফজ কিতাব পড়ানো হয়। এছাড়াও কোমলমতি শিশু-কিশোরীদেরকে পবিত্র আল কুরআন মুখস্থ করানোর পাশাপাশি, ধর্মীয় অন্য বিষয়গুলোও শিক্ষা দেওয়া হয়। মুসলিম হিসেবে ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ করা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু অধিকাংশ আবাসিক মহিলা মাদ্রাসা পরিচালিত হয় একটি বা দুইটি ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া করে। একই রুমে অনেক শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে থাকতে হয়। স্বাস্থ্যের ঝুঁকি যেমনি থাকে, অন্যদিকে মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য নেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। এতে করে নিরাপত্তার বিষয়টিও ঝুঁকিতে থাকে। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে আবাসিক মহিলা মাদ্রাসার যৌন নির্যাতনের ঘটনায় নেতিবাচক শিরোনাম হতে দেখা যায়। তবে বেশিভাগ সময় আবাসিক মহিলা মাদ্রাসার ভেতরে কি হচ্ছে, বাহির থেকে বুঝা যায় না। এতে করে অনেক ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়।
চাঁদপুরের আবাসিক মহিলা মাদ্রাসাগুলো মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে কতটা নিরাপদ? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজতে অনুসন্ধান শুরু করে দৈনিক শপথের তরফ থেকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চাঁদপুর জেলায় প্রায় শতাধিক আবাসিক মহিলা মাদ্রাসা আছে। শুধুমাত্র চাঁদপুর শহরেই ১০-১৫ টি আবাসিক মহিলা মাদ্রাসা রয়েছে। এরমধ্যে রাহে নাজাত মহিলা মাদ্রাসা, ইসলাহুন্নিসা মহিলা মাদ্রাসা, হালিমা খাতুন মহিলা মাদ্রাসা, রশিদীয়া ইব্রাহিমীয়া মহিলা মাদ্রাসা, দরুল করীম মহিলা মাদ্রাসা, ফাতেমাতুজ জোহরা মহিলা মাদ্রাসা, মরিয়ম মহিলা মাদ্রাসা অন্যতম। এছাড়াও নামে বেনামে অনেক আবাসিক মহিলা মাদ্রাসা আছে চাঁদপুর শহরের অলিতে গলিতে।
হাজীগঞ্জ বাজারেও আছে বেশ কিছু আবাসিক মহিলা মাদ্রাসা। তার মধ্যে দারুত ত্বাকওয়া তাহফিজল কোরাআন মাদ্রাসা, রহিম নূর ক্যাডট মাদ্রাসা, তাহফিরাজুল উলূম তাহফিজুল কোরাআন মাদ্রাসা, নূরুল কোরআান মহিলা মাদ্রাসা, মিকতাহুল জান্নাত মহিলা মাদ্রাসা, ফাতেমা (বাঃ) মহিলা মাদ্রাসা, জাবালে নূর মডেল হিফয মাদ্রাসা, তালিমূল কোরাআন, নূরনী ও হাফিজয়া মাদ্রাসা। বাগে জান্নাত মহিলা মাদ্রাসা, যিন নূরাইন মহিলা মাদ্রাসা অন্যতম। যার একটিরও সরকারি কোন অনুমতি নেই। অথবা নূন্যতম সরকারি কোনো তদারকি নেই। তবে দুই একটির অনুমতি আছে বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা বোর্ডের (বেফাক)। অনুমতি ছাড়াই দিনের পর দিন আবাসিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে তারা। অথচ প্রশাসন এ ব্যাপারে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
কথা হয়, চাঁদপুর ওয়ারলেস ফিশারী গেইটে অবস্থিত রাহে নাজাত মহিলা মাদ্রাসার পরিচালক হাফেজ মাওলানা সোলাইমানের সাথে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় তার আবাসিক মহিলা মাদ্রাসার সরকারি কিংবা স্থানীয় প্রশাসন অথবা স্থানীয় কতৃপক্ষের কোন অনুমতি আছে কি না? তিনি বলেন কোন অনুমতি নেই। তবে বেফাকের সাথে যোগাযোগ করে মাদ্রাসা দিয়েছি। আর মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টি তারা নিশ্চিত করেন। ফ্ল্যাটের গেইটে তালা দিয়ে!
এছাড়াও কথা হয়, বিষ্ণুদী রোড়ে অবস্থিত হালিমা খাতুন মহিলা মাদ্রাসার পরিচালক মুফতি আবুল কালাম সাথে। তাদের প্রতিষ্ঠানে আবাসিক শিক্ষার্থী রয়েছে ৪০ জন। তার কাছে সরকারি কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি আছে কি না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন ‘কোন অনুমতি নেই। তবে মুরব্বিদের সাথে আলোচনা করে মাদ্রাসা দিয়েছি। আর মেয়ে নিরাপত্তার বিষয়টি তারাও নিশ্চিত করেন। ফ্ল্যাটের গেইটে তালা দিয়ে!।
দৈনিক শপথের সাথে কথা হয় স্বর্নখোলা রোডে অবস্থিত রশিদীয়া ইব্রহিমীয়া মহিলা মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা ছালিম হুসাইনের সাথে। তাদের প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৭০ জন আবাসিক শিক্ষার্থী আছে। তাদের সরকারি কোন অনুমতি নেই। তাদের আবাসিক মহিলা মাদ্রাসায় পুরুষ শিক্ষক আছে চারজন। আর পুরুষ স্টাফ আছে একজন। আর মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টি তারাও নিশ্চিত করেন। তাদের ভবনের তৃতীয় তলার গেটে তালা দিয়ে!।
এছাড়াও, শহরের মাদ্রাসা রোড়ে অবস্থিত ইসলাহুন্নিসা মহিলা মাদ্রাসার একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির সাথে কথা হয়। তিনি পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তাদেরও সরকারি কিংবা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কোন অনুমতি নেই বলে জানিয়েছেন। আর মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টি তারাও নিশ্চিত করেন ফ্ল্যাটের কলাপসার গেইটে তালা দিয়ে!
যেখানে নানান সময়ে দেশের গণমাধ্যমে শিক্ষক কর্মচারি এমনকি মাদ্রাসার হুজুরদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠে। সেখানে অনিয়ন্ত্রিত প্রশাসনের নজিরবিহীন এইসব আবাসিক মহিলা মাদ্রাসাগুলো মেয়েরা কতোটা নিরাপদ?
এই বিষয়ে অনেক অভিভাবকের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে সাংবাদিকেদের সামনে কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিভাবক জানান, মনের ভিতরে তো একটা ভয় থাকেই। তবুও আল্লাহর উপর ভরসা করে মেয়েকে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়েছি। দেখি আল্লাহ কি করে?
তাহলেকি অনুমতি ছাড়াই দিনের পর দিন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে এই সব আবাসিক মহিলা মাদ্রাসাগুলো ? এ বিষয় কথা বলতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাজেদুর রহমান খান বলেন ‘আমার কাছে না। আপনারা এডিসির সাথে যোগাযোগ করেন। দেখেন কোন তথ্য আছে কি না।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) দাউদ হোসেন চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমার যানা নাই এই বিষয় কোন নীতিমালা আছে কি না।’
উপজেলা শিক্ষা অফিসার নাজমা বেগমের কাছে জানতে চাওয়া হয় যে আবাসিক মহিলা মাদ্রাসা সম্পর্কে তিনি কিছু যানেন কি? তিনি বলেন ‘এটা আমাদের কাজ নয়’
আবাসিক মহিলা মাদ্রাসা সম্পর্কে ইসলামি ফাউন্ডেশনের উপ পরিচালক মোহাম্মদ খালিলুদ রহমান বলেন, ‘এটা আমাদের কাজের মধ্যে পড়ে না!’।
যেখানে ছোট একটি চায়ের দোকান স্থাপন করতে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয়। সেখানে এত বড় বড় আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে কোন অনুমোদন কিংবা অনুমতি ছাড়া। এতে একদিকে যেমন মেয়েদের নিরাপত্তার প্রশ্ন অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ঝুঁকিও বিদ্যমান।
প্রতিদিনই দেশে ধর্ষণ কিংবা সংঘবদ্ধ ধর্ষনের ঘটনা ঘটেছে। সেই ক্ষেত্রে এই সব অনুমোদনহীন আবাসিক মহিলা মাদ্রাসায় কিশোরীরা কতটা নিরাপদ?
এই বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী মোহাম্মদ আবদুল রহিম জানান, ‘এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েরা কতটা নিরাপদ সেটা নির্ভর করে তাদের ব্যবস্থাপনার উপর। আমরা এই বিষয়ে কি বলবো?
জানতে চাওয়া হয় যেখানে কিছুদিন পর পর জঙ্গি ইস্যুটি সামনে চলে আসে। সেখানে ধর্মকে পুঁজি করে কোন সুযোগ সন্ধানী গোষ্ঠী কি এসব আবাসিক মাদ্রাসা ব্যবহার করতে পারে?
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ কাজী আবদুল রহিম বলেন ‘এই বিষয়টা দেখার জন্য আমাদের কেন্দ্রীয় একটি ইউনিট আছে। তারা দেখে। তাহলে জেলা পুলিশ কি কোন নজরদারী করে না আবাসিক মহিলা মাদ্রাসায়? তিনি জানান, আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি আছে।
জানতে চাওয়া হয়, যেখানে আবাসিক মহিলা মাদ্রাসা সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য নেই, সেখানে নজরদারি করা হয় কিভাবে? তিনি বলেন, ‘আমাদের গোপন গোয়েন্দা তথ্য সম্পর্কে তো আর আপনাকে বলতে পারবো না।’
আদৌও কি আবাসিক মহিলা মাদ্রাসা সম্পর্কে কোন তথ্য জেলা পুলিশ কিংবা জেলা প্রশাসনের কাছে আছে কি না সেই প্রশ্নের সঠিক কোন উত্তর পাওয়া যায় নাই।
এই বিষয় জেলা কমিউনিটি পুলিশংয়ের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আলম খোকন বলেন, ‘আবাসিক মহিলা মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে মেয়েদের নিরাপত্তার নিশ্চিত করা জরুরি। আর এখন যেহেতু ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী ছড়িয়ে পড়েছে দেশে, তাই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে মাদ্রাসাগুলোর তথ্য সংগ্রহ করে রাখা জরুরি।
সুশীল সমাজের দাবি। ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণে কোন বাঁধা নয় বরং সেখানে পড়াশোনা করা মেয়েদের নিরাপত্তার নিশ্চিত করার জন্য। কোন উগ্রবাদী গোষ্ঠী যাতে শিক্ষার এই পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্র বিরোধী কাজ করতে না পরে সেজন্য আবাসিক মহিলা মাদ্রাসা সম্পর্কে জেলা প্রশাসন কিংবা পুলিশ প্রশাসন পূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে রাখে।