গলি থেকে রাজপথে মো. সবুর খান

 In চাঁদপুর, সফল মানুষ

 

হিমো. সবুর খান (১) আপনার ‘গলি থেকে রাজপথে’ আসার কাহিনী জানতে চাই।

মো. সবুর খান: শুরু করেছিলাম ১০১/এ, গ্রিন রোডে, ছোট্ট পরিসরে। সেখানেই ড্যাফোডিল কম্পিউটার্সের শুরু। তখন আমি জানতাম না আজ  আমি এখানে এসে পৌঁছব। একজন উদ্যোক্তা সব সময়ই নতুন নতুন পরিকল্পনা করেন। আমিও করেছি। নতুন নতুন পরিকল্পনা করতে গিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছি। সেসব প্রতিবন্ধকতা জয় করেই সামনে এগিয়েছি। আমি মনে করি, প্রতিবন্ধকতা জয় করতে পারাটা আমার জীবনের একটি বড় সফলতা। মূলত সাফল্যের কারণই হলো প্রতিবন্ধকতা। কারণ একটি প্রতিবন্ধকতা জয় করতে গিয়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি। সব সময় শতভাগ ওভারকাম করতে পারিনি।

আমি প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছি, কিন্তু কখনও বাইপাস করিনি। দেখা গেছে, একটা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে ‘অল্টারনেটিভ অপুরচুনিটিজ বের হয়ে গেছে। যেহেতু বাইপাস করিনি তাই অল্টারনেটিভ অপুরচুনিটিজ ব্যবহার করে সে পথে গিয়ে সাফল্য পেয়েছি।

১৯৯৮, ’৯৯ সালে আমি এ দেশে বিশ্বখ্যাত কম্পিউটার ব্র্যান্ডগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেছি। সেসময় লোকাল ব্র্যান্ড পিসি বাজারজাত করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। এ কারণে আমি সব ব্র্যান্ড ছেড়ে দিই। কারণ ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ডগুলো আমাদের ঘাড়ে পা রেখে তাদের স্বার্থ হাসিল করছিল। তারা আমাদের স্বার্থের দিকে তাকাচ্ছিল না। ২০০০ সালের দিকে আমি যদি এইচপি, মাইক্রোসফট-সহ বড় বড় কোম্পানিকে ছেড়ে না দিতাম তাহলে আমি আজকের এ অবস্থানে আসতে পারতাম না।

 আমি মনে করি সেই গ্রিন রোডের সেই গলি থেকে আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে আমার জীবনের সব বাধা, ব্যর্থতা এবং অল্টারনেটিভ অপুরচুনিটিজ সময় মতো ব্যবহার করতে পারার ক্ষমতা নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

আরেকটি কথা বলতে চাই, ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত আমার কলাবাগানের কম্পিউটারের সুপার স্টোরটি ছিল সবচেয়ে নামকরা। কিন্তু আগারগাঁওয়ে বিসিএস কম্পিউটার মার্কেট তৈরি হওয়ার পর আমার সুপারস্টোরটি জৌলুস হারাতে থাকে। কারণ ওখানেও আরও ভালো এবং নামকরা সব স্টোর তৈরি হয়। আমাদের ড্যাফোডিলেরও শো-রুম হয়। কিন্তু আমি যদি কলাবাগানের সুপারস্টোরটিকে আঁকড়ে পড়ে থাকতাম তাহলে আমি এতদূর আসতে পারতাম না। তাই সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যেটা সামনে এসেছে সেটাকে গ্রহণ করেছি। সেখান থেকে আমি শিফট (হার্ডওয়্যারে থেকে) করে চলে আসি সফটওয়্যারে। সফটওয়্যার থেকে চলে যাই শিক্ষাই। শিক্ষা এখন প্রতিষ্ঠিত। এখন যেতে চাইছি ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিংয়ের দিকে।

 ড্যাফোডিল কম্পিউটার্সকে কেন এখন আর সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। অথচ আপনার ভিত্তি কিন্তু গড়ে দিয়েছিল ড্যাফোডিল কম্পিউটার্স।

মো. সবুর খান:  কিছুদিন দূরে থাকলেও এখন আমি আবার ড্যাফোডিল কম্পিউটার্সে ফিরে এসেছি। কারণ এটা আমার ভিত্তিমূল। আমাকে গড়ে দিয়েছে। আজকে আমাদের ইউনিভার্সিটির (ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি) প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে ল্যাপটপ তুলে দেওয়ার অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে ড্যাফোডিল কম্পিউটার্স। যদিও প্রথম দিকে আমরা ড্যাফোডিল পিসি দিতাম।

নতুন নতুন পণ্য নিয়ে ফের মাঠে নেমেছি। এর মধ্যে রয়েছে টেস্টেড সফটওয়্যার, মেডিক্যাল  সফটওয়্যার, ফার্মেসি ম্যানেজমেন্ট এবং ইআরপি সফটওয়্যার।

মো. সবুর খান (২)
 আপনি বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) সভাপতি ছিলেন, ঢাকা চেম্বারের (ডিসিসিআই) সভাপতিরও দায়িত্বে ছিলেন। সে সময়ের অর্জনগুলো সম্পর্কে জানতে চাই।

মো. সবুর খান: বিসিএসে আমার মেয়াদে ভালো একটি টিম ম্যানেজমেন্ট পেয়েছিলাম। ২ বছর মেয়াদে বেশ কিছু কাজ করা হয়েছিল। ওই সময় আমরা সরকারকে তথ্যপ্রযুক্তির জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় (আইসিটি মন্ত্রণালয়) ঘোষণা করতে বাধ্য করি (২০০২ সালের ২৪ মার্চ)। ওই সময় সরকার আইসিটি পণ্যে কর আরোপ করে। আমরা কর ওঠাতেও বাধ্য করি। দেশের প্রথম আইসিটি ইনকিউবেটর করি (কাওরান বাজারে, যেটা বর্তমানে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক -১)।

ঢাকা চেম্বারে অল্প ক’দিনের দায়িত্বে যাওয়ার আগে আমি একটা পরিকল্পনা করে নিই। সে মতে কাজ করি। আমার লক্ষ্য ছিল একটা বিটুবি সাইট তৈরি করা। সেটা করেছি। সদস্যদের তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। আমার মেয়াদে আমি ৭ কোটি টাকা সদস্য ফি ও নবায়ন ফি আদায় করেছি। একটি হেল্পডেস্কও করেছি।

উদ্যোক্তা তৈরি করা না গেলেও প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, গাইডলাইন দেওয়া যায়। উদ্যোক্তা হতে গেলে প্রয়োজন হয় জায়গা, পুঁজি ও কাজের ক্ষেত্র। এজন্য অবকাঠামোগত পরিবেশ প্রয়োজন। আমি নবীন উদ্যোক্তা বা স্টার্টআপদের জন্য একটি গাইডবুক প্রকাশ করেছি। তাদের প্রয়োজন হয় জায়গা। তার জন্য তৈরি করেছি ড্যাফোডিল বিজনেস ইনকিউবেটর।

 নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। আবার কি কখনও নেতৃত্বে ফিরবেন?

মো. সবুর খান:  আমি নতুন নেতৃত্ব তৈরি করতে চাই। সরে না দাঁড়ালে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হবে কিভাবে? আমি আর নেতৃত্বে আসতে চাই না। রাজনীতিতেও আসতে চাই না।

আপনার উদ্যোক্তা তৈরির প্রকল্প সম্পর্কে জানতে চাই।

মো. সবুর খান: ঢাকা চেম্বারের নেতৃত্বে এসে আমি উদ্যোক্তা তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করি। যদিও জানি যে উদ্যোক্তা কখনও তৈরি করা যায় না। কিন্তু এ বিষয়ে আমার আগ্রহের কথা জেনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি ১০০ কোটি টাকার একটি তহবিলও তৈরি করে দেন। তাতে ৩৯টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়। আমি ২ হাজার উদ্যোক্তা তৈরির প্রকল্প হাতে নিই।

 এ বিষয়ে যদি বিস্তারিত বলতেন।

মো.সবুর খান: উদ্যোক্তা তৈরি করা না গেলেও প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, গাইডলাইন দেওয়া যায়। উদ্যোক্তা হতে গেলে প্রয়োজন হয় জায়গা, পুঁজি ও কাজের ক্ষেত্র। এজন্য অবকাঠামোগত পরিবেশ প্রয়োজন। আমি নবীন উদ্যোক্তা বা স্টার্টআপদের জন্য একটি গাইডবুক প্রকাশ করেছি। তাদের প্রয়োজন হয় জায়গা। তার জন্য তৈরি করেছি ড্যাফোডিল বিজনেস ইনকিউবেটর।

 আপনার এই উদ্যোগের বর্তমান অবস্থা কি?

মো.সবুর খান: আমি এই উদ্যোগের জন্য ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি তৈরি করেছি। এর নাম বাংলাদেশ ভেঞ্চার কোম্পানি লিমিটেড। এ পর্যন্ত এই ভেঞ্চার কোম্পানি ৮টি কোম্পানিকে অর্থায়ন করেছে। ১ হাজার ২০০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আমার মেয়াদে ১৯টি কোম্পানিকে ফান্ডিংও করা হয়েছে। এখন তা ২০০ কোম্পানিকে ছাড়িয়ে গেছে।

 সম্প্রতি আপনি আউটসোর্সিং ও ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রতি ঝুঁকেছেন।

মো.সবুর খান: এটা উদ্যোক্তার একটি অংশ, তাই ভাবলাম ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে কাজ করি। এ ক্ষেত্রে দুই একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বলতে চাই। আমি এমন একজনকে জানি যে কেনিয়া সরকারের ভূমি অটোমেশনের কাজ করে। সে আমাকে বলছে, ‘আমার দেশের সরকার তো কাজ দিচ্ছে না।’ এই ছেলেটিকে যদি আমরা কাজ দিতে পারি তাহলে সে একটা দিগন্ত বদলে দিতে পারবে।
আরও একটা কারণ আছে এটা নিয়ে কাজ করার। এখন যারা ফ্রিল্যান্সিংয়ে মার্কেট লিড দিচ্ছে তাদের বেশিরভাগই আমাদের তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান  ডিআইআইটির শিক্ষার্থী। সম্প্রতি আমরা যে ১০০ জন সেরা ফ্রিল্যান্সারকে সংবর্ধনা দিয়েছি তাদের মধ্যে অন্তত ৩০ জন আমাদের প্রতিষ্ঠানের। তারমানে একটা বড় কমিউনিটি আমাদের মাধ্যমে ডেভেলপ হচ্ছে।
আমার ভাবতে ভালো লাগে, আমাদেরই একজন অ্যালামনাই দেশে একটি সুন্দর মার্কেটপ্লেস তৈরি করেছে। তাকে আমরাই উৎসাহিত করেছি। এমন আরও অনেক উদাহরণ দিতে পারব।

.

মো. সবুর খান (৩)

 বিল গেটস ঢাকায় এসেছিলেন। আপনার সঙ্গে তার সাক্ষাৎও হয়েছিল। মনে আছে সেদিনের ঘটনা, স্মৃতি?

মো.সবুর খান: এটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। দারুণ আশাবাদী একজন মানুষ। এমনভাবে উৎসাহ দেন যে কাজ করার আগ্রহ বেড়ে যায়।

বিল গেটসের আগমন উপলক্ষে বিশাল একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন, বাংলাদেশে মাইক্রোসফটের অফিস করবেন। পরে অবশ্য তার সে প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। তার আগমনকে ঘিরে বিশেষ করে তার কিছু কিছু বিষয়ে তার যে ইনভলভমেন্ট ছিল, যেমন ১০ হাজার শিক্ষককে তিনি প্রশিক্ষণ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন এবং সেই সংখ্যাকে পরবর্তীতে ১০ লাখে উন্নীত করারও স্বপ্ন ছিল তার কিন্তু সেসব হয়নি। আমি বলব, ওই সময়ে যারা দায়িত্বে ছিলেন, এটা ছিল তাদের একটা বড় ব্যর্থতা। ওই বিষয়গুলোকে এগিয়ে নিতে কেউ কোনও কাজ করেনি। কোনও ফলোআপ করেনি। এটা ছিল আসলে আমাদের কর্তাব্যক্তিদের ব্যর্থতা। কারণ প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান হিসেবে যতটা করার তা আমরা করেছিলাম।
বিল গেটস ২০০৬ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে সমন্বয়কারীর ভূমিকায় ছিলাম আমি। সে সময় আমি তার যে স্পিরিট দেখেছিলাম, যে স্পৃহা দেখেছিলাম তা ছিল এক কথায় অনন্য। কথা কথায় আমাকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ একটা সম্ভাবনাময় দেশ। এই দেশে অনেক কিছু করার আছে। আমি কিছু করতে চাই।’

সরকারকে বাদ দিয়ে ডিজিটাল বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়। তাই আমরা ব্রিজিং করার চেষ্টা করছি সরকার, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং মাঠকর্মীদের সঙ্গে। সবাই মিলে এক হয়ে কাজ করলে এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব।

 দেশে ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে বিভিন্ন পক্ষের উদ্যোগগুলো সম্পর্কে জানতে চাই।

মো.সবুর খান: দেশে ডিজিটাল বৈষম্য আছে এবং সরকার সেসব বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করছে। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্প ভালো ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকার লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রকল্পের মাধ্যমে ভালো কিছু করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু এই প্রকল্পে যাদের পরামর্শক হিসেবে নেওয়া হয়েছে তারা আমাদের দেশের কেউ নন। তারা আমাদের আবেগ, অনুভূতি বুঝবেন কিভাবে?
আমি সরকারকে দোষারোপ না করে বরং ব্যক্তি উদ্যোগে কি করা যায় সেসব নিয়ে আমরা ভাবছি। আমরা আমাদের এডুকেশন সিস্টেমের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সারদের নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি। তাদের সঙ্গে কাজ করার সময় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছে যে, ‘আমরা তো সব জানি কিন্তু সরকার তো আমাদের কাজে লাগাচ্ছে না।
সরকারকে বাদ দিয়ে ডিজিটাল বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়। তাই আমরা ব্রিজিং করার চেষ্টা করছি সরকার, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং মাঠকর্মীদের (যারা সত্যিকারের কাজটা করে) সঙ্গে। সবাই মিলে এক হয়ে কাজ করলে এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব।

 সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মো. সবুর খান: বাংলা ট্রিবিউনকে শুভেচ্ছা।

Recent Posts

Leave a Comment