আস্থাহীন শেয়ারবাজারে ছয় হাজার কোটি টাকার তহবিল!

 In দেশের ভেতর, প্রধান খবর, ব্যবসা বাণিজ্য

সচিবালয়ে গতকাল মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে বৈঠক করে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সমিতি বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকারস অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) লিখিত এই প্রস্তাব দিয়েছে। প্রতিনিধিদলটি শেয়ারবাজারের জন্য চারটি বিকল্প প্রস্তাবও দেয়। বিএমবিএর সভাপতি সাইদুর রহমানের নেতৃত্বাধীন দলটিতে সংগঠনের সহসভাপতি এম মোশাররফ হোসেন ও কোষাধ্যক্ষ খন্দকার কায়েস হাসান উপস্থিত ছিলেন।
অর্থমন্ত্রীর কাছে লিখিত প্রস্তাবে যে চারটি বিকল্পের কথা বলেছে বিএমবিএ, সেগুলো হচ্ছে ছয় হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন, প্রতিটি ব্যাংককে অতিরিক্ত ২০০ কোটি টাকা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার ক্ষমতা দেওয়া, পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়া এবং মূল কোম্পানিকে সহযোগী কোম্পানির দায় বহনের সুযোগ দেওয়া।

বিএমবিএর লিখিত বিকল্প প্রস্তাব
* ৬০০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন
* ৫–৬ হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়া
* প্রতিটি ব্যাংককে অতিরিক্ত ২০০ কোটি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার ক্ষমতা দেওয়া
* মূল কোম্পানিকে সহযোগী কোম্পানির দায় বহনের সুযোগ দেওয়া

বৈঠক শেষে সাইদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘শেয়ারবাজারে তারল্য সংকট চলছে। সংকট মেটাতে দরকার ছয় হাজার কোটি টাকা। আমরা অর্থমন্ত্রীকে কয়েকটি বিকল্প উপায় বলেছি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করবেন তিনি।’
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের কিছু জানাননি।
তবে প্রস্তাবটি সমর্থন করেননি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বেদনার জায়গাটি ঠিক আছে। কিন্তু বাজারে গতি আনতে তাদের প্রস্তাবগুলো আরেকটু বাস্তবসম্মত হতে হবে। দরকার হচ্ছে এখন শেয়ারবাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত সব পক্ষের বসা এবং তারপর একটা উপায় বের করা। করের টাকায় ছয় হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের বিপক্ষে বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, এর আগেও শেয়ারবাজারে অর্থের প্রবাহ বাড়ানোর নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সরকারের নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংকও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগের সুবিধা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আস্থাহীনতার কারণে কোনো উদ্যোগই সফল হয়নি। কখনো কখনো চাঙা থাকলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় বড় ধরনের কোনো শাস্তির ব্যবস্থা না হওয়ায় আস্থা ফেরেনি বাজারে। এই অবস্থায় নতুন করে অর্থ চাইল মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বিএমবিএ।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক রকিবুর রহমান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ছয় হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠিত হলে বাজারের তারল্য সংকট কাটবে। কিন্তু আস্থার সংকটও দূর করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এখন দৈনিক লেনদেনকারী (ডে ট্রেডার) হয়ে গেছে বলেও মনে করেন রকিবুর রহমান। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর উদ্দেশে তিনি বলেন, শেয়ার কিনে যাদের ধরে রাখার কথা, তারা সেই দায়িত্ব পালন করছে না। তাদের এই চরিত্রও বদলাতে হবে।
দেশে বর্তমানে ৫৬টি মার্চেন্ট ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে ৪২টি মার্চেন্ট ব্যাংক বিনিয়োগকারীদের ঋণ দেওয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের কাজ করে। আর আংশিক কাজ করে ১৪টি মার্চেন্ট ব্যাংক। বিএমবিএ বলেছে, ২০১০ সালের ধসের পর বাজারে ব্যাপক দরপতন হয়েছে। ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের দেওয়া মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ছয় হাজার কোটি টাকা নেগেটিভ ইক্যুইটি। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের নিজের টাকা তো খোয়া গেছেই, মার্চেন্ট ব্যাংক থেকে যে ঋণ নিয়েছিলেন, তা থেকেও ছয় হাজার কোটি টাকা নেই।
বিএমবিএ প্রস্তাব করেছে বিশেষ তহবিলটি হতে হবে সাত বছর মেয়াদি। এই তহবিল থেকে ৩ শতাংশ সুদে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিতে হবে। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো তখন ওই টাকা দিয়ে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনার জন্য ঋণ দেবে ৫ শতাংশ সুদে। এ ছাড়া প্রথম দুই বছর সরকারকে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে শুধু সুদ দেওয়া হবে। পরের পাঁচ বছরের প্রতিবছর ২০ শতাংশ করে মূল ঋণের টাকা ও সুদ সরকারকে ফেরত দেবে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো।
বিএমবিএ বলেছে, কোনো কারণে বিশেষ তহবিল গঠন না করলেও শেয়ারবাজারকে গতিশীল করার স্বার্থে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাড়তি বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে পারে সরকার। ব্যাংকের জন্য অতিরিক্ত ২০০ কোটি টাকা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য অতিরিক্ত ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া যায়। এই বিনিয়োগ অবশ্য সমন্বয় করে নিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাঁচ বছর সময় দিতে হবে।
বিএমবিএ পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়ারও প্রস্তাব দিয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। বন্ড ছেড়ে যে টাকা তোলা হবে, তা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের কাজে ব্যয় করতে হবে। সাত থেকে আট বছর মেয়াদি এ বন্ডের সুদের হার হতে পারে ৫ শতাংশ।
এই তিন বিকল্পের একটিও যদি সরকার বাস্তবায়ন করতে না চায়, তাহলে সহযোগী কোম্পানির দায় কর সুবিধা দিয়ে মূল কোম্পানিকে বহন করার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে বিএমবিএ।
বিএমবিএ বলেছে, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো আগে যেসব শেয়ারের বিপরীতে বিনিয়োগকারীদের ঋণ দিয়েছিল, সেগুলোর দাম এত কমে গেছে যে তাতে বিনিয়োগকারী-মার্চেন্ট ব্যাংক উভয় পক্ষই ক্ষতির শিকার। এতে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর মূলধন নেতিবাচক হয়ে গেছে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং শেয়ারবাজারে গতি ফেরাতে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর ওপর নেতিবাচক মূলধনের চাপ (নেগেটিভ ইক্যুটি বার্ডেন) রয়েছে, তা থেকে বের করে আনতে হবে। পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানি (এমএনসি) ও সরকারি লাভজনক কোম্পানিগুলোকে (এসওই) শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার ব্যবস্থা নিতে অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছে বিএমবিএ।
অর্থমন্ত্রীকে বিএমবিএ বলেছে, ‘আমরা আশা করছি, প্রস্তাবগুলো ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করলে শেয়ারবাজারই শুধু গতিশীল হবে না, সরকারের জনপ্রিয়তাও বাড়বে। আর শেয়ারবাজার ভালো চললে সরকার বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের অর্থ বাজার থেকেই তুলতে পারবে।’
২০১০-এর ধসের পর ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য ৯০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করে সরকার। কিন্তু পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার অভাবে সরকারের ওই উদ্যোগ থেকে তেমন ফল আসেনি বলে মনে করেন বিএমবিএর সভাপতি সাইদুর রহমান। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, তিন মাস পর থেকে টাকা ফেরতের কিস্তি দিতে বলা হয়, যা অবাস্তব। আবার এত বড় বাজারের তুলনায় ৯০০ কোটি টাকাও সামান্য বলে মনে করেন তিনি।

Recent Posts

Leave a Comment